শেষ আপডেট: 16th October 2024 21:02
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'মদ খাওয়া ছেড়ে দেব'-- এক আশ্চর্য ও চিরকালীন মিথ্যে হয়ে থেকে যায় বেশিরভাগ মদ্যপ্রেমীর জীবনে। প্রিয়জনের কাছে অঙ্গীকার হোক বা নতুন বছরের রেজলিউশন, মদ্যপান ছাড়ার অঙ্গীকারটি যেন ভাঙার জন্যই করা হয়ে থাকে। অঙ্গীকারের বোঝা পেরিয়ে, আনন্দে হোক বা শোকে, বৃষ্টির মৌতাতে হোক বা রোদ্দুরের ক্লান্তিতে, গেলাস হাতেই বলে উঠতেই হয়, 'এমন বন্ধু আর কে আছে!'
কিন্তু এই 'বন্ধুত্ব'কে দীর্ঘতর করতে হলে, তার আনন্দকে স্থায়ী করতে হলে বন্ধুকে যে ভাল করে চিনতে হবে! ভাল করে জানতে হবে তার খুঁটিনাটি, চাওয়া-পাওয়া। বুঝতে হবে, তাকে কতটা গ্রহণ করলে শরীরে ক্ষতি হবে না, কতটা বেশি গ্রহণ করলেই বা কতটা বেশি ক্ষতি হবে! এখন অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময়ে সীমিত মদ্যপান স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হলেও, এখন আর তেমনটা বলা যায় না।
তার পরেও বিভিন্ন গবেষণার শেষে সহজ কথায় যেটা উঠে আসে, অ্যালকোহল সেবন একটি স্তর পর্যন্ত বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য 'কম-ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সম্ভাব্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি এতে কম হয়। এই স্তরকে মদ্যপানের পরিভাষায় বলা হয় 'মডারেট ড্রিঙ্কিং'।
এই 'মডারেট'-এর মাত্রা আবার এক এক দেশে এক এক রকম। যেমন অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্সে সুপারিশ করা হয়, যে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই সপ্তাহে ১০টির বেশি পানীয় নেবেন না। কানাডার সর্বশেষ নির্দেশিকা প্রতি সপ্তাহে মোট দু'টির বেশি পানীয় নিলে তা মডারেটকে ছাড়িয়ে যাবে। আমেরিকানদের জন্য আবার রোজ একটা করে পানীয়র 'অনুমোদন' রয়েছে।
তবে কিনা ভারতে, এমন কোনও ব্যবস্থা নেই, যাতে সুপারিশ করা যায় যে কতটা মদ খেলে তা 'মডারেট ড্রিঙ্কিং'। এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, এরকম মডারেট বলে কিছু হয় না, এক পেগ অ্যালকোহলও শরীরের জন্য খারাপ। আবার আর এক অংশের মধ্যেও মতের ভিন্নতা আছে।
কারণ আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, হজম সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা, সর্বোপরি মদ্যপানের সময়-- এই সব বিষয়গুলি বড় ফ্যাক্টর। তার উপর পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয়রা ওয়াইন বা ভদকার চেয়ে হুইস্কি, জিন এবং রামের মতো কড়া মদ বেশি পছন্দ করেন। ফলে এখানে সুনির্দিষ্ট করে 'মডারেট'-এর সীমা বাঁধা কঠিন।
দিল্লির সিকে বিড়লা হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ বিকাশ জিন্দাল বলেছেন, হু-এর নির্দেশিকা অনুসারে, অ্যালকোহল সেবনের জন্য সর্বাধিক প্রস্তাবিত সীমা হল মহিলাদের জন্য প্রতিদিন একটি পানীয় এবং পুরুষদের জন্য প্রতিদিন দুটি পানীয়। তবে সেই সঙ্গেই তিনি বলছেন, এর চেয়ে কম খেলেই স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও কমবে।
ডাঃ জিন্দাল ব্যাখ্যা করেন, বাঙালিরা প্রায়ই তাঁদের মশলাদার খাবার খাওয়ার অভ্যেস এবং স্ট্রেসের কারণে হজমের সমস্যায় পড়েন। অন্যদিকে অ্যালকোহল পাচনতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে, অ্যাসিড উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলিকেও নষ্ট করে। ফলে মদ খাওয়া সরাসরি হজমের সমস্যা বাড়ায়। পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দেন, ভারত এতই গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, ঘাম এত বেশি হয়, যে অ্যালকোহলের কারণে খুব সহজেই ডিহাইড্রেশনও হতে পারে।
ভাইরুটস ওয়েলনেস সলিউশনের আর এক সিনিয়র চিকিৎসক ডাঃ বিজু কেএস-ও জিন্দালের মতোই একই মত রাখেন এবং সেই সঙ্গে মনে করয়ে দেন, যে বাঙালিরা ডায়াবেটিস, পেটের সমস্যা এবং কার্ডিয়াক সমস্যায় অন্য সবার চেয়ে বেশি ভোগেন। তাঁর কথায়, 'ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের ডায়াবেটিস রাজধানী। এই অবস্থায় অ্যালকোহল সেবনের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। তাই, যদি কোনও দেশের মদ্যপানের অভ্যাসকে সবচেয়ে নীচে নামিয়ে আনার দরকার হয়, তবে তা হল ভারত।'
তিনি আরও বলেন, 'ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস), ক্রোনস ডিজিজ, পেপটিক আলসার, গলস্টোন, গ্যাসের মতো সমস্যাগুলি শরীরে থাকা অবস্থায় যদি অ্যালকোহল প্রবেশ করে, তাহলে গ্যাস্ট্রাইটিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস, আলসারের মতো রোগের দরজা সহজেই খুলে যায়।'
তাহলে ভারতের 'মডারেট' বলে কি কিছুই নেই?
তথ্য বলছে, একটি আদর্শ ড্রিঙ্কে প্রায় ১৪ গ্রাম বিশুদ্ধ অ্যালকোহল থাকে, যা প্রায় ৫০ মিলি বিয়ার, ১৫০ মিলি ওয়াইন বা ৪৫ মিলি ডিসটিল্ড স্পিরিটের সমান। ফলে সেই মতো হিসেব করে মহিলাদের প্রতিদিন একটি পানীয় এবং পুরুষদের প্রতিদিন দুটি পানীয় মেপে, হিসেব করে পছন্দের মদ খাওয়া যেতে পারে।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এতদিন বলে এসেছে, পরিমিত মদ্যপান করলে শরীরে এইচডিএল (ভাল কোলেস্টেরল) বৃদ্ধি পায় এবং তা শরীরের ধমনীতে প্লাক তৈরি করা কমিয়ে হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথের আরও একটি গবেষণা বলেছে, পরিমিত মদ্যপান বলতে ততটাই বোঝায়, যতটা আমাদের শরীরের 'ক্ষতি' করে না।
তবে এইসব গবেষণা নাকচ করে এদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, 'অ্যালকোহলের উপকারিতা' নিয়ে এই গবেষণাগুলি মোটেও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়, সর্বোপরি এই ব্যাখ্যা সকলের শরীরের জন্য একই ভাবে কার্যকরও নয়। বাঙালিদের জন্য আরওই নয়।
ফর্টিস হাসপাতালের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের ইউনিট প্রধান চিকিৎসক ডাঃ আশিস জর্জ বলছেন, 'একসময় কিছু গবেষণায় পাওয়া গিয়েছিল, যে মডারেট ড্রিঙ্কিং বলতে সপ্তাহে একবার বা দু'বার মদ খাওয়া চলে। তবে মেডিক্যালি এই তথ্যকে স্বীকার করার উপায় নেই। কারণ এই পরিমাণ মদ্যপানও লিভারের রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ওবেসিটি, ডিমেনশিয়া এমনকি ক্যানসার-- এই সমস্ত রোগের ঝুঁকিই বাড়ায়। অ্যালকোহল মূলত একটি বিষাক্ত পদার্থ, যার কোনও পুষ্টি নেই, কেবল ক্যালোরি রয়েছে।'
ফলে সারা বিশ্বে সমাদৃত হলেও, বাঙালিদের ক্ষেত্রে 'মডারেট ড্রিঙ্কিং'-এর ধারণা একেবারেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না ডাক্তারবাবুরা। বহু মতামত ও ব্যাখ্যার পরে 'শেষ পেগ' হিসেবে তাঁরা একটা কথাই বলছে, 'এক গ্লাস অ্যালকোহলও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়। তাই এটি না খাওয়াই সবচেয়ে ভাল।'