শেষ আপডেট: 17th October 2023 15:14
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শুধু ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড নয়, বিশ্বজুড়ে আধিপত্য কায়েম করতে চায় হামাস। গাজায় যুদ্ধের আবহে এমনই দাবি করেছেন, প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী।
১৯৮৭-র ১৪ ডিসেম্বর প্যালেস্তিনীয় নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল ‘হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া’ ওরফে হামাস। হামাস গঠনে ইয়াসিনের প্রধান সহযোগী ছিলেন আবদেল আজিজ আল-রানতিসি এবং মাহমুদ আল-জহর। ২০০৪ সালে ইজরায়েলের রকেট হামলায় ইয়াসিন এবং রানতিসি নিহত হন। প্রতিষ্ঠাতা তিন নেতার মধ্যে একমাত্র জহরই এখনও জীবিত রয়েছেন।
গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় হামাস গোষ্ঠী। শুধু ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে বোকা বানানোই নয়, একাধিক আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র হোয়াইট ফসফরাস বোমা থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা আয়রন ডোম নিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে হামাস। বিবিসির এক তদন্তমূলক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই আক্রমণের আগে নাকি ইজরায়েল-গাজা সীমান্তেই এক গোপন স্থানে প্রায় বছর দুয়েক প্রশিক্ষণ নিয়েছিল হামাস বাহিনী। তিলে তিলে নবীন যোদ্ধাদের তৈরি করেছিলেন হামাসের অনেক প্রবীণ ও শীর্ষ নেতারাই। ইজরায়েলের বিশ্বখ্যাত ধুরন্ধর গোয়েন্দা বাহিনীও টের পায়নি সে কথা। হামাসের সামরিক শাখা আল কাসিম ব্রিগেডের প্রধান মহম্মদ দেইফের নিখুঁত পরিকল্পনাতেই ইহুদিদের পবিত্র দিবস সিমহাত টোরায় গাজ় ভূখণ্ড থেকে নজিরবিহীন হামলার শিকার হতে হয়েছে ইজরায়েলকে।
এখন জেনে নেওয়া যাক হামাসের এই দুর্ধর্ষ বাহিনী তৈরির নেপথ্যে ঠিক কারা কারা রয়েছেন—
মহম্মদ দেইফ
১৯৬৫ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্ম। আসল নাম ছিল মহম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম মাসরি। হামাসে যোগদান ১৯৯০ সালে।যাযাবর জীবনযাপনের জন্য পরবর্তীকালে নাম হয় মহম্মদ দেইফ (দেইফ শব্দের অর্থ আরবি ভাষায় অতিথি)।
১৯৯৫ সাল থেকে ইজরায়েলি সেনা ও সামরিক বাহিনীর অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের জন্য ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম ওঠে দেইফের। ইজরায়েলে বিভিন্ন সময়ে নাশকতার মূল চক্রী ছিলেন এই মহম্মদ দেইফ। তাঁকে হত্যার চেষ্টাও কম হয়নি। গত দুদশকে মোট সাতবার হত্যার চেষ্টা হয় দেইফকে। প্রত্যেকবারই বেঁচে যান তিনি। ইজরায়েলি বাহিনীর এয়ারস্ট্রাইকে একটা চোখ, এক হাত ও এক পা হারান। তারপর থেকে হুইলচেয়ারেই বন্দি এই দুর্ধর্ষ জঙ্গি। প্রতিবন্ধী হয়েও হামাসের সমস্ত যুদ্ধ কৌশলের তিনিই নেতৃত্ব দেন বলে ইজরায়েলি গোয়েন্দাদের ধারণা।
ইজরায়েলি সেনা গাজা অবরুদ্ধ করার পরে গোপন আস্তানা থেকে হুঙ্কার দিয়েছেন দেইফ। তিনি বার্তা দিয়েছেন, ১৬ বছর ধরে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইজরায়েলি সেনাদের আক্রমণের পাল্টা ভয়ঙ্কর জবাব দেবে হামাস।
মারওয়ান ইসা
মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত এবং হামাসের সাংগঠনিক কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মারওয়ান ইসা। আল-দিন আল-কাসেম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার-ইন চিফ তিনিই। হামাসের যত আন্দোলন, সামরিক সাজসজ্জা সবকিছু পরিচালনার দায়িত্ব সামলান এই ইসাই।
মারওয়ান ইসাকে বলা হয় ‘ছায়া মানুষ’, কারণ তিনি প্রকাশ্যে আসেন না। অথচ হামাসের সমস্ত সামরিক কাজকর্মের নেপথ্য কারিগর তিনি। খুব কম বয়সে হামাসের কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে "প্রথম ইন্তিফাদা" চলাকালীন ইজরায়েলি বাহিনী তাকে আটক করে। গণঅভ্যুত্থানের পরে পাঁচ বছর ইজরায়েলের কারাগারে অত্যাচার সইতে হয়েছিল তাঁকে।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইসা আল-কাসসাম ব্রিগেডসের সামরিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তুখোড় মেধার ইসা একসময় ইজরায়েলি বাহিনীর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম লেখান। ইজরায়েলি সেনা সূত্র জানাচ্ছে, এই ইসা এতটাই চালাক যে তাকে কারাগারে বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। ঠান্ডা মাথায় যে কোনও নাশকতার নিখুঁত ছক কষতে পারেন তিনি। তাঁর বুদ্ধিতেই নাকি হামাস তাদের আস্তানা গোপন রেখে দীর্ঘ সময় ধরেই ইজরায়েলের উপর হামলা চালাতে পারছে।
২০০৬ সালে দেইফ এবং আল-কাসাম ব্রিগেডসের প্রধান নেতাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মীদের একটি বৈঠকের সময় ইজরায়েলিরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তিনি আহত হলেও পালিয়ে যান।
২০১৪ এবং ২০২১ সালে গাজা আক্রমণের সময় ইজরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো তাঁর বাড়িও দুবার ধ্বংস করেছি। সেই আক্রমণে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু হয়। কিন্তু ইসা বেঁচে যান। বহুবার চেষ্টা করা হলেও ইসার নাগাল কখনও পায়নি ইজরায়েলি সেনা।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার
গাজার লাদেন নামে পরিচিত। ইজরায়েল এই কুখ্যাত জঙ্গি নেতার খোঁজে একেবারে চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছে। মনে করা হচ্ছে গত ৭ অক্টোবর যে অতর্কিতে হামলা চালানো হয়েছিল তার পেছনে হাত ছিল এই হামাস নেতার। হামাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে পদমর্যাদায় দু’নম্বরেই এঁর স্থান।
২৪ বছর ইজরায়েলের জেলে বন্দি ছিলেন সিনয়ার। পরে ফিরে যান প্যালেস্তাইনে। ইজরায়েলি গোয়েন্দাদের ধারণা, হামস হামলার অন্যতম চক্রী ইনি। ইজরায়েলের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে নৃশংস হত্যালীলা চালানোর পেছনে এই সিনওয়ারেরই হাত রয়েছে। তাঁরই পরিকল্পনায় ১৪০০ ইজরায়েলির মৃত্যু হয়েছে।
১৯৬২ সালে জন্ম সিনওয়ারের। গাজার খান ইউনুসে তার বেড়ে ওঠা। সেটা তখন মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইজরায়েলি ফোর্স তাকে খান ইউনুসের ‘কসাই’ বলে ডাকে। একটা সময় সিনওয়ারের পরিবার আস্কেলন শহরে থাকত। পরে তারা গাজাতে চলে যায়। গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতন হয়েছিলেন সিনওয়ার।
১৯৮২ সাল থেকে ইজরায়েলের জেলে বন্দি ছিলেন সিনওয়ার। দুই ইজরায়েলি সেনা হত্যা করার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। আমেরিকা ২০১৫ সালে তাঁকে বিশ্বের ওয়ান্টেড জঙ্গিদের তালিকায় স্থান দেয়। সিনওয়ারের প্রধান কাজ ছিল নৃশংস হত্যালীলা চালানো এবং হামাস সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। গোটা বিশ্বের নানা জায়গা থেকে ফান্ড জড়ো করত সিনওয়ার। একাধিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধাপে ধাপে প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের শীর্ষ স্তরে পৌঁছন সিনওয়ার। ২০১৭ সালে হামাস অধিকৃত গাজ় ভূখণ্ডের সর্বোচ্চ শাসক নির্বাচিত হন তিনি।
আব্দুল্লাহ বারঘৌতি
কুয়েতে জন্ম ১৯৭২ সালে। ১৯৯০ সালে জর্ডনে চলে যান বারঘৌতি। জর্ডানের নাগরিকত্ব নেন এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং করেন। এই বারঘৌতি হামাসের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। অস্ত্রশস্ত্র, বোমা বানানোতে তিনি পটু।
বারঘৌতির আগে কাসাম ব্রিগেড দলের কেউই বিস্ফোরক বানাতে জানত না। এই দক্ষতার কারণে হামাস দলে উল্লেখযোগ্য পদ দেওয়া হয় বারঘৌতিকে। ডিটোনেটর তৈরির পাশাপাশি বিষাক্ত ফসফরাস বোমা তৈরিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। ইজরায়েলের উপর রাসায়নির মারণাস্ত্রের হামলা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
২০০৩ সালে ইজরায়েলি সেনার হাতে গ্রেফতার হন বারঘৌতি। ৬৭টি যাবজ্জীবন এবং ৫ হাজার ২০০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় যা ইজরায়েলের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাজা। এটি সম্ভবত মানব ইতিহাসেও সর্বোচ্চ। ইজরায়েলের কারাগারে বসেই সেনাবাহিনীর উপর বিস্ফোরক হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন এই বারঘৌতি।
ইসমাইল হানিয়ে
প্য়ালেস্তিনীয় শরণার্থী শিবিরে জন্ম। প্যালেস্তাইন সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে প্যালেস্তাইনের প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব সামলেছেন।
১৯৮৯ সালে ইজরায়েল সরকার তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। অভিযোগ ছিল, ইসমাইল নাকি হামাস বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ছিলেন। তলে তলে হামাস বাহিনীকে নানাভাবে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই নেতৃত্বে হামাস বাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করা হয়।
খালেদ মেশাল
খালেদ মেশাল 'আবু আল-ওয়ালিদ' ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বেড়ে ওঠা কুয়েতে।
মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দলের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। ১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর হামাস বাহিনীর নেতা নিযুক্ত হন।
এই খালেদ মেশালকে হত্যার বহু চেষ্টা করেছিল ইজরায়েল। মেশাল তখন থাকতেন জর্ডনের আম্মানে। মেশালকে হত্যার দায়িত্ব পড়ে ইজরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের উপরই। সিদ্ধান্ত হয় আম্মানে গিয়েই তাঁকে হত্যা করা হবে এবং হত্যার জন্য গুলি, বোমা নয়, বরং ব্যবহার করা হবে বিশেষ ধরনের বিষাক্ত স্প্রে, যাতে হত্যার কোনও প্রমাণ না থাকে। কারণ সে সময় জর্ডনের শাসন ক্ষমতা ছিলেন বাদশাহ হোসেন এবং তাঁর সঙ্গে ইজরায়েল সরকারের সুসম্পর্ক ছিল।
পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মোসাদের ছ’জন এজেন্ট কানাডার ডাল পাসপোর্টে আম্মানে পৌঁছয়। ১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেশালের উপর রাসায়নিক প্রয়োগের চেষ্টা করে। মেশালের গলায় রাসায়নিক স্প্রে করার লক্ষ্য ছিল মোসাদের এজেন্টদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেশালের দেহরক্ষীরা টের পেয়ে যাওয়ায় ও বাধা দেওয়ায় সেই রাসায়নিক মেশালের কানে গিয়ে আঘাত। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে সুস্থ হন মেশাল। এই ঘটনার পরেও মোসাদ খালেদ মেশালকে হত্যা করতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালায়, কিন্তু সফলতার মুখ দেখেনি।
মাহমুদ আল-জহর
শুধু ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড নয়, বিশ্ব জুড়ে আধিপত্য কায়েম করতে চায় হামাস। গাজ়য় যুদ্ধের আবহে এমনই দাবি করেছেন, প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর শীর্ষ স্থানীয় নেতা তথা অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ আল-জহর।
হামাস নেতা তথা প্যালেস্তাইন সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মাহমুদ আল-জহর। ১৯৭১ সালে কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক হন এবং ১৯৭৬ সালে জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি গাজা ও খান ইউনিসের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
জহরকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৫ সালে হামাস আন্দোলন আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্যালেস্তাইন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াহর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন জহর।
২০০৩ সালে ইজরায়েলি সেনার বিমানহানায় জহরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয় এয়ারস্ট্রাইকে। হামাসের এই হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জহর। তিনি হুঙ্কার দিয়েছেন, গোটা বিশ্বে হামাসে নীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হবে। স্বাধীনতাকামীদের কিছুতেই আটকে রাখা যাবে না।