শেষ আপডেট: 19th February 2025 12:38
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২৫০ বছরের পুরনো রাজধানী শহর তেহরান আর থাকছে না ইরানের রাজধানী। সরে যেতে পারে দক্ষিণের উপকূলীয় মাকরান অঞ্চলে। একে দুশ' বছরের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, তার ওপর পানীয় জল ও বিদ্যুতের ঘাটতি। সমস্যার সমাধান হিসেবে রাজধানী সরিয়ে নেওয়াই বিকল্প মনে করছে বর্তমান ইরান সরকার।
ইতিহাসের এক জীবন্ত উপাখ্যান তেহরান। বহু ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভূমি মরুর বুক চিরে জেগে ওঠা ৭৩০ বর্গকিলোমিটারের এ শহর। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পারস্য উপসাগরীয় ও আরব অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ইরানের রাজধানী নগরী। ১৭৮৬ সালে কাজার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে যাত্রা শুরু তেহরানের। ককেশাস অঞ্চলে ইরানি ভূখণ্ডের কাছাকাছি বলে তেহরানকে রাজধানী নগরী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কাজার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শাসক আগা মহম্মদ খান। মতান্তরে তেহরান ১৭৯৬ সালে কাজার রাজবংশের আমলে রাজধানী হয়। এটি ইরানের ৩২তম জাতীয় রাজধানী। ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং তেলের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
সেই বহু ইতিহাসের সাক্ষী তেহরান থেকে ২৩৯ বছর পর রাজধানী সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে ইরান সরকার। এক কোটি ৬৮ লাখ মানুষের তেহরান মহানগরী ইরান ও পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। রাজধানীকেন্দ্রিক জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জেরে নগরের প্রাণ নিভুনিভু। ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমি মোহাজিরানি বলেন, রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়টি নতুন নয়। বরং এ নিয়ে আলোচনা চলছে তিন দশকের বেশি সময় ধরে। প্রতিটি অঞ্চলে বসবাসযোগ্যতা নির্ভর করে সেটি কতদূর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা সম্ভব, তার ওপর। তেহরানের ওপর ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার চাপ ভীষণ উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় ২৫০ বছরের জনসংখ্যার ভারে জীর্ণ তেহরানে খাবার জল ও বিদ্যুতের মতো মৌলিক পরিষেবার অবস্থা সঙ্গীন। সমস্যার সমাধান হিসেবে রাজধানী সরিয়ে নেওয়াই বিকল্প মনে করছে ইরান সরকার। তেহরানের পর নতুন রাজধানী নিশ্চিতভাবেই হবে দক্ষিণের কোথাও। প্রাথমিকভাবে উপকূলীয় মাকরান অঞ্চলের কথা ভাবছে ইরান সরকার। ফাতেমি মোহাজিরানি বলেন, মাকরানের কথা আমরা ভাবছি। দু'টি পরিষদ আমরা গঠন করেছি। একটি পরিষদ রাজধানীর সম্ভাব্য সব সমস্যা পর্যালোচনা করছে। আরেকটি পরিষদ কাজ করছে সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর। দু'টি পরিষদই মাকরান অঞ্চলে সকল সম্ভাব্যতা যাচাই করছে।
রাজধানী স্থানান্তরের ঘটনা ইরানের ইতিহাসে অবশ্য নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬৭৮ সাল থেকে পারস্য নামে পরিচিত ইরানের ৩২তম রাজধানী তেহরান। তাৎক্ষণিকভাবে না হলেও অচিরেই ৩৩তম রাজধানী পেতে যাচ্ছে ২৬০০ বছরের পুরনো দেশটি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, জলের অভাব ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে (Change of Capital City) ইরান তাদের বর্তমান রাজধানী তেহরান থেকে দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকা মাকরান অঞ্চলে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে। সম্প্রতি ইরানের এক সরকারি মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন।
ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের মাকরান অঞ্চল ওমান উপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকা এখনও সম্পূর্ণভাবে ব্যবহৃত হয়নি। এটি বাণিজ্য ও সমুদ্রপথে যোগাযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, যা তেহরানের উপর অর্থনৈতিক চাপ কমাবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান তেহরান স্থানান্তরের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ থেকে কাঁচামাল পরিবহণ করে তেহরানে প্রক্রিয়াকরণ এবং তারপর রফতানির জন্য আবার দক্ষিণে ফেরত পাঠানো আমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস করে।
তবে সমালোচক আলি গোলহাকি বলেন, আজাদি স্টেডিয়াম পুনর্নির্মাণ করতে ১৮ মাস সময় লাগে এবং খরচ হয় ১৯ ট্রিলিয়ন রিয়াল (২৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার)। তবে রাজধানী স্থানান্তর করতে শতাব্দী লাগবে এবং খরচ হবে শত শত বিলিয়ন ডলার। তেহরানের জনসংখ্যা আগামী ৩০ বছরে ২০ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেতে পারে, যা শহর চালানোর ক্ষেত্রকে অসম্ভব করে তুলবে। বায়ু দূষণ তেহরানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ২০২২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানায়, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ২০,৮০০ জন মারা যায়, যার মধ্যে ৬,৪০০ জন তেহরানে। এছাড়াও, তেহরান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। শহরের ৬০ শতাংশ বাড়ি ভূমিকম্পের মানদণ্ড পূরণ করে না। এছাড়াও, তেহরানের মাটি প্রতি বছর গড়ে ২৫ সেন্টিমিটার ধসে পড়ছে। তাই নানান কারণে পারস্য রজনীর পাতায় পাতায় রঙে, সুবাসে, আতর ও সুরার মাদকতায় ঢালা তেহরান হয়তো এবার নিজেই কাহিনির অক্ষর হয়ে যাবে।