প্রতিদিনের পরিশ্রম আমাদের শরীর ও মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। প্রতিক্ষণের নানা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুঝে চলাই জীবন। তবুও, কখনও কখনও শারীরিক সমস্যা আমাদের ফেলে প্রবল যন্ত্রণায়, ফেলে দুর্ভাবনায়।
স্পাইন-জনিত সমস্যাগুলি আমাদের প্রায়শই কাতর করে তোলে। আর সে সম্বন্ধে অনেক কিছুই না জানার ফলে, নানা ভুল ধারণার বশে আমরা ভুগতে থাকি আশঙ্কায়। তাই এ বিষয়ে কী করতে হবে, আর কী কী এড়িয়ে চলতে হবে, তা জানতে বিশিষ্ট স্পাইন সার্জেন ডঃ অভিষেক রায়ের সাথে কথা বলল ‘দ্য ওয়াল’।
দ্য ওয়াল: স্পাইনের বিভিন্ন সমস্যার উপসর্গ ও লক্ষণগুলি কী কী?
ডঃ রায়: স্পাইনের সমস্যাগুলি নানাভাবেই দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বেশি যে উপসর্গ দেখা যায়, তা হল ব্যথা। এই ব্যথা ঘাড়, পিঠের উপরদিক, পিঠের নীচের দিক ও কোমরের কাছে হতে পারে। সেই সঙ্গে থাকতে পারে ঘাড় থেকে কাঁধ বেয়ে হাতে নেমে আসা ব্যথা অথবা পায়ের উরুর থেকে নীচের দিকে নেমে আসা যন্ত্রণা, হাতে বা পায়ে অবশভাব, কিংবা ইলেক্ট্রিক ‘শক’ পাওয়ার অনুভূতি। এছাড়া কিছু উপসর্গ আছে, যেগুলি বেশি দেখা না গেলেও, মারাত্মক, যেমন- প্রস্রাব করতে অপারগতা বা নিম্নাঙ্গের পক্ষাঘাত বা পেশির দুর্বলতা।
দ্য ওয়াল: স্পাইন-জনিত সমস্যা কি ক্রমশ ছড়াচ্ছে?
ডঃ রায়: বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় কিভাবে স্পাইন-ঘটিত সমস্যাগুলি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, আর তা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! ৪৫ বছরের কমবয়সীদের প্রতিবন্ধকতার প্রধানতম কারণ এই স্পাইন-ঘটিত সমস্যাগুলি। যেসব সমস্যার জন্য মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ চান, এই সমস্যাগুলি, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়স্থানে আছে। আর হাসপাতালে ভর্তি? স্পাইনের সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি — র্যাঙ্কের নিরিখে চতুর্থ। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, স্পাইন-ঘটিত এই সমস্যাগুলি কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, কিভাবে ক্রমশ ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে সমাজজীবনে। আর অল্প কিছু প্রয়াসে কী ভাবে এই বহুব্যাপ্ত অসুখটি থেকে আমরা সুস্থ থাকতে পারি।
দ্য ওয়াল: এই ধরণের ব্যথার কারণ কী?
ডঃ রায়: এই ধরণের ব্যথার বিভিন্ন কারণ আছে। তবে ব্যথাটি তো অসুখ নয়, অসুখের লক্ষণমাত্র। জীবনযাপনের প্রতিটি কাজেরই এই ব্যথার পেছনে কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। দেহের গঠন ও গড়ন, পেশা,জীবনযাপন প্রণালী, বসা বা শোওয়ার ভঙ্গি, সবগুলিরই এই ব্যথার উৎপত্তি বা প্রাবল্য অথবা তীব্রতায় কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। অধিকাংশ সময়েই, এই কারণগুলির ফলে, পিঠের পেশিগুলি কঠিন চাপের পীড়ন সইতে না পারায় তীব্রতর হয় ব্যথা বা যন্ত্রণার প্রকোপ।
দ্য ওয়াল: চিকিৎসার উপায় ও পদ্ধতি কী?
ডঃ রায়: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই (৯৫%) ঘাড়-পিঠে ব্যথার জন্য কোন অপরেশন লাগে না। কিছু ওষুধ আর পিঠের পেশি শক্তিশালী করার কিছু ব্যায়াম, কখনও জীবনযাপন প্রণালীতে সামান্য কিছু পরিবর্তন, এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথেষ্ট। স্পাইন-ঘটিত এই ব্যথাগুলি সীমিত; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত কমে যায়। মাত্র ২% থেকে ৫% ক্ষেত্রে অসুখটির মূল কারণ রোগীর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে, অপরেশনের পরামর্শ দেওয়া হয়। মনে রাখা ভাল, স্পাইন-সার্জারি ‘জীবনের মান-উন্নয়নের’ জন্য, বহুদিনের পুরনো ব্যথায় কাতর মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে ডাক্তারবাবু কী বলছেন জানুন—-
দ্য ওয়াল: স্পাইন-সার্জারি কতটা নিরাপদ?
ডঃ রায়: সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পাইন-সার্জারির (শিরদাঁড়ায় ও সেই হাড়গুলির ভেতরের স্নায়ুতন্ত্রীতে অপরেশন) পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা ও আশঙ্কা বহুপ্রচলিত। এর পেছনে প্রধান কারণ সঠিক সচেতনতার অভাব, এবং গত শতাব্দীর কিছু বিফল প্রয়াস। বিগত দুই দশকে স্পাইন-সার্জারির যে উন্নতি হয়েছে, তা এককথায় অভূতপূর্ব। আর সেই উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, রোগীর নিরাপত্তার দিকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক অপরেশনেরই নিজস্ব কিছু ঝুঁকি ও বিপদ বা জটিলতা থাকে, তাই বেশিরভাগ সময়েই আর অন্য কোনও উপায় না থাকলেই অপরেশন করা হয়। আধুনিককালে স্পাইন-সার্জারি হার্নিয়া বা গল ব্লাডার অপরেশনের মতোই নিরাপদ। বর্তমানে ‘নিউরোমনিটরিং’ পদ্ধতিতে অপরেশন চলাকালীনই, স্নায়ুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। ফলে এই অপরেশনের নিরাপত্তা বহুগুণ বেড়ে গেছে।
অধিকাংশ রোগীই অপরেশনের দিন বিকেল থেকেই চলতে-ফিরতে পারেন, আর তিন দিনে সাধারণত হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে যায়।
দ্য ওয়াল: কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাবেন? অর্থোপেডিক সার্জন না নিউরো সার্জন?
ডঃ রায়: বিভ্রান্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় চিন্তা। দুই বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাই প্রশিক্ষণের সময় স্পাইন-সার্জারিতে প্রশিক্ষিত হন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অল্পসংখ্যক চিকিৎসকই এই বিষয়ে আরও অ্যাজভান্সড প্রশিক্ষণ নিয়ে স্পাইন-সার্জারিতে দক্ষতা অর্জন করেন। সুতরাং, সহজ কথায়, স্পাইন-ঘটিত সমস্যায় এই ধরনের বিশেষ প্রশিক্ষিত ‘স্পাইন-সার্জনের’ পরামর্শ গ্রহণ করুন। তিনি অর্থোপেডিক সার্জন বা নিউরো সার্জন, যাই হোন না কেন।
দ্য ওয়াল: পাঠক-পাঠিকাদের জন্য বিশেষ কোনও বার্তা দেবেন?
ডঃ রায়: স্পাইন (শিরদাঁড়ায় ও সেই হাড়গুলির ভেতরের স্নায়ুতন্ত্রী) ঘটিত অসুখ থাকবেই। আধুনিক জীবনযাপনের চাহিদা ও চাহিদাপূরণের চাপের জন্য এই ধরণের অসুখ ক্রমবর্ধমান। পুষ্টিকর, সুষম আহার, নিয়মিত ব্যায়াম, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরকে সক্ষম রাখাই এই রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। স্পাইন-ঘটিত সমস্যার অধিকাংশই অপরেশন ছাড়াই সারিয়ে তোলা যায়, মাত্র অল্প কিছু ব্যক্তির জন্য অপরেশন প্রয়োজনীয় হতে পারে। অতএব, পিঠকে সুস্থ রাখুন, সুস্থ শরীরে আনন্দে বাঁচুন।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মধুরিমা রায়