শেষ আপডেট: 3rd January 2025 13:58
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সিরিয়ায় (Syria) ঢুকে ইরানের (Iran) অর্থে সুসজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির একটি গোপন কারখানা (Missile Manufacturing Facility) কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ ও ছবি প্রকাশ করেছে ইজরায়েল বিমানবাহিনী (IAF)। যাতে দেখা গিয়েছে, মাত্র ১২০ জন ইজরায়েলি কমান্ডো হানা দিয়ে ওই কারখানাকে নষ্ট করে দেয়। ওই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন মেনি ওয়েজ (Operation Many Ways)। গত ২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ওই হানাদারি চালায় ইজরায়েলি বিমানবাহিনী।
পশ্চিম সিরিয়ার বিমান বহরের শক্তিশালী ঘাঁটি এলাকা মাসিয়াফ-এর কাছে ডিপ লেয়ার নামে ওই কারখানাটি ছিল। ইজরায়েলের দাবি, এই অত্যাধুনিক ও দামি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানাটি ইরানের প্রত্যক্ষ অর্থ মদতে গড়ে উঠেছিল। ইরানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটাই সিরিয়ায় গড়ে তোলা তেহরানের (Tehran) প্রথম প্রকল্প। এর লক্ষ্য ছিল, তৈরি করা ক্ষেপণাস্ত্র লেবাননের (Lebanon) হিজবুল্লা (Hezbollah) এবং সিরিয়ার আসাদ সাম্রাজ্যের (Assad Regime) হাতে তুলে দেওয়া। এই অভিযানে ইজরায়েলি কমান্ডো বাহিনীর একজন জওয়ানও সামান্য জখম হয়নি।
ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা
ইজরায়েল বিমানবাহিনীর দাবি, ২০১৭ সালের শেষার্ধে ইরান এই কারখানা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। দক্ষিণ সিরিয়ার জামরায়া-য় সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের রকেট ইঞ্জিন তৈরির কারখানায় বিমানহানার পরেই ইরান এই মাটির নীচে ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাটি তৈরির কাজে হাত লাগায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইজরায়েলের নজর এড়িয়ে ভূগর্ভস্থ এই কারখানায় শক্তিশালী মারণাস্ত্র তৈরি করার। ২০২১ সালে মধ্যে একটি পাহাড়ের ৭০-১৩০ মিটার নীচে এই গোপন কারখানাটি নির্মাণ করে ফেলে ইরান। তখন থেকেই পুরোদমে এখানে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হতে থাকে।
ইজরায়েল বিমানবাহিনী জানিয়েছে, অশ্বখুরাকৃতি এই কারখানাটিতে ঢোকার মূল তিনটি প্রবেশপথ ছিল। একটি দিয়ে কাঁচামাল প্রবেশ করত। আর একটি দিয়ে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র বের করা হতো। তৃতীয়টি দিয়ে অন্য পণ্যবাহী গাড়ি ও দফতরের কর্মীরা ঢুকত-বেরত। কারখানায় ১৬টি হলঘরের মতো কারখানা ছিল। যার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্রের খোল তৈরি, রকেট জ্বালানি মিশ্রণ এবং রং করার সুবিধা ছিল। ইজরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (IDF) অনুমান, বছরে এই কারখানা থেকে ১০০-৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হতো। যার মধ্যে ৩০০ কিমি পাল্লার অস্ত্রও ছিল।
ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকেও এই কারখানার অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ইজরায়েল উত্তর সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ কিমি এবং সিরিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে মাত্র ৪৫ কিমি দূরে ছিল। যাতে সহজেই অস্ত্র হিজবুল্লাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়।
অভিযানের প্রস্তুতিপর্ব
কয়েক বছর ধরে নজরদারি ও গুপ্তচর তথ্যের ভিত্তিতে হানাদারির পুরো ছক কষা হয়। তবে চূড়ান্ত পরিকল্পনা রূপ পায় ২০২৪ সালের গোড়ার দিক থেকে। এই কাজের জন্য ইজরায়েলের সবচেয়ে দুরস্ত শালডাগ কমান্ডো বাহিনীকে বাছাই করা হয়। এই বাহিনী দেশের বাইরে হানাদারিতে সুদক্ষ। তাদের সঙ্গে নেওয়া হয় ৬৬৯ ইউনিটকে। এই ইউনিট হলে কমব্যাট যুদ্ধে পারদর্শী ও সুকৌশলী। প্রায় ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে তাদের প্রশিক্ষণ চলে গোপনে। তার আগেই গুপ্তচর মারফত সিরিয়ার বিমানঘাঁটির ক্ষমতা, কারখানার মানচিত্র, কর্মী সংখ্যা ও অন্যান্য বিপদ বুঝলে কী করা হবে, সে সম্পর্কে নিখুঁত নকশা তৈরি করা হয়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
অভিযান শুরু হয় সিএইচ-৫৩ ব্যাচের ইয়াসুর নামে ভারী পণ্যবাহী হেলিকপ্টারে। তাতে পাঠানো হয় বাছাই করা ১০০ শালডাগ কমান্ডো এবং ২০ জন ৬৬৯ ইউনিটের ২০ জন চিকিৎসায় পারদর্শী কমান্ডোকে। এরসঙ্গেই রওনা দেয় এএইচ-৬৪ নামে অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ২১টি ফাইটার জেট, ৫টি ড্রোন এবং ১৪টি উদ্ধারকারী বিমান। সিরিয়ার রাডারের চোখে ধুলো দিতে সবগুলি একসঙ্গে ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে রওনা দেয়।
সিরিয়ার আকাশপথে ঢোকার পর হেলিকপ্টারগুলি অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড়তে থাকে, যাতে আকাশপথে হানাদারি রোধে ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে না আসে। কমান্ডোদের নামার সময় দিতে ইজরায়েলি বাহিনী সিরিয়ার অন্যত্র বোমা মারতে শুরু করে। যাতে সেদিকেই নজর ঘুরে যায় সিরিয়ার। অবশেষে হেলিকপ্টারগুলি কারখানার একটি প্রবেশপথের কাছে অবতরণ করে। কমান্ডোরা নেমে গেলেও ৬৬৯ ইউনিটের জওয়ানরা কপ্টারেই থেকে যায়, কভারের জন্য।
ভিতরে ঢুকে কমান্ডোরা কারখানা ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ৬৬০ পাউন্ডের বিস্ফোরক লাগিয়ে দেয়। তারপর নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর রিমোটের সাহায্যে বিস্ফোরক ফাটিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় এক টনের বিস্ফোরক একসঙ্গে ফাটায় স্থানীয়ভাবে ভূমিকম্পের মতো মাটি কেঁপে ওঠে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগে জমিতে। মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে গোটা অপারেশন সেরে ইজরায়েলি কমান্ডো ঘরে ফেরার জন্য রওনা দেয়। এই অভিযানে আনুমানিক ৩০ জন সিরীয় নিরাপত্তা রক্ষী ও সেনার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি ইজরায়েলের। যদিও সিরিয়ার পাল্টা দাবি, ১৪ জনের মৃত্যু ও ৪৩ জখম হয়েছিল ওই অভিযানে।