শেষ আপডেট: 12th October 2023 11:28
আট বছর আগের ঘটনা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ততদিনে এক বছরও হয়নি। তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, কূটনীতিতে মোদীর পরম বন্ধু হতে চলেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বেঞ্জামিন আকা বিবি চরম দক্ষিণপন্থী নেতা। মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর নভেম্বরেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংকে ইজরায়েলে পাঠিয়েছিলেন মোদী। অনেকে দাবি করেন, বিবি-মোদী সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল তারও আগে। যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী।
এহেন মোদী ফেব্রুয়ারি (২০১৫ সাল) মাসের শেষ নাগাদ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন, ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে তিনি যেন তেল আভিভ সফরে যান। তার আগে অন্তত কুড়ি বছরে ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ইজরায়েল যাননি। ২০০৮ সালে এপিজে আবদুল কালাম ইজরায়েলে গেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না তিনি।
সে সময়ে দিল্লিতে সাংবাদিকতা করি। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে জানতে পারি, প্রণব পত্রপাঠ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সাউথ ব্লককে পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু ইজরায়েল সফরে তিনি যাবেন না। একই সফরে যদি তাঁর প্যালেস্তাইন যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তবেই যাবেন। ৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। যার শিরোনাম ছিল, ‘শুধু ইজরায়েল কেন, মোদীকে না প্রণবের।’
সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হতে তুমুল হইচই হয়েছিল দিল্লির কূটনৈতিক বৃত্তে। শেষমেশ প্রণবের যুক্তি মেনে নেন মোদী। সে বছর অক্টোবরে একই সফরে জর্ডন, প্যালেস্তাইন, ইজরায়েলে গিয়েছিলেন প্রণব। তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগও হয়েছিল আমার।
প্রণবের বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট। স্বাধীনোত্তর সময়ে নয়াদিল্লি বরাবর ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন প্রশ্নে কূটনৈতিক ভারসাম্য রেখে চলেছে। দিল্লিতে প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) দফতর খুলতে সাউথ ব্লক শুধু অনুমতিই দেয়নি, আরব গোষ্ঠী বহির্ভূত ভারতই প্রথম দেশ, যে প্যালেস্তাইনকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধী ও পরবর্তী কালে রাজীব গান্ধীর সময়ে ইয়াসের আরাফত এ দেশে কতবার এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। ভারতে অতি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন আরাফাত। আবার তার পাশাপাশি ইজরায়েলের সঙ্গে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্কও রক্ষা করে চলেছিল নয়াদিল্লি। মনমোহন জমানাতেও তাতে ত্রুটি ছিল না। প্রণবের মতে, এই ভারসাম্যের কূটনীতি সময় দ্বারা পরীক্ষিত। তাই এর থেকে বিচ্যুতি ঘটলে তার শরিকও হতে চাননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি।
প্রণবের ত্রিদেশীয় সফর শুরু হয়েছিল জর্ডন থেকে। আম্মান থেকে প্যালেস্তাইনের রামাল্লায় পৌঁছেছিলেন তিনি। প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল তাঁর। তারপর আল কুদ বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে তেল আভিভে পৌঁছেছিলেন রাষ্ট্রপতি।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, আম্মান থেকে প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল সফরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে নয়াদিল্লির অকৃত্রিম ভারসাম্যের বার্তা দিতে গিয়ে প্রণব বলেছিলেন, “ইজরায়েলের সঙ্গে আরও মজবুত সম্পর্কের পথে হাঁটলেও প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের পরম্পরাগত সমর্থন অবিচল এবং অটল রয়েছে।”
তারপর রামাল্লায় পৌঁছে মহম্মদ আব্বাসের সঙ্গে নৈশভোজের বৈঠকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের সহানুভূতি এবং প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধু সম্পর্ক আমাদের বিদেশ নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। প্যালেস্তাইন সম্পর্কে ভারতের নীতির তিনটি মূল বিষয় রয়েছে, প্যালেস্তাইনের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা; প্যালেস্তাইনের দাবির প্রতি সমর্থন; এবং, প্যালেস্তাইনের উন্নতিতে অংশীদারিত্ব”। (India's empathy with the Palestinian cause and its friendship with the people of Palestine have become an integral part of our foreign policy. India'spolicy on Palestine has three core dimensions: solidarity with the Palestinian people; support to the Palestinian cause; and, partnership in Palestine's nation and capacity building efforts.)
সেই পর্বের পর আট বছর কেটে গেছে। রাইসিনা পাহাড় থেকে আপত্তি তোলার মতো আর কেউ নেই। চলতি ইজরায়েল-হামাস সংঘাতে নয়াদিল্লির অবস্থানে তাই ক্রমশই ভারসাম্যের অভাব যেন প্রকট হচ্ছে। প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের জঙ্গি আক্রমণের নিন্দা করেছে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্র। নয়াদিল্লিও জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছে। সেই সঙ্গে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে দৃঢ় ভাবে তাঁর তথা ইজরায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু প্যালেস্তাইনের কথা একেবারেই অনুচ্চারিত থেকে গিয়েছে সাউথ ব্লকের বিবৃতিতে।
হামাস ইজরায়েলের উপর যে জঘন্য হামলা ও অত্যাচার চালিয়েছে তা অমানবিক, বর্বরোচিত। ভারতও বারবার সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছে। তাই জঙ্গি আক্রমণের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির স্বর চড়ানো স্বাভাবিক। কিন্তু হামাস মানেই তো গোটা প্যালেস্তাইন নয়। গত পাঁচ দিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বৃহত্তর ছবিটা একেবারেই ভুলে যাওয়ার মতোও নয়।
নিজভূমে বন্দি থাকার যন্ত্রণা, ইজরায়েলি আধিপত্যবাদ ও শাসনের চাপে অনিশ্চিত জীবনযাপন, ধর্মাচারে বাধা, প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণার সামিল। প্যালেস্তাইনের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যেন আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়ে রয়েছে। আল কুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তা টের পেয়েছিলেন প্রণবও। কেন তিনি প্যালেস্তাইন ঘুরে ইজরায়েলে যাচ্ছেন তা নিয়ে অভিমান-আন্দোলনে ফেটে পড়েছিলেন পড়ুয়া। প্রণবের সামনেই প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছিলেন তাঁরা।
প্যালেস্তাইনের মানুষের প্রতি নয়াদিল্লির সহানুভূতি ও একাত্মতা ছিল এই কারণেই। সেই সঙ্গে ছিল পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার তাগিদও। কারণ জ্বালানির জোগানের জন্য পশ্চিম এশিয়ার উপর নয়াদিল্লির নির্ভরতা রয়েছে।
নয়াদিল্লির এই সময়োত্তীর্ণ কূটনীতির শরিক ছিলেন বর্তমান বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। কূটনীতিক হিসাবে তাঁর কেরিয়ারের আগাগোড়া এই দর্শন মেনেই চলেছেন তিনি। কিন্তু জয়শঙ্কর বিদেশমন্ত্রী হওয়ার পরই এ যেন আমূল বদল।
অনেকের মতে, নয়াদিল্লির এই একপেশে অবস্থানের নেপথ্যেও নিখাদ রাজনীতি রয়েছে। হামাসের আক্রমণের সমালোচনা করে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত একেবারেই রাজনৈতিক। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট ও তারপর লোকসভা ভোট আসন্ন। হামাস-ইজরায়েল সংঘাতের ঘটনাকেও বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার করে নিয়েছে ভারতের উগ্র ডানপন্থীরা। নেতানিয়াহুর সঙ্গে যাঁদের আত্মার আত্মীয়তা।
ইজরায়েলের ঘরোয়া রাজনীতিতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কিন্তু ইদানীং খুবই সমলোচিত হচ্ছিলেন। দেশের বিচারব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে গিয়ে হাত পুড়েছে তাঁর। গণপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁর সরকারকে। সেই স্বৈরাচারী, চরম দক্ষিণপন্থী নেতাই এখন নয়াদিল্লির কাছের মানুষ। প্যালেস্তাইনের উপর দীর্ঘ অত্যাচারের কথা মনেও পড়ছে না। মেরুকরণের রাজনীতির কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লির সময়োত্তীর্ণ ভারসাম্যের কূটনীতি।