শেষ আপডেট: 3rd November 2023 12:23
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মনের এই দুই বিপরীতধর্মী আচরণকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার’ (Bipolar Disorder) । বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত এই বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন বলেই দাবি করেছিলেন তাঁর থেরাপিস্ট ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট সুজান ওয়াকার। বাইপোলার ডিসঅর্ডার চট করে ধরা পড়ে না। মনের এই জটিল রোগ চিহ্নিত করতে এবং রোগী কোন স্টেজে আছে তা ধরতে বহু সময় পেরিয়ে যায়। ফলে রোগী আরও জটিল অবস্থায় চলে যায়। অনেকক্ষেত্রে হিংস্রও হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিকতম গবেষণা বলছে, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বাইপোলার ডিসঅর্ডার নির্ণয় করা সম্ভব।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ অর্থাৎ ৮ কোটি মানুষ বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এঁদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষেরই ভুল রোগ নির্ণয় হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে তাঁরা ডিপ্রেশনের শিকার। ফলে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংও ভুল পথে এগিয়েছে। এবার ব্লাড টেস্ট করলেই নাকি ধরা পড়বে মনের এই বিচিত্র ও জটিল রোগ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বাইপোলার ডিসঅর্ডার ও রক্ত পরীক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষকরা বলছেন, ‘মাস স্পেকট্রোমেট্রি’ পদ্ধতির সাহায্যে রক্ত উপস্থিত ৬০০ মেটাবোলাইটস ( এক ধরনের বিপাকজাত পদার্থ পদার্থ) বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানেই রোগীর রক্তে একটি বায়োমার্কার খুঁজে পাওয়া যায়। এই বায়োমার্কারই বাইপোলার ডিসঅর্ডার শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। গবেষণার নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক সেবিন বানের মতে, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সঙ্গে মানসিক অবসাদের মিল থাকলেও দু’টোর চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা। বরং, যদি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীকে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট দেওয়া হয় এবং মুড স্টেবিলাইজ়ার না দেওয়া হয়, তাহলে রোগীর মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে।
নিজের সত্তার মধ্যেও লুকনো আছে আরও এক সত্তা। দুইয়ের প্রকৃতি ভিন্ন। আবার কখনও তারা মিলেমিশে যায়। একের মধ্যেই অন্যকে পালন করার এই প্রবৃত্তি মনের এক জটিল অবস্থা। কখনও হাশিখুশি, উচ্ছ্বাস আবার কখনও মন যেন ভেঙেচুড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সবকিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। ভেতর থেকে দলাপাকানো একটা কান্না ঠেলে উপরে উঠতে চায়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার মানেই মন ও মেজাজ সবসময় দুই চরম স্থিতিতে থাকে। হয় প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস না হলে একেবারে ভগ্ন, বিষাদগ্রস্ত, অবসাদে আচ্ছন্ন। মনের এই অসুখ যে কতটা মারাত্মক হতে পারে সেটা টের পান কাছে থাকা মানুষজনই।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীর মানসিক স্থিতি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে তার আঁচ পাওয়া মুশকিল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকের ক্ষেত্রে মনের এই রোগ প্রচণ্ড আনন্দ বয়ে আনে। সৃজনশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা গেছে। অন্তর্মুখী, কম কথা বলা মানুষও মেলামেশা করছেন, বেশি কথা বলছেন, সৃজনশীন কাজ করছেন এমন উদাহরণও আছে।
এটা গেল একটা দিক। অন্যদিকটা হচ্ছে মারাত্মক। সেখানে মেজাজ শূন্য থেকে একশোর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। কখনও ভাল তো কখনও একদম খারাপ। রোগীর মনে হতে থাকে সে অন্য একটা মানুষ। সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র নিয়ে বাঁচছে। সেই মতো কাজ করতে শুরু করে। আচরণে বদল আসে। হাবভাব পাল্টে যায়। এমনও দেখা গেছে কথা বলার ধরণ, মতিগতি সবই বদলে গেছে রোগীর। যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে। একেই বলে দ্বৈত সত্তা।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের আরও একটা খারাপ দিক হল রোগী তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে। মনের ভেতর উদ্বেগ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। রাগ, দুঃখ, ঘৃণা একসঙ্গে জেগে ওঠে। অনেকের ক্ষেত্রে প্রতিশোধ-স্পৃহাও প্রবল হয়। আত্মহত্যার মানসিকতা জেগে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা অনেক রোগীই মনে করেন তাঁর জীবনের সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি মুখ থুবড়ে পড়েছেন। সবকিছু ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসতে চান অনেকে, আবার অনেকে জীবনকেই শেষ করে দিতে চান।
দ, নিজেকে অপরাধী ভাবার মানসিকতাও প্রবল হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় রোগীর মানসিক অবস্থা এতটাই স্পর্শকাতর থাকে যে সামান্য চাপ বা উদ্বেগও ক্ষতি করতে পারে। তাই খুব নরম ব্যবহার করতে হয় রোগীর সঙ্গে, আগলে রাখতে হয় সবসময়। রোগী এই সময় এককীত্বে ভুগতে থাকে। তাই বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং করতে হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা হাইপোম্যানিয়ায় ভোগা রোগীদের মনের জোর বাড়ানোটা সবচেয়ে আগে জরুরি। রোগী যে নিঃসঙ্গ নয় সেটা বোঝানোর দরকার হয়। তার পরেই সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং শুরু করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।