শেষ আপডেট: 1st April 2024 20:52
সে এক রহস্যময় গুহা! 'ওয়েন ম্যানর'-এর প্রাসাদোপম বাড়ি থেকে অতি সন্তপর্ণে গোপন নানা অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে পৌঁছতে হয় সেখানে। নিঃসঙ্গ ওয়েন প্রাসাদের দায়িত্ব সামলায় বুড়ো বাটলার আলফ্রেড। এদিকে প্রাসাদের তলায় ওই গোপন ডেরাতেই রয়েছে গথাম শহরের রক্ষাকর্তা, ওয়েন প্রাসাদের বিপুল সম্পত্তির অধিপতি ব্রুস ওয়েন ওরফে "ব্যাটম্যান"-এর রুদ্ধশ্বাস নানা কার্যকলাপের 'হেডকোয়ার্টার'! যার নাম "ব্যাটকেভ" বা বাদুড় গুহা!
মার্কিন কমিক সিরিজ 'ব্যাটম্যান'-এর ভক্তমাত্রেই "ব্যাটকেভ"-এর এই বর্ণনা জানেন। ছোট্টবেলা থেকে বড়বেলাতে এসেও অনেক ডিসি-প্রেমীর মনে হয়, যদি একবার গথামের সেই বাড়িটি দেখা যেত! বা যাওয়া যেত সেই ব্যাটকেভে! কিন্তু বিধি বাম। নিউ জার্সির অন্যতম বড় শহর গথাম তো আর বইয়ের পাতার বাইরে বাস্তবে নেই। শিল্পী বব কেন ও বিল ফিঙ্গারের অতুল কীর্তিকে তাই দেখা যায় ওই কল্পনাতেই—গল্পে অথবা সিনেমায়!
তবে যদি আপনি সত্যি করে ওই ব্যাটকেভ দেখার আশ মেটাতে চান, তাহলে উপায় কিন্তু আছে। আপনাকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে হলিউডে যেতে হবে না। উপায় ঘরের কাছেই আছে! নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর— পোখরাতে।
এক হিসেবে পোখরা নেপালের দ্বিতীয় অলিখিত রাজধানী। শহরের কোল ঘেঁষে আছে একাধিক হ্রদ। ফেওয়া হ্রদ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এদিকে শহরের উত্তর আকাশ ঘিরে চব্বিশ ঘন্টা সজাগে পাহারা দেন অন্নপূর্ণা —পৃথিবীর দশম উচ্চতম শৃঙ্গ! তাঁর সঙ্গী একদিকে ধবলগিরি, বিশ্বের সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ, অন্যদিকে মৎস্যপুচ্ছ, আরেক তুষারধবল গিরিরাজ। কাঠমাণ্ডুর চাইতে ৮০০ মিটার নিচে হলেও স্রেফ প্রকৃতির খেয়ালে পোখরার আবহাওয়া অতি মোলায়েম থাকে বছরভর। শীতে কাহিল করে না, গরমেও আইঢাই ভাব থাকে না।
পোখরা শহরটা রয়েছে বস্তুত এক সুবিশাল উপত্যকায়। যার বেশিরভাগটাই চুনাপাথর, শেল, ডলোমাইট বা বেলেপাথরের মত নরম শিলায় তৈরি। শ্বেতী গণ্ডকী নদী এই শহরের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। মিশেছে ত্রিশূলীতে। সেই ত্রিশূলী আবার গিয়ে মিশেছে গণ্ডক নদীতে, যা বিহারে গিয়ে মিশেছে গঙ্গায়। এই শ্বেতী গণ্ডকী নদী পোখরায় এক প্রধান পর্যটক-আকর্ষণ৷ বস্তুত, শহরে ঘুরলে চট করে নদী চোখেই পড়বে না। কিন্তু বিশেষ ভাবে বানানো একটা পার্কে ঢুকে পাথুরে রাস্তায় খানিক নিচে নামলে দেখতে পাবেন, এক বিশাল, খাড়াই গিরিখাতের তলায়, অন্তত আড়াইশো ফুট গভীরে তীব্র বেগে বয়ে চলেছে সে।
পোখরা শহরের ভূতাত্ত্বিক অবস্থাটা কতটা নড়বড়ে, এই গিরিখাতটা দেখলে খানিক টের পাবেন। এরই অন্য প্রমাণ শহরের বেশ কিছু পর্যটকদের দেখার মত গুহা। প্রায় সবক'টা গুহাই চুনাপাথর ক্ষয়ে তৈরি। যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল তিনটি— গুপ্তেশ্বর শিবের গুহা মহেন্দ্র গুহা আর বাদুড় গুহা! গুপ্তেশ্বর শিবের গুহা এরমধ্যে সবচেয়ে বড়। বলা হয়ে থাকে, এটিই নাকি নেপালের বৃহত্তম গুহা! সিঁড়ি ভেঙে নিচে প্রথমে একটা চাতালে এসে নামতে হয়, তারপর পাকদণ্ডীর মত সরু রাস্তা গুহার পাথরের ফাঁক গলে চলে যায় একেবারে নিচে, যেখানে তীব্র বেগে ঝরে পড়ছে দেবী জলপ্রপাত! মহেন্দ্র গুহাও মন্দ নয়, তবে স্ট্যালাগমাইট বা স্ট্যালাগটাইটের কিছু আর নেই। সম্ভবত বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি নীরব শিকার হয়েছেন তাঁরা।
তবে সবচেয়ে রহস্যময় নিঃসন্দেহে বাদুড় গুহা। মহেন্দ্র গুহা থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ এই গুহা। পোখরার যে কেউ চেনেন। প্রথমে ঠিক ঠাহর হবে না। পার্কের মত সাজানো প্রবেশপথ। টিকিট কাটতে হয়৷ ঢোকার মুখেই কেয়ারটেকার একটা টর্চ ধরিয়ে দেবেন। শান বাঁধানো সুসজ্জিত সিঁড়ি নেমে গিয়েছে পাথরের গায়ে ছোট্ট একটা খোঁদলের মত গুহা-মুখে। সেই সরু, পাথুরে, নিকষ কালো অন্ধকার মুখ দিয়ে প্রায় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে ঢুকতে হয়। একটু বেসামাল হলেই পাথরে ঘষা খেতে পারেন! অন্ধকারে টর্চের আলো, মোবাইকের ফ্ল্যাশ জ্বেলেও শুরুতে কিছুই ঠাহর হবে না। একটা আদিম, বন্য গন্ধ পেতে পারেন। সঙ্গে স্যাঁতসেঁতে ভাব, চুনাপাথর চুঁইয়ে জলের ফোঁটা এসে গায়ে লাগবে।
ওই পাথুরে মুখটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই বুঝবেন, চমক অপেক্ষা করছে! হঠাৎই ভেতরে প্রশস্ত খোলা একটা গুহার চাতাল নজরে আসবে। এবড়োখেবড়ো, সাবধানে নামতে হয়৷ কিন্তু নেমে খানিক দম নিয়ে টর্চের আলো গুহার ছাতে ফেললেই দেখবেন, সার দিয়ে অন্তত কয়েক হাজার বাদুড় ঝুলে রয়েছে ওপরে! বেশিরভাগই ঘুমন্ত। কয়েকটি হয়ত উড়ছে! বাকিরা নিশ্চল, নীরব... ঝুলে আছে একেবারে আপনার মাথার ওপর!
দিনের আলো কমে এলেই বাদুড় গুহায় ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। কাউন্টার গুটিয়ে চলে যান কর্মীরা। তারপর রাত নামলেই ওই সরু গুহামুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড়। বলছিলেন গুহার এক কর্মী। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম মহাগুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বাদুড়রা পোখরা উপত্যকার জঙ্গলেই শিকার ধরে বেড়ায়। পর্যটকদের বিস্তর উৎপাত সত্ত্বেও তারা গুহা থেকে নিজেদের ঠাঁইনাড়া করতে চায়নি।
যদিও উষ্ণায়ন যেভাবে সব কিছুর অদলবদল করে ফেলছে, তাতে এ'হেন বাদুড় গুহা কতদিন বাদুড়দের জন্য সুরক্ষিত থাকবে, জানা নেই। তবে, ব্রুস ওয়েনের দেখা না পেলেও, ক্রিস্টোফার নোলানের ছবির সেটকেও কিন্তু হার মানাতে পারে বাস্তবের এই বাদুড় গুহা!