অক্সফোর্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 28th March 2025 01:39
আজ যখন বেলা ১১টা নাগাদ লন্ডনের হোটেল থেকে অক্সফোর্ডের উদ্দেশে রওনা হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee Oxford), বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন। গল্পের ছলেই তিনি বলেন, 'আমি বক্তৃতা দিতে অত ভালবাসি না। আমি রান্নাবান্না করতেই ভালবাসি আর সেলাইফোঁড়াই করতেই ভালবাসি।' রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যে বিলেতের মাটিতে বক্তৃতার বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত কোনও চাপ নিতে নারাজ, তা এদিন সকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
তাই বলে কি বক্তৃতার প্রস্তুতি নেননি? তা খানিকটা নিয়েছেন বইকি। তাই তো দিদির হাতে ধরা ছিল একটি ফাইল, যাতে ছিল আজকের লিখিত বক্তৃতা এবং বিশেষ কিছু পয়েন্টার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ কলেজে আজ তাঁর বক্তৃতার মূল বিষয় হল মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়ন। সে বিষয়ে কিছু পয়েন্টার প্রস্তুত করে এনেছেন তিনি।
তবে এদিন বক্তৃতার মাঝপথে টের পাওয়া যায়, শুধু বক্তৃতা নয়, তিনি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে কীভাবে সামাল দেবেন, তাই নিয়েও। তাই বক্তৃতার মাঝে যখন টাটা থেকে আরজি কর প্রসঙ্গে রীতিমতো উত্ত্যক্ত করে তোলা হয় মমতাকে, তখন সেসব প্রশ্নের জবাবে রীতিমতো ছক্কা হাঁকান মমতা।
এদিন মার্সেডিজ কোচে (বাস) বসে তিনি বলেন, 'আমি তো এরকম দেখে দেখে হুবহু বক্তৃতা দিই না কখনও। আমার কাছে পয়েন্টার লেখা আছে কিছু, দেখে নিয়েছি। তার পরে আমার যেমন মনে হবে, তেমনই বলব।' বাস্তবে হয়েছেও তাই। বক্তৃতার মাঝে আচমকা বিরোধীদের বিক্ষুব্ধ প্রশ্নের মুখে পড়ার তো কোনও স্ক্রিপ্ট হয় না! তার পরেও পোড়খাওয়া রাজনীতিকের মতো অত্যন্ত কড়া অথচ বিনম্র ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি।
এদিন দুপুরে দিদির ওই বাসটি লন্ডন থেকে বেরিয়ে বার্মিংহামশায়ার হয়ে, দু'ঘণ্টার পথ পার করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পৌঁছয়। অক্সফোর্ডের অধীনে যে ৩৮টি বিশেষ কলেজ রয়েছে, তারই অন্যতম হল কেলগ কলেজ। সেখানেই বিকেলে বক্তৃতা দেন মমতা।
নির্ধারিত সূচি মেনেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ কলেজে বক্তৃতা শুরু করন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।বাংলায় নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্য লন্ডনে কৌতূহল এমন পর্যায়ে যে প্রেক্ষাগৃহ হাউসফুল হয়ে গিয়েছিল আগেই। এদিন বক্তৃতার শুরুতে মমতা বলেন, 'আমাকে আপনারা বারেবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তবে আমি রাজনৈতিক-সহ নানা কারণে আগে আসতে না পারার জন্য দুঃখিত।' এর পরে নিজের জীবনের লড়াই সংগ্রাম দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, '৯ বছরে বাবাকে হারিয়েছিলাম। ছোট থেকেই আমাকে লড়াই করতে হয়েছে।'
কোভিডে কীভাবে সারা বিশ্বের অ্রর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে সেই প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'শুরু থেকেই আমাদের নজরে ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির দিকে। তাই আমরা গরিব ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছি। বিভাজন নয়, ঐক্যই আমার লক্ষ্য। সেজন্য মৃত্যুও বরণ করতে রাজি আছি।'
রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে বিবেকানন্দর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতায় উঠে আসে 'মা-মাটি-মানুষ' এর কথাও। কেন এই স্লোগান, তার ব্যাখ্যাও দিলেন মমতা। বললেন, 'বিভাজন নয়, মানবিকতাই শেষ কথা। তাই আমরা বরাবর গরিব মানুষের পাশে থেকেছি। ১ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষকে আমরা দারিদ্রসীমার উপরে নিয়ে এসেছি। আমরা শুধু পিছিয়ে পড়া শ্রেণি নয়, কৃষক থেকে সমাজের সর্বস্তরের খেয়াল রাখি।'
আজ বক্তৃতার আগে মুখ্যমন্ত্রী আজ বোদলিয়ান লাইব্রেরি, ব়্যাডক্লিফ ক্যামেরা ঘুরে দেখেন। অক্সফোর্ডের তরফে বিশেষ ব্যক্তিত্বরা সঙ্গতও করেন তাঁকে। অক্সফোর্ড ঘুরে দেখার সময়ে, দুপুর দেড়টা নাগাদ, ট্রিনিটি কলেজের সামনে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আজকের বক্তৃতার মঞ্চে থাকার কথা সৌরভের। তার আগে এদিন সৌরভকে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনেও যান মমতা।
এদিনের বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীর জন্য করা নানারকম সুবিধার কথা উল্লেখ করেন, 'নারী শিক্ষার উন্নয়নে স্কুলস্তর থেকে কন্যাশ্রী চালু করেছি। উচ্চশিক্ষার জন্য স্মার্টকার্ড। বাল্যবিবাহ কমেছে, স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে বলেই বাংলায় এখন ৯৯.৯৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয়। আগে মাত্র ৩৩ শতাংশ ছিল। প্রতিটি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। শুধু ছাত্রীদের নয়, ছাত্রদের জন্যও আমরা স্কলারশিপ চালু করেছি। প্রবীণদের জন্য বার্ধক্যভাতা চালু করেছি। কন্যাশ্রী এখন দেশের মডেল। লক্ষ্মীর ভান্ডার এখন মহিলাদের ভরসা। বাংলায় চালু হওয়া লক্ষ্মীর ভান্ডার এখন সারা দেশ অনুসরণ করছে।'
এই প্রকল্পের কথা ভাল করে ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের জন্যই লক্ষ্মীর ভান্ডার। এটা আমৃত্যু বাংলার মেয়েরা পাবে। সর্বস্তরের গৃহবধূদের জন্যই আমরা এটা চালু করেছি। কৃষকদের বিনামূল্যে বিমার ব্যবস্থা করেছি। বিনামূল্যে সরকারিভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে আমরা বাংলার বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছি। জন্ম থেকে মৃত্যু, মানুষের সেবায় ৯৭টি সামাজিক প্রকল্প চালাই আমরা।'
এদিন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার সময়ে তিনি অক্সফোর্ডের ইতিহাসও শোনেন মন দিয়ে। শুনতে শুনতে বহু জায়গাতেই অভিভূত হয়ে যান মমতা। তিনি যান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটেও। স্বাধীনতার আগে ভারতবর্ষে যখন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) হতো, তখন সেখানে সুযোগ পাওয়া ক্যাডারদের ট্রেনিং হতো লন্ডনের এই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটে। সেই তালিকায় ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামও। এই সব ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই গায়ে কাঁটা দেয় সাধারণ মানুষের। দিদিও তার ব্যতিক্রম নন।
এদিন তিনি রাজ্যে শিল্প ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বলেন, 'আমরা গত ৫ বছর ধরে বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলনের আয়োজন করছি। আগের ৪ বছরে ২৩ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল, তার মধ্যে ১৯ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হয়েছে। এবারে ৪ লাখ ৪৮ হাজার কোটি প্রস্তাব এসেছে।'
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের এই জায়গায় পৌঁছে আচমকা টাটার প্রসঙ্গ ওঠে। শ্রোতাদের দিক থেকে অবিশ্বাসসূচক প্রশ্ন ওঠে বিনিয়োগ নিয়ে। মমতা আগেই বলেছিলেন, বল এলে ব্যাট চালাবেন। বাস্তবে হলও তাই। বললেন, আমি মিথ্যে বলছি না, বাংলাতেও টাটা কোম্পানি তাদের একাধিক প্রোজেক্ট করছে।'
এখানেই শেষ নয়, এর পরে উঠে এল আরজি কর প্রসঙ্গও। মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিলেন, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। ফলে এই নিয়ে এই মঞ্চে কথা বলা ঠিক হবে না। একই সঙ্গে বললেন, 'এই মঞ্চকে রাজনীতির মঞ্চে পরিণত করবেন না। প্রয়োজন হলে বাংলায় এসে দেখে যান, আমি মিথ্যে বলছি না।'
এর পরেও অসন্তোষ চলতে থাকে শ্রোতাদের মধ্যে। রীতিমতো চ্যাঁচামেচি শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আপনারা তো নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেও অসম্মান করছেন। মনে রাখবেন. আমি কিন্তু এখনও বিনম্র রয়েছি। এমন আচরণ করবেন না।'
এর পরেও টানা চার মিনিট ধরে চলে তর্কাতর্কি। তার পরেও ভাই, বোন সম্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী বলতে থাকেন, 'প্লিজ এখানে রাজনীতি করবেন না।' উল্টো দিক থেকে ক্রমাগত চিল চিৎকার চলতে থাকে। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, 'আপনি সত্য আড়াল করছেন।'
মুখ্যমন্ত্রী যদিও এখানেও দমে যাননি, সরেও যাননি। তিনি চেঁচিয়ে বলেন, 'এবার থেকে আমি চেষ্টা করব প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠানে আসতে। আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানি। আমি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নই। আমি খুশি, আমি ফিরে গিয়ে তোমাদের চকলেট পাঠাব। তোমাদের এই ধরনের আদর্শের জন্য। কতিপয় মানুষ ইচ্ছে করে ঝামেলা পাকাচ্ছো।'
বিরোধী দলনেত্রী থাকাকালীন কীভাবে তাঁর ওপর হামলা করা হয়েছিল, সেই ছবি তুলে ধরে প্রশ্নকর্তাদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'এখানে মিথ্যে কথা বলে আমাকে অপমান না করে বাংলায় গিয়ে নিজেদের দলকে শক্তিশালী করুন।'
এর পরে আবার স্বমেজাজে ফিরে আসেন মমতা। শেষ করেন তাঁর বক্তৃতা। বলেন, 'আমরা ১.২ কোটি স্ব-সহায়ক গোষ্ঠী তৈরি করেছি, তাই নারী ক্ষমতায়নে বাংলা শীর্ষে। এটা কি সহজ মনে করছেন? ধারাবাহিকতা রয়েছে বলেই এটা সম্ভব। দক্ষ শ্রমিকে আমরা শীর্ষে। প্রযুক্তিতেও আমরা এগোচ্ছি।'
এর পরে তিনি বলেন, 'মনে রাখবেন, আমি সরকার থেকে একটা পয়সা নিই না। সরকারের টাকায় এক কাপ চাও খাই না। সাতবারের সাংসদ ছিলাম। পেনশনের টাকাও নিই না। আমার লেখা বইয়ের রয়্যালটি থেকে আমার চলে যায়। ছবি এঁকেও আমি টাকা পাই। মনে রাখবেন, আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না। আপনি আমাকে বলবেন, আপনার জন্য রান্না করে দিতে। হ্যাঁ, আমি হাসিমুখে করে দেব। কেন জানেন, কোনও কাজই ছোট নয়।'
সবশেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'কিন্তু কুৎসার সামনে মাথা নত করব না, মাথা নত করতে হলে মানুষের কাছে করব।' এরপর রবি ঠাকুরের কবিতা আউড়ে বললেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...’
বক্তৃতার শেষে গোলমালের জন্য ক্ষমা চাইলেন সঞ্চালকরা। এর পরে ১৩০টি বই লেখার প্রসঙ্গ টেনে সঞ্চালকরা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, এতে অফুরন্ত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পান? জবাবে মমতা ফের মা-মাটি মানুষের স্লোগান আউড়ে বলেন, 'আমার পদবি ব্যানার্জি। অপোজিট অফ এনার্জি।'
মুখ্যমন্ত্রীর রসিকতায় হাসির রোল ওঠে। হাততালি জানিয়েও প্রশংসা করেন অনেকে। ভাগ্যের প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে মমতা বলেন, 'আমি জ্যোতিষী মানি না। আমি মনে করি, তুমি কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করছো, এটার ওপরই সবটা নির্ভর করে। থেমে গেলে চলবে না। লড়াইয়ের মাধ্যমেই টিকে থাকতে হয়।'
কীভাবে ভারত অর্থনৈতিক ভাবে এতটা উন্নত? সঞ্চালকদের কড়া প্রশ্ন সামলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'এ বিষযে আমার ভিন্ন মত রয়েছে। তবে এটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সবটা বলা ঠিক নয়।'
তবে সঞ্চালকদের প্রশ্নের জবাবে সুকৌশলে বাংলায় অতীতের শাসক বাম আমলের ঋণের বোঝা থেকে বর্তমানে কেন্দ্রের সরকারের জিএসটি বঞ্চনার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, 'আমাদের দেশে এখন একটাই কর, তার নাম জিএসটি। রাজ্য থেকে সেই কর নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু আমরা শেয়ার পাই না।'