এগ ফ্রিজিং।
শেষ আপডেট: 14 June 2024 16:41
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এগ ফ্রিজিং বা ডিম্বাণু সংরক্ষণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অন্যতম আবিষ্কার। ইদানীং অনেকেই এই ব্যাপারে শুনলেও এই নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই বেশিরভাগ মানুষেরই। অথচ প্রিয়াঙ্কা চোপড়া থেকে শুরু বলিউডের এমন অনেক অভিনেত্রীই আছেন, যাঁরা তাঁদের কমবয়সে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। বিশ্বজুড়েই এখন এমন এগ ফ্রিজিং-এর দিকে ঝুঁকছেন মহিলারা। তথ্য বলছে, ২৫ থেকে ৩২ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে এগ ফ্রিজিংয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
নানা কারণেই অনেক মহিলার পক্ষে ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে সন্তানধারণ করা সম্ভব হয় না। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় মা হতে চান না এই বয়সে। কিন্তু বেশি বয়স পর্যন্ত পুরুষরা প্রজননে সক্ষম হলেও মহিলাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। তাই এগ ফ্রিজ বা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখলে পরবর্তী সময়ে মা হওয়াতে তেমন সমস্যা হয় না। তাই চল্লিশ পেরিয়েও অনেকেই ভেবে দেখতে পারেন মা হওয়ার কথা। কেউ ভাবতে পারেন দ্বিতীয় সন্তানধারণের কথাও। এখন এমন প্রায়ই হচ্ছে। এমনকী বায়োলজিক্যাল ক্লককে পাত্তা না দিয়ে, পঞ্চাশের পরেও মা হচ্ছেন অনেকে। বিদেশে ষাটের পরেও।
জন্মের সময় প্রতিটি মেয়েরই শরীরে ডিম্বাণুর নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে। গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহে স্ত্রী ভ্রূণের প্রায় ৬০ লক্ষ ডিম থাকে। জন্মের সময় মেয়েরা তাদের প্রায় অর্ধেক ডিম হারিয়ে ফেলে, এবং যখন তারা বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করে, তখন ডিম্বাণুর সংখ্যা থাকে ৪ লক্ষের কাছাকাছি। এর পরে প্রতি মাসে পিরিয়ডের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে ডিম্বাণুর সংখ্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গুণাগুণও হ্রাস পেতে থাকে।
তাই চিকিৎসকরা বলে থাকেন, ত্রিশ বছর বয়স হওয়ার আগে এগ ফ্রিজিং করলে ফল ভাল পাওয়া যায়। কারণ কুড়ির কোঠায় একটি মেয়ের উর্বরতা থাকে শীর্ষে। ৩০ ছোঁয়ার পর থেকেই তা কমতে শুরু করে। ফলে এগ ফ্রিজিং করতে দেরি হলেও তা যেন ৩৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই হয়। কম বয়সে এগ ফ্রিজিং করলে সেই ডিম্বাণুর মান ভাল হয়, পরবর্তী সময়ে মা হতে কোনও সমস্যা হয় না।
এগ ফ্রিজিং ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মতোই এই প্রক্রিয়া। শরীর বুঝে হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে ডিম্বাণুর পরিমাণ বাড়ানো হয়। তারপর ডিম্বাণু এক্সট্র্যাক্ট করে বা বের করে তা সংরক্ষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে যে পদ্ধতি নেওয়া হয় তাকে বলে ভিট্রিফিকেশন। অর্থাৎ র্যাপিড ফ্রিজিং। শরীর থেকে যে পদ্ধতিতে ডিম্বাণু বের করা হয় তাকে বলে ট্রান্সভ্যাজাইনাল উসাইট রিট্রিভাল। সাধারণত ১৫টি ডিম্বাণু নিষিক্ত করা সম্ভব।
ডিম্বাণুকে তরল নাইট্রোজেনে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। তার আগে ডিম্বাণুর মধ্যে যে জলের পরিমাণ থাকে তা বের করে নেওয়া হয়। কারণ ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের সময় অতিরিক্ত জল থাকলে তাতে ক্রিস্টাল তৈরি হয়ে যায়। -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছলেই দেখা যায় ক্রিস্টাল তৈরি হতে শুরু করেছে, তখন ডিম্বাণুর আকার ও গুণগত মান নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাই ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে জল বের করে ফেলা হয়। ডিএমএসও নামে একধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে ডিম্বাণুকে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সংরক্ষণ করা হয়।
এই এগ ফ্রিজিং যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে তা নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা নানা মিথ এবং ভুল ধারণাও। এমনই ৬টি ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা করলেন কলকাতার বিড়লা ফার্টিলিটি ও আইভিএফ সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডক্টর সুগতা মিশ্র।
এ কথা একেবারেই ঠিক নয়। কেরিয়ারে উন্নতি করার আকাঙ্ক্ষার কারণে অনেকের যেমন মা হতে দেরি হতে পারে, তেমনই বহু মহিলা রয়েছেন, যাঁরা অন্য আরও নানা কারণে সময়ে মা হতে পারছেন না। কিন্তু তাঁরা মা হতে চান দেরি করে। চিকিৎসার কারণে অনেকেরই দেরি হতে পারে। হয়তো কেউ ক্যানসারের মতো চিকিৎসার অধীনে আছেন, কেমোথেরাপি চলছে। তাঁর পক্ষে মা হওয়ার জন্য আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। এদিকে হয়তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তিনি অবশ্যই এগ ফ্রিজিং করতে পারেন। আবার অনেক মহিলাই কম বয়সে যোগ্য সঙ্গী নির্বাচন করে উঠতে পারেন না। ফলে তাঁরাও ভবিষ্যতে মা হওয়ার জন্য পথ খোলা রাখতে চেয়ে, এগ ফ্রিজিং করতে পারেন।
এগ ফ্রিজিং একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি হলেও, এটি কখনওই ভবিষ্যতের গর্ভধারণের নিশ্চয়তা দেয় না। এটি গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ায় ঠিকই, তবু চূড়ান্ত সাফল্যের হার বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে। এগ ফ্রিজ করার সময়ে মহিলার বয়স কত ছিল, কতগুলি ডিম্বাণু এক্সট্র্যাক্ট করা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত কতগুলি ভাল অবস্থায় পাওয়া গেছে-- এমন নানা বিষয় রয়েছে, গর্ভধারণ সফল হওয়ার পিছনে।
যে বয়সে একজন মহিলা তাঁর এগ ফ্রিজিং করেন, তা উল্লেখযোগ্যভাবে ভবিষ্যতের গর্ভধারণের সাফল্যের হারকে প্রভাবিত করে। অল্প বয়সে ফ্রিজ করা ডিম্বাণুগুলি সাধারণত অনেক বেশি উচ্চ মানের হয় এবং সেক্ষেত্রে সফল গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এটি অত্যন্ত নিরাপদ একটি পদ্ধতি। ডিম্বাণু এক্সট্র্যাক্ট করে বা বের করে তা সংরক্ষণ করার ঝুঁকি বলতে গেলে ন্যূনতম। প্রজনন-সংক্রান্ত আর পাঁচটা চিকিৎসা যেমন, এটিও প্রায় তাই। গর্ভধারণের জন্য ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিন্ড্রোম (OHSS) যেমন হয়ে থাকে, এটিও তেমনই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি এই ঝুঁকি আরও কমিয়েছে।
এগ ফ্রিজিং-এর প্রক্রিয়া খানিকটা ব্যয়বহুল হলেও, এটি দিনে দিনে অনেক বেশি সংখ্যায় হচ্ছে। অনেক ক্লিনিকও বাড়ছে। ফলে একে আর দুর্লভ বলা যায় না। অনেক ক্লিনিকই এগ ফ্রিজিংয়ের সুবিধাজনক আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে থাকে। এই ফ্রিজিং যত বাড়ছে, খরচও ধীরে ধীরে তত কমছে।
আধুনিক ফ্রিজিং কৌশল, বিশেষ করে ভিট্রিফিকেশন, ডিম্বাণুর সংরক্ষণকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করে তুলছে। এই পদ্ধতিগুলি ফ্রিজড এগের ক্রিস্টাল তৈরি হওয়া প্রতিরোধ করে। ফলে ডিম্বাণুর গুণমানের ক্ষতিও প্রতিরোধ হয়। ফলে ফ্রিজ করা এগগুলির কার্যকারিতা বা গুণমান বহু বছর ধরে সংরক্ষিত থাকে।