শেষ আপডেট: 24th September 2024 14:13
দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্যালেস্তাইনের পাশাপাশি লেবানন। বিশ্বদাদা আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ইজরায়েলের হিজবুল্লা ও হামাস জঙ্গি নিকেশের উদ্দেশ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে আরব দুনিয়ায়। প্রায় ৪২ বছরের রক্তাক্ত দুঃসম্পর্ক এবার বৃহত্তম সামরিক সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লক্ষ্য হিজবুল্লার মাজা ভেঙে তার নেতা নাসারুল্লাকে আলোচনার টেবিলে মাথা নিচু করে বসানো।
ইজরায়েল চায় শক্তি ও চাপ বজায় রেখে এমন এক চুক্তি যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। একদিকে লেবানন অন্যদিকে গাজা এলাকায় হিজবুল্লা ও হামাসের বিষদাঁত ভেঙে নতুন শক্তিবিন্যাস কায়েম করা। কারণ এই শত্রুতা আজকের নতুন নয়। এর সূত্রপাত ১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধের সময়। যখন লেবাননে ইজরায়েলের হানাদারির ফলেই প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল শিয়া জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লা বা আল্লার বাহিনী।
প্রথম লেবানন যুদ্ধ
১৯৭৮ সালের মার্চ। প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-র সদস্যরা ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। এক মার্কিন পর্যটককে খুন এবং একটি বাস অপহরণ করে ৩৪ জনকে হত্যা করে। এর জবাবে ইজরায়েলি বাহিনী লেবানন আক্রমণ করে এবং পর্যটক বাসগুলি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। প্রায় মাস দুয়েক পর ইজরায়েল হাত গুটিয়ে নেয় এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিবাহিনীকে লেবাননে প্রবেশ করতে দেয়।
এইভাবে পিএলও এবং ইজরায়েলের মধ্যে মাঝেমধ্যেই হামলা-প্রতি হামলা চলতে থাকে। ১৯৮১ সালের জুলাইয়ে মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও তা টেকেনি। পিএলও ইজরায়েল, পশ্চিম উপসাগরীয় এলাকা, গাজা এবং লেবানন সীমান্ত এলাকায় প্রায় ২৭০টি জঙ্গি হামলা চালায়। যাতে ২৯ জন ইজরায়েলি নিহত এবং ৩০০-র বেশি জখম হন। সেই সময় পিএলও-র ১৫ থেকে ১৮ হাজার সদস্য লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে ছিল।
ইজরায়েলের ১৯৮২ সালের আক্রমণ এবং হিজবুল্লার জন্ম
বারুদে আগুন পড়ে ১৯৮২ সালের জুন মাসে। প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠী ব্রিটেনস্থিত ইজরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ ৬ জুন তার জবাবে শুরু করে অপারেশন পিস ফর গ্যালিলি। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রমাগত হামলা ও শান্তিচুক্তির চেষ্টার পর পিএলও নেতা ইয়াসের আরাফত সহ দলের সেনারা লেবানন মুক্ত করে। আরাফত চলে যান তিউনিসিয়ায়।
ওই পর্বে ইজরায়েল ও তার বন্ধু দেশগুলির সহায়তায় ঘটে সাবরা এবং শাটিলা গণহত্যা। যাতে ২ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু এবং লেবাননির মৃত্যু হয়। সেই সময় প্রতিরোধের বীজ বপন হয় লেবাননের মাটিতে। এই প্রতিরোধ যারা গড়ে তোলে তাদের একটি গোষ্ঠী হল হিজবুল্লা। ইরানের সমর্থনে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের নিয়ে গঠিত জঙ্গি গোষ্ঠী।
১৯৮৩-১৯৮৫ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
এই কয়েক বছরে হিজবুল্লা ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠীগুলি লেবাননে একের পর এক বিদেশি শক্তির উপর হামলা চালাতে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৩ সালে বেইরুটে ফরাসি ও মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যারাকে বোমাবর্ষণ। যাতে ৩০০-র বেশি শান্তিবাহিনীর জওয়ান নিহত হয়। ১৯৮৫ সালের মধ্যে হিজবুল্লা দক্ষিণ লেবানন থেকে ইজরায়েলি বাহিনী বিতাড়ন করতে সক্ষম হয়।
১৯৯২-১৯৮৬ তে হিজবুল্লার রাজনৈতিক উত্থান
১৯৯২ সালের লেবানন গৃহযুদ্ধের পর হিজবুল্লা নিজেদের রাজনৈতিক পোশাক গলিয়ে নেয় সংগঠনের শরীরে। লেবাননের ১২৮ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে ৮টি আসনে জেতে। এরপর বছরের পর বছর ধরে এর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক পরিষেবার কাজেও নাম কামাতে থাকে।
একইসঙ্গে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা সংঘর্ষ চলতেই থাকে। যার ফলে ১৯৯৩ সালে ইজরায়েল ফের আক্রমণ চালায় এবং একইভাবে ১৯৯৬ সালেও ইজরায়েল হিজবুল্লাকে কাবু করার জন্য বিশেষ অপারেশন শুরু করে।
২০০০-২০০৬ সালে ইজরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং জুলাই যুদ্ধ
২০০০ সালের মে মাসে ইজরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রায় দুদশক পর দখল প্রত্যাহার করে নেয়। হিজবুল্লা এই জয়কে লেবাননের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করে। সব মিলিয়ে আরব দুনিয়ায় ইজরায়েল বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সালে দুই ইজরায়েলি সেনাকে পাকড়াও করায় নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়, যা জুলাই যুদ্ধ নামে খ্যাত। ৩৪ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধে ১২০০ লেবাননি এবং ১৫৮ জন ইজরায়েলি নিহত হয়েছিলেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আঞ্চলিক সংঘাত
২০০৯ সালের মধ্যে লেবাননের একটি জঙ্গি গোষ্ঠীই নয়, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটে হিজবুল্লার। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও তারা সেই শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শন করে। এই দীর্ঘ সময়ে ইরানের সঙ্গে হিজবুল্লার সম্পর্ক আরও মজবুত হতে থাকে। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে ফের হিজবুল্লা গোষ্ঠী ইজরায়েলকে প্রতিরোধ শুরু করলে এই পরিস্থিতির দিকে গড়ায় সংঘাতের সম্পর্ক।