ফ্যাটি লিভার।
শেষ আপডেট: 29th July 2024 20:30
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এদেশের প্রতি তিন জন ব্যক্তির মধ্যে একজন আক্রান্ত ফ্যাটি লিভারে। এবং এই ফ্যাটি লিভারের কারণেই টাইপ ২ ডায়াবেটিস-সহ একাধিক অসুখের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে গোটা সভ্যতাকে। এমনটাই বলছে তথ্য ও পরিসংখ্যান। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) একটি সাধারণ লিভারের অসুখ হলেও, তা শেষ পর্যন্ত সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসারেও পরিণত হতে পারে। তাছাড়াও এটি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের অসুখ-সহ নানা রোগ ডেকে আনে। সবচেয়ে বড় কথা, শিশু থেকে বয়স্ক-- কেউই এই অসুখ থেকে বাদ থাকছেন না। সেই সঙ্গেই উদ্বেগের বিষয় হল, ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, পিসিওএস, হাইপোথাইরয়েডিজম-- আরও নানা রকম সমস্যাকে ডেকে আনে এই অসুখ। এই নিয়েই আলোচনা করলেন সল্টলেক আইএলএস হাসপাতালের কনসালট্যান্ট গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডক্টর জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়।
ডাক্তারবাবু বলছেন, নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজকে নিঃশব্দ মহামারীও বলা যেতে পারে। বড়সড় কোনও ক্লিনিক্যাল উপসর্গ ছাড়াই রোগটি অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। লিভারে চর্বি জমা হওয়া দিয়ে শুরু হলেও, ফাইব্রোসিস, সিরোসিস, হার্টের অসুখ বা স্নায়ুর রোগ পর্যন্ত হতে পারে এর ফলে। মৃত্যুও হতে পারে রোগীর।
আমাদের লিভারে সকলেরই সাধারণ মাত্রায় ফ্যাট অর্থাৎ স্নেহ পদার্থের উপস্থিতি থাকে। কিন্তু তা ৫ শতাংশের বেশি থাকলে, তখনই তা 'ফ্যাটি লিভার' নামক অসুখ হয়ে ওঠে। তবে ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে, এটা আসলে কোনও অসুখ নয়। এটাকে অসুখের একটা ধাপ বলা যায়। কারণ প্রথমে ফ্যাটি লিভার দিয়ে শুরু হলেও, পরে তা লিভারের বড় সংক্রমণ ঘটানোর ঝুঁকি বাড়ায়। সেখান থেকে হতে পারে সিরোসিস, যার চূড়ান্ত পর্ব লিভার ক্যানসার। তার মানে এই নয় যে সমস্ত ফ্যাটি লিভার এভাবেই খারাপতম চেহারা নেবে। কিন্তু বিশ্বে মোট যত মানুষের ফ্যাটি লিভার আছে, তাঁদের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষের ফ্যাটি লিভার খারাপ দিকে যায়।
এই ফ্যাটি লিভার দু'রকমের হয়, অ্যালকোহলিক এবং নন-অ্যালকোহলিক।
যাঁরা নিয়মিত বেশি অ্যালকোহল খান তাঁদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার আশঙ্কা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি। লিভারের সঙ্গে মদের এই বৈরিতার কথা সকলেই প্রায় জানেন। লিভারের ধাতে যা সয় না তেমন কিছু খেলে ফ্যাট তো জমবেই। অ্যালকোহল ঠিক তেমনই একটা উপাদান। এর ফলে লিভার ফুলতে শুরু করে। ইনফ্ল্যামেশন হয়। পরের ধাপ ফাইব্রোসিস। এই অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের চতুর্থ পর্যায় হল লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেলিওর। মদ্যপান ছাড়াও যখন ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ দেখা দেয়, তখন সেই রোগকে বলা হয় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। এই রোগেও শরীরে বাসা বাঁধতে পারে লিভার সিরোসিস।
১) নীরব মহামারী: প্রায় উপসর্গবিহীন থাকে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। অনেকটা বাড়াবাড়ি হওয়ার পরে তবেই ক্লিনিক্যাল লক্ষণগুলি বাইরে থেকে দেখা যায়।
২) বহু রোগের আঁতুরঘর: সাধারণ স্টেটোটিক (লিভারে চর্বি জমা) থেকে শুরু হলেও স্টেটোহেপাটাইটিস (প্রদাহ এবং ক্ষতি), ফাইব্রোসিস (ক্ষতচিহ্ন), সিরোসিস (লিভারের কাজ নষ্ট হয়ে যাওয়া), হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (এক ধরনের লিভার ক্যানসার), লিভার ফেলিওর, হার্টের অসুখ, স্নায়ুর রোগ ডেকে আনে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ।
রোগ নির্ণয়ের সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হল, ইউএসজি বা পেটের অন্যান্য ইমেজিং। এলএফটি বা লিভার ফাংশন টেস্টের রক্তপরীক্ষা দেখেও এটি কখনও কখনও ধরা পড়ে।
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের চিকিৎসা
এই চিকিৎসার প্রাথমিক ধাপ হল ওজন কমানো। ভাল ডায়েট এবং এক্সারসাইজ করতে বলা হয় প্রথমে। প্রথম ৬ মাস ডায়েট ও এক্সারসাইজের মাধ্যমে শরীরের মোট ওজনের ৭ শতাংশ কমাতে পারলে লিভারের জৈব রাসায়নিক উন্নতি হয় এবং বিপাকীয় ক্রিয়া অনেকটাই ফিরে আসে। ভিটামিন ই, পিওগ্লিটাজোন, সরোগ্লিটাজার এবং ওবেটোকলিক অ্যাসিডের মতো ওষুধগুলিও লিভারের রোগের উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
১) প্রথমেই নজর দিন খাদ্যাভ্যাসে। কোথায় কোথায় ভুল রয়েছে, খুঁজে বের করুন। যতটা সম্ভব তেল-মশলাযুক্ত খাবার কম খান। সবুজ শাকসবজি ও নিয়মিত ফল খাওয়ার অভ্যাস করুন।
২) অতিরিক্ত ওজন থাকলে নিয়ন্ত্রণে আনুন। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
৩) ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার যকৃতের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ রাখুন খাদ্যতালিকায়। কাঠবাদাম, ওয়ালনাট, ফ্ল্যাক্সসিড ও অলিভ ওয়েল খেতে পারেন।
৪) অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে হতে পারে অ্যালকোহোলিক ফ্যাটি লিভার। তাই মদ্যপানে নিয়ন্ত্রণ আনুন। এমনিতেও অতিরিক্ত মদ্যপান অন্যান্য রোগকে আমন্ত্রণ করে। আর ফ্যাটি লিভার থাকলে মদ খাওয়ায় দাড়ি টানাই মঙ্গল।
৫) প্রতিদিন ১ গ্লাস করে লেবুজল খান। ঈষদুষ্ণ জলে অ্যাপল সিডার ভিনিগার মিশিয়েও খেতে পারেন। ফ্যাটি লিভারের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে এটি বেশ সহজ উপায়।
৬) রোজ এক কাপ করে কফি বা গ্রিন টি পানেও ফ্যাটি লিভারের সমস্যা কমাতে পারে।
৭) খুব কম পরিমাণে চিনি, লবণ, রিফাইনড কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা এবং সম্পৃক্ত ফ্যাট গ্রহণ করুন। তেলে ভাজা বা চর্বিজাতীয় খাবারে রাশ টানুন।
৮) ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ শাক সবজি, যেমন ব্রোকলি, পালংশাক, কচুশাক ইত্যাদি বেশি করে খান।
৯) মেটাবলিক সিনড্রোম, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি, হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত কোনো সমস্যা থাকলে তার সঠিক চিকিৎসা করান।
১০) সর্বোপরি, লিপিড প্রোফাইল ঠিক রাখার চেষ্টা করুন।