অক্সফোর্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 28th March 2025 01:56
ততক্ষণে ঝড় বয়ে গেছে প্রেক্ষাগৃহে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার মাঝে 'বিক্ষোভে' সরব হয়ে উঠেছে শ্রোতাদের মধ্যে বসে থাকা একাংশ। চিৎকার করে বলে উঠেছে, মিথ্যে বলছেন মমতা। কয়েক মিনিট চ্যাঁচামেচির পরে যখন ফের মাইক্রোফোন ধরলেন মমতা, ফিরে গেলেন গানের লাইনে! বললেন, 'একটা জনপ্রিয় গান আছে, ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই অ্যাম অন, ইউ উইল নো দ্যাট আই অ্যাম গন! ইউ ক্যান হিয়ার দ্য হুইসেল ব্লো এ হান্ড্রেড মাইলস...'
অর্থাৎ আমি যে ট্রেনে রয়েছি আপনি সেটি মিস করেছেন, তাই আপনি জানতে পারবেন না যে আমি চলে গেছি; আপনি শুনতে পাচ্ছেন একশো মাইল দূরের বাঁশির আওয়াজ!
খানিক থেমে বিদ্রুপের সুরে মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, 'ইউ হ্যাভ লস্ট ইয়োরসেলফ, ইউ হ্যাভ লস্ট ইয়োরস ক্রেডেনশিয়াল, বাট মাই ক্রেডেনশিয়াল ইজ ওনলি অল অফ ইউ!' অর্থাৎ আপনি আপনার যোগ্যতা হারিয়েছেন, কিন্তু আমার যোগ্যতা রয়েছে মানুষের সঙ্গে আছি বলে!
Mamata Banerjee Oxford | অক্সফোর্ডে মমতা, রাম-বামকে কটাক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর#mamatabanerjee #oxford #london #kellogcollege #tmc pic.twitter.com/bQwUX05Juz
— The Wall (@TheWallTweets) March 27, 2025
তিনি বুঝিয়ে দিলেন, অক্সফোর্ডের মঞ্চে বক্তৃতা করার সময়ে বিরোধীদের প্রশ্ন ও চিৎকারের মুখে তিনি পড়লেন, তাতে ক্ষতি আসলে উল্টো দিকেরই হল। এসব করে তাঁকে খাটো করা দূরের কথা, আদতে তিনি কারও ধরাছোঁয়ার মধ্যেই এলেন না। তিনি এসবের ঊর্ধ্বে উঠে, পোড়খাওয়া রাজনীতিকের মতোই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বললেন, 'মাথা নত করতে হলে মানুষের কাছে করব।' এরপরই রবি ঠাকুরের কবিতা আউড়ে বললেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...’ আরও বললেন, 'হিংসা, আক্রোশ নয়, যুদ্ধের পৃথিবীকে জয় করা যায় শান্তি দিয়ে।'
এদিন বিকেলে অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে মিনিট চল্লিশ এগিয়ে যাওয়ার পরে, আচমকা শ্রোতাদের একাংশের বিরোধিতার মুখে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। আচমকা এ রাজ্যে টাটার বিনিয়োগ না করার প্রসঙ্গ ওঠে। ওঠে আরজি কর প্রসঙ্গও। রীতিমতো চ্যাঁচামেচি, বিশৃঙ্খলা শুরু হয় শ্রোতাদের একাংশের মধ্যে। কেউ কেউ সরাসরি দাবি করেন, তথ্যে গলদ রয়েছে, কেউ আবার হিন্দু ধর্মের কল্যাণের কথাও তোলেন। এদিন যাঁরা এসব করে এই সমস্যা তৈরি করলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখে স্পষ্টতই হিন্দুত্ববাদ ঘেঁষা বলে মনে হয়েছে, আবার কিছু বাম ও অতিবাম মনস্ক লোকজনও ছিলেন।
আরজি কর নিয়ে তাঁদের বিক্ষোভের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। ফলে এ নিয়ে বলা ঠিক হবে না। একই সঙ্গে বলেন, 'এই মঞ্চকে রাজনীতির মঞ্চে পরিণত করবেন না। প্রয়োজন হলে বাংলায় এসে দেখে যান, আমি মিথ্যে বলছি না।'
এ পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা মাথাতেই পরিস্থিতি সামলাতে থাকেন মমতা। এমনকি তিনি বারবার 'ভাই' বলে সম্বোধন করেন বিক্ষোভকারীদের। শান্ত হতে বলেন নরম অথচ দৃঢ় স্বরে। বলেন, 'আপনারা তো নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেও অসম্মান করছেন। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু এখনও বিনম্র রয়েছি। এমন আচরণ করবেন না।'
বস্তুত, এমনটা যে হতে পারে, তার খানিক আন্দাজ তো আগেই ছিল। গতকাল, বুধবারই মমতা বলেছিলেন, এদিনের মঞ্চে এলোপাথাড়ি বল এলে ব্যাট চালাবেন। বাস্তবে হলও তাই। বিরোধী দলনেত্রী থাকাকালীন কীভাবে তাঁর ওপর হামলা করা হয়েছিল, সেই ছবি তুলে ধরে প্রশ্নকর্তাদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'এখানে মিথ্যে কথা বলে আমাকে অপমান না করে, বাংলায় গিয়ে নিজেদের দলকে শক্তিশালী করুন। গণতান্ত্রিকভাবে লড়াই করুন।'
একসময়ে, অত ঝামেলার মাঝেও, রীতিমতো মজার স্বরে মুখ্যমন্ত্রী বলতে থাকেন, 'আমি খুশি, আমি ফিরে গিয়ে তোমাদের মিষ্টি পাঠাব, তোমাদের এই আদর্শের জন্য। কতিপয় মানুষ ইচ্ছে করে ঝামেলা পাকাচ্ছো।'
কিছুক্ষণ গোলমালের পরে মাইকের সামনে মুখ্যমন্ত্রী ফের শান্ত স্বরে ধৈর্য ধরে বলেন, 'ওরা আমাকে মিস করছে, তাই এমনটা করল।' এর পরেই হান্ড্রেড মাইল গানটার কথা উল্লেখ করেন মমতা।
শুধু তাই নয়, রাম-বাম বিরোধিতাকে সপাটে উড়িয়ে কার্যত মুখের ওপর জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'এবার থেকে চেষ্টা করব প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠানে আসতে। আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানি। আমি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নই।'
Mamata Banerjee Oxford | আমি বেঙ্গল টাইগার, আমাকে এভাবে আটকাতে পারবে না#MamataBanerjee #MamataBanerjeeOxford #Oxford #London #Tmc pic.twitter.com/44hGlKBSxi
— The Wall (@TheWallTweets) March 27, 2025
এসবের পরে কে বলবে, খানিকক্ষণ আগেই সভাস্থলে এমন তুমুল বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। প্রসঙ্গত, এদিন দিদির বক্তৃতা শুনেছেন বাংলার দাদাও, অর্থাৎ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকেও তো খেলার মাঠে কত সময় কত বাউন্সারই না সামাল দিতে হয়েছে। কিন্তু অক্সফোর্ডের মঞ্চে এদিনের বাউন্সার যে আরও কড়া ছিল, তা বলাই বাহুল্য। সেখানে মমতা রীতিমতো ছক্কা হাঁকিয়েছেন বলা যায়। দিদির ব্যাটিং দেখে দাদা কী বললেন, তা অবশ্য জানা যায়নি এখনও!
সব শেষে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অক্সফোর্ড-কর্তার প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল। শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী শুধরে দিলেন, 'আমাকে মুখ্যমন্ত্রী নয়, নাম ধরে ডাকুন।' উত্তর এল, দিদি বলে ডাকব? নাকি মমতাজি! মুখ্যমন্ত্রী বললেন, 'কোনও জি নয়, শুধু মমতা।'
সভার সাময়িক বিশৃঙ্খলার জন্য ক্ষমা চাইলেন সঞ্চালকরা। একই সঙ্গে জানতে চাইলেন, প্রশাসন, দল সামলেও ১৩০টি বই লেখা, এত অফুরন্ত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পান? জবাবে মমতা মা-মাটি মানুষের স্লোগান আউড়ে বলেন, 'মা মানে আম্মা, মাটি মানে সয়েল আর মানুষ মানে পাবলিক, জনতা।' বললেন, 'আমি শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়া মানুষের বঞ্চনার প্রতিবাদে লড়াই করছি। সেখান থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার শক্তি পাই। মানুষ দুঃখ পেলে আমি দুঃখ পাই, মানুষ আনন্দ পেলে আমিও আনন্দ পাই।' রসিকতার সুরে এও বললেন, 'মাই টাইটেল ইজ ব্যানার্জী, অপোজিট অফ এনার্জি।'
মনে করিয়ে দিলেন, তিনি জ্যোতিষী মানেন না। বললেন, 'আমি মনে করি, তুমি কীভাবে কাজ করতে চাইছ, সেটাই বড় কথা। নেগেটিভিটি রাখা চলবে না, সব সময় নিজেকে পজিটিভ রাখতে হবে। এটার ওপরই সবটা নির্ভর করে। থেমে গেলে চলবে না। লড়াইয়ের মাধ্যমেই টিকে থাকতে হয়। ভুল হলে ভুল শুধরে নিতে হয়। মানুষই আমার শক্তি। মানুষই আমার আস্থা।'