মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: 29th January 2025 15:21
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘পুড়ে ছাই বাড়ি, গাড়ি নিয়ে আমি ভাবছি না। কিন্তু আমার সংগ্রহের জিনিসগুলোর কী হবে? কোনও বিমা সংস্থা কি তার ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে?’—লস এঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানলে কার্যত নিঃস্ব হয়ে গেছেন তিনি। জীবনের সঞ্চয়, অর্জিত সম্পত্তি চোখের সামনে ভস্মীভূত হতে দেখেছেন। তবু অন্তরের খেদ বলে যদি কিছু থাকে, সেটা রত্নপেটিকার দুর্মূল্য কিছু সংগ্রহ চিরতরে হারিয়ে ফেলা।
আমেরিকা প্রবাসী অশীতিপর ক্যান্সার চিকিৎসক মদনগোপাল মুখোপাধ্যায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর অমূল্য ভাণ্ডার। অবনীন্দ্রনাথের ছবি থেকে শুরু করে কোম্পানি আমলের চিত্র, এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম সম্পাদক জেমস প্রিন্সেপের সই করা জার্নাল থেকে জওহরলাল নেহেরুর স্বাক্ষরিত বই। পলকের মধ্যে ছাই হয়ে গেছে সবই। আর হাওয়ায় উড়েছে রবীন্দ্রসৃষ্টিভাণ্ডার! ‘গীতাঞ্জলি’র হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, কথিকা গ্রন্থ ‘লিপিকা’র ‘ঘোড়া’ রচনার অনুবাদ (দ্য হর্স), ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’ গানের হাতেলেখা তরজমা—সমস্তকিছু খুইয়ে ফেলেছেন মদনগোপালবাবু।
১৯৬৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক। পরের বছরই আমেরিকা চলে আসেন মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার বেকার্সফিল্ডে থাকা শুরু করেন। তাঁর নামে একটি রাস্তাও রয়েছে সেখানে। ২০১৩ সালে বাসা বদলে চলে আসেন আল্টাডেনায়। নিজের হাতে গড়ে তোলেন দোতলা বাড়ি। ছবির মতো সাজানো, সুন্দর। আগ্রাসী আগুনে সেই বাড়ি, লন, দামি গাড়ি সবকিছু পুড়ে খাক। পাসপোর্ট, জমির দলিল, সামান্য টাকা… হাতের নাগালে যা পেয়েছেন, তাই নিয়ে প্রাণ হাতে সস্ত্রীক বেরিয়ে আসেন তিনি। একটি গাড়ি গ্যারেজের বাইরে দাঁড় করানো ছিল বলে কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন।
কী কী চিরতরে হারিয়ে ফেলেছেন তার তালিকা আর মনে রাখতে চান না মদনগোপালবাবু। শুধুই বই বা পোস্টকার্ড নয়, তাঁর সংগ্রহে ছিল পাল-গান্ধর্ব সময়ের ভাস্কর্য, ইন্দো-আর্য যুগ, মুঘল আমলের মুদ্রা, কলকাতার প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য ম্যাপ, যামিনী রায়, বিকাশ ভট্টাচার্য, মকবুল ফিদা হোসেনের ছবি। এই সম্পদ-সামগ্রী নিয়ে সান ফ্রান্সিসকোর একাধিক ইন্সটিটিউট আয়োজন করত শিল্প প্রদর্শনীর। শুধুমাত্র দুষ্প্রাপ্য রবীন্দ্ররচনার সংকলন নিয়ে আলোচনা সভা বসত স্থানীয় মিউজিয়ামে। পেশায় মারণরোগে আক্রান্তদের শারীরিক যন্ত্রণার উপশম করে রাতে বাড়ি ফিরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানেই আশ্রয় খুঁজে নিত মদনগোপালবাবুর বিক্ষত মন।
সাকুল্যে ১৭ মাস আমেরিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এসেছিলেন পাঁচবার। মার্কিন মুলুকে আসার আগেই এদেশে নাম ছড়িয়েছিল তাঁর। ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক কবিতা। যার একাধিক সংখ্যা মদনবাবুর সংগ্রহে ছিল। ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘পার্সোনালিটি’ বইয়ের প্রথম সংস্করণের সই করা কপি, ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ গানের অপ্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ। আগুনের গ্রাসে পুড়েছে সবই।
এই দুঃসহ শোকের আবহেও একমাত্র সান্ত্বনা জুগিয়েছেন তাঁর ছেলে। সংগৃহীত সমস্ত বইয়ের ক্যাটালগ একা হাতে তৈরি করেছিলেন তিনি। কিছুই অবশিষ্ট নেই, অবশেষ হয়ে ধুলোয়-বাতাসে মিশে গেছে। কিন্তু কী কী ছিল, তার স্মরণিকা আজও হাতে নিতে পারবেন মদনগোপালবাবু। স্মরণে ভেসে উঠবে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা মুক্তাক্ষর আর স্মৃতির সম্পুটে গুঞ্জরিত হবে হারিয়ে ফেলা গানের দুটি কলি—‘হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়/ বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার যা কিছু সঞ্চয়।‘