
“অতি যত্নে সীমান্তটি চিরে/সিঁদুর-বিন্দু আঁক নাই কি শিরে?/ হয়নি সন্ধ্যাসাজ?”
রবীন্দ্রনাথের সীমন্তিনী মুখচোরা, ‘দুয়ার-কোণে’ আনত মুখে নির্দেশের অপেক্ষারত এক নারী। সিঁথি জুড়ে (Sindur Khela) যার গনগনে বহ্নিশিখা, দু’গালে রক্তিম আভা। হাতের কাঁকন শব্দের ঝংকারে মুখরিত হয় না। রিনিরিনি বাজে না পায়ের মল। শক্তির তেজ তার অন্তরে সুপ্ত, প্রকাশ্যে সে চঞ্চলা নয়। সীমন্তিনী নারীর এই গৃহলক্ষ্মী রূপ শ্রীবৃদ্ধিকারী। আর যে রূপ শৃঙ্খল, আবদ্ধতা অবলীলায় ভেঙে ফেলতে পারে—তাই হল তেজস্বিনী নারীশক্তির আধার। অস্ত্র সাজে সজ্জিতা দেবী দুর্গা এই রূপেরই প্রতিভূ।
স্নেহময়ী মাতৃরূপ হোক বা শক্তিরূপ—সব রূপেই নারী ক্ষমতায়ন ও মাতৃত্বের ধারক ও বাহক। তাঁর সিঁথিজুড়ে সেই শক্তির তেজ যা যুগে যুগে দুর্গারূপী নারীদের সাক্ষ্ম্য বহন করছে। বিজয়া দশমীতে এই শক্তিরই বিচ্ছুরণ ঘটায় নারীরা। সমাজ-সভ্যতা যাকে বলে সিঁদুর খেলা। শাস্ত্র বলবে সিঁদুর খেলা (Sindur Khela) সধবাদের বিশেষ আচার, পুরাণ বলবে তার উৎস ও মর্মার্থ, কিন্তু সব আচার-অনুষ্ঠান, শাস্ত্রমতের ঊর্ধ্বে উঠে সিঁদুর খেলা (Sindur Khela) কোথাও গিয়ে দুর্গারূপী নারীদের আত্মশক্তির প্রকাশ।
শক্তিরূপিনী মা দুর্গাকে সাক্ষী রেখে মেয়েরা যখন সদর্পে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে, একে অপরকে রাঙিয়ে দেয় টকটকে লাল সিঁদুরে, তখন রক্তিম আভায় ঢেকে যায় চারপাশ। এই লাল রঙ নারীর অন্তরাত্মার শক্তিকে জাগ্রত করে। নারী কারও অধীনে নয়, তার সত্ত্বা দাসত্বের বাঁধনে বাঁধা নয়, সে মুক্ত প্রাণশক্তির প্রতীক। সিঁদুরই তার স্ব-ক্ষমতায়ণের অস্ত্র, আর এই অস্ত্রেই সে সজ্জিতা।
Sindoor Fashion: গয়নার বিকল্প হতে পারে সিঁদুর! কীভাবে, বলছেন মেকআপ ডিজাইনার
সিঁদুর খেলা (Sindur Khela) এখন আর সধবাদের আচারে (Hindu Tradition) আবদ্ধ নেই। ‘স্টিরিওটাইপ’ ভেঙে কুমারী মেয়েরাও অংশ নিচ্ছে সিঁদুর খেলায়। বিধবা, রূপান্তরকামীরাও সঙ্কোচ-লজ্জার আস্তরণ সরিয়ে মেতে উঠছে সিঁদুর খেলায়। লাল পাড় সাদা শাড়িতে কপাল জোড়া সিঁদুরের আভা মেখে বিধবারাও বলছেন, নারী মৃত পুরুষের ভোগ্যপণ্য নয়। সিঁদুর তাঁর শক্তি ও সাহসের প্রতীক। সিঁদুর খেলা (Sindur Khela) তাঁর আত্ম উন্মোচনের পথ। ভালবাসার জায়গা। সেখানে কঠিন নিয়মকানুন, রীতিনীতি চলবে না। সিঁদুর খেলা তাই কোথাও গিয়ে সধবা, বিধবা, রূপান্তরকামী থেকে বারবণিতা—সকলকেই একসূত্রে গেঁথেছে।
ইতিহাস কী বলছে (Sindur Khela)
এবার একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাক। সিঁদুর খেলার চল ঠিক কবে থেকে তার সঠিক কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। ইতিহাসবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের কেউ কেউ বলেন ২০০ বছর আগে সিঁদুর খেলার চল হয়েছিল। তখন বর্ধিষ্ণু জমিদার পরিবারগুলিতে দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে বাড়ির বউরা একে অপরকে সিঁদুরে রাঙিয়ে স্বামী ও পরিবার পরিজনদের মঙ্গল কামনা করতেন। বিশেষ করে স্বামীর মঙ্গল কামনাতেই সিঁথি জোড়া সিঁদুর পরে সীমন্তিনীরা একে অপরকে সিঁদুর ছুঁইয়ে এই বিশেষ আচার পালন করতেন। আবার অন্য তত্ত্ব বলে, সিঁদুর খেলার ঐতিহ্য ৪০০ বছরের পুরনো। নিছক খেলার ছলেই এই প্রথার চল হয়। মায়ের বিসর্জনের দিন সকলের মনই ভারাক্রান্ত থাকে। তাই ওইদিন একটু আনন্দ-উল্লাসের জন্যই সিঁদুর খেলার প্রবর্তন হয়। সেই ঐতিহ্যই চলছে এখনও।
এ তো গেল একটা দিক। পুরান মতে সিঁদুর খেলার (Sindur Khela) অন্য তাৎপর্যও আছে। হিন্দুদের ভবিষ্য পুরাণ বলে, সিঁদুর ব্রহ্মের প্রতীক। এয়োস্ত্রীরা সেই ব্রহ্মস্বরূপ সিঁদুর সিঁথিতে ধারন করে স্বামী ও পরিবারের মঙ্গলকামনা করে। সিঁদুর খেলা আসলে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনার জন্যই। দশমীর দিন এয়োস্ত্রীদের একে অপরকে সিঁদুর পরানো সেই সৌভাগ্যেরই প্রতীক বলে মনে করা হয়।
এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবতের একটি ব্যাখ্যাও আছে. কাত্যায়নী ব্রত উপলক্ষে গোপীনিরা নাকি সিঁদুর খেলায় মেতে উঠতেন। একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে তাঁরা আসলে শ্রীকৃষ্ণেরই মঙ্গল কামনা করতেন।
সিঁদুর খেলার দিন মাহাত্ম্যও ভুলে গেলে চলবে না। দেবীর বিসর্জনের দিন অর্থাৎ বিজয়া দশমীতেই সিঁদুর খেলা হয়। কেন বিজয়া দশমীতেই সিঁদুর খেলা হয় তারও নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন পণ্ডিতরা। এক নয়, একাধিক মতবাদ আছে। দশমীকে কেন বিজয়া দশমী বলা হয় তার নানা ব্যাখ্যা আছে পুরানে। ৯ দিন ৯ রাত মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় দেবী দুর্গার। দশমীর দিনে মহিষাসুরকে বধ করে অধর্মের নাশ করেন দশপ্রহরণধারিণী। শক্তিরূপিনী মায়ের সেই বিজয়ের দিনটিকেই তাই বিজয়া দশমী বলে উল্লেখ করা হয়েছে পুরানে।
মত আরও আছে। এখানে রামচন্দ্রের অকালবোধনের প্রসঙ্গও উল্লেখ করা যায়। সীতা উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দেবী দুর্গার আবাহন করেছিলেন রামচন্দ্র। দেবীর আশিষ পেয়ে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। এই মতানুসারে সেই বিজয়ের দিনটিকেই তাই বিজয়া উৎসব বলা হয়। সেখান থেকেই ‘বিজয়া’ কথাটা এসেছে।
পণ্ডিতেরা বলেন, এই বিজয়া কথাটা অন্তর্নিহিত অর্থও আছে। বিজয় মানে হল অশুভের ওপর শুভ শক্তির জয়। দেবী দুর্গা আসলে নারীর অন্তরের শক্তি, অসুর রূপী যত অশুভ, অন্যায়, অত্যাচারকে নাশ করে শুভশক্তি ও শুভবোধের জাগরণ ঘটান তিনি। সে জন্যই বিজয়া দশমীর দিনটি হল অশুধ ও অন্ধকারের অবসানের দিন, জয়ের দিন, আনন্দের দিন। প্রীতি ও সম্প্রীতির দিন। তাই এই দিনটিতেই নারীরা সিঁদুর খেলায় (Sindur Khela) মেতে ওঠেন।
বনেদী বাড়ির ঠাকুরদালানে হোক বা পাড়ার মণ্ডপে মণ্ডপে মহিষাসুরদলনী যে দেবীমূর্তি পূজিতা হচ্ছেন, তিনিই বাঙালির মনে হৈমবতী, হিমালয় কন্যা আদরিনী উমা, স্নেহময়ী জননী আবার অসুরদলনী শক্তি। পুরাণে তিনিই নারীশক্তি এবং অদ্বৈততত্ত্বের প্রতীক।
ঋগ্বেদ-এর ‘দেবীসূক্ত’-তে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এই বিশ্বচরাচরের যা কিছু সবই ব্রহ্ম এবং সব কিছুতেই তাঁর অধিষ্ঠান। তিনিই ব্রহ্মস্বরুপিনী, তিনিই প্রকৃতি, তিনিই জগতের একমাত্র অধিশ্বরী। তাঁর সাকার রূপ সীমন্তিনী, তিনি সধবা, নীলকণ্ঠ মহাদেবের প্রেমময়ী স্ত্রী। সিঁদুর তাঁরই শক্তির প্রতীক। তাই দেবী দুর্গার সামনে সিঁদুর রাঙিয়ে যে প্রথা চলে আসছে এত বছর ধরে তা নিছকই সাধারণ আচার নয়। পুরুষতান্ত্রিক মতবাদে কোনও নির্দিষ্ট নিয়মেও বাঁধা নয়। নির্যাতন, শোষনের দলনে এ এক বিজয়োল্লাস। অন্তরের প্রশান্তি। সিঁদুর-রঞ্জিত মুখগুলোতেই প্রতিফলিত হয় সেই শান্তি। সূর্যের শেষ রক্তিম আলোয় মিলেমিশে যায় সিঁদুরের লাল রঙ। ঢাকের বাদ্যিতে বোল ওঠে,
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।”