
সুদীপ ভট্টাচার্য
বাঙালির অন্দরসজ্জা নিয়ে কথা বলতে গেলে, শুধুমাত্র শহুরে বাঙালির অন্দরসজ্জার (Interior Design) কথা বললেই হবে না। ফিরে যেতে হবে বাংলার গ্রামে। মাটির বাড়ি, বেড়ার বাড়ির একচালা কিংবা দোচালার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাঙালির আসল অন্দরসজ্জাবোধ। বাড়ির উঠোন, তুলসীমঞ্চ, গোলাঘর, ঢেকির ঘর, মন্দির, সবটাই এক অদ্ভুত দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো। কোথাও যেন এতটুকু সুর, ছন্দে ব্যাঘাত করে না।

এদেশের মাটির বাড়ি তৈরি করার যে স্থাপত্যশৈলী আজকের দিনে সেটা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত (Interior Design)। আসলে আমাদের দেশে আধুনিক স্থাপত্যকলার পূর্বপুরুষ ছিলেন ঘরামিরা। আর তাঁরাই বাস্তবকে সামনে রেখে ঋতুচক্র অনুযায়ী বাড়ি তৈরিতে মন দিতেন। শন, খড়, বাঁশের চাটাই, এবং মাটি সহযোগে বাসাবাড়ি নির্মিত হত। গ্রামের দিকে এখনও অনেক মাটির বাড়ি নজরে পড়ে। একতলা, দোতলা এমনকি তিনতলা পর্যন্ত মাটির বাড়ি দেখেছি আমি।
আরও পড়ুন: রাত পোহালেই নতুন বছর, নতুন মেনু সাজিয়েছে শহরের রেস্তোরাঁগুলি
অনেকদিন আগে, সময়টা বোধহয় ১৯৯৭ সাল, কলেজে পড়ি। বাঁকুড়ার ইনপুর বাংলা বলে একটি জায়গায় একটা সেমিনারে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাঁকুড়া স্টেশন থেকে প্রায় ঘণ্টা দুই গাড়ি চালানোর পর বহু ভিতরে গ্রামটা। মাটির রাস্তায় ধুলো ভরে গিয়েছিল গাড়ির ভিতর। আমদের রাখা হয়েছিল মাটির একটি দোতলা বাড়িতে। লোক অনেক, ঘরগুলো সবই দখল হয়ে গেল। আমার এবং আমার বন্ধুর জন্য বরাদ্দ হল মাটির বাড়ির দোতালায় মাটির সিঁড়ি দিয়ে উঠে সিঁড়ির পাশের কিছুটা চওড়া জায়গা।

বাড়ির ছাউনিতে কখনও শন, খড়, কখনও মাটির টালি (Interior Design)
সময়টা ডিসেম্বরের শেষ, ঠান্ডায় জমাট চারপাশ। কিন্তু এই মাটির দোতালায় সিঁড়ির পাশে শুয়ে থাকতে আমাদের বেশ গরম লাগছিল। আসলে বাড়ির ভিতর দিকটা খুব সুন্দর এবং পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়েছে। এখনকার মাটির বাড়িগুলিতে অনেকক্ষেত্রে টিনের চাল ব্যবহার করা হলেও, একসময় বাড়ির ছাউনি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত শন এবং খড়, কখনও কখনও মাটির টালি। এই সমস্ত ঘরবাড়ি শীতের সময় ঠান্ডা বাতাস প্রতিরোধে যেমন সক্ষম তেমনই বর্ষাকালে বৃষ্টি এবং গরমকালে উত্তাপ প্রতিরোধেও সক্ষম। মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো অত্যন্ত চওড়া, প্রায় ইঞ্চি কুড়ি মত, তবে কখনও ভিতরের মাটির দেওয়ালগুলো কিছুটা কম চওড়া হত।

মাটির বাড়িগুলির ঘরের উচ্চতা যে খুব বেশি হত এমনটা নয়। বলা যেতে পারে আজকালকার ফ্ল্যাট বাড়িগুলির মতই হত। ঘরের ছাউনি টিন এবং টালি দিয়ে দেওয়া হলেও একটু অবস্থাপন্ন বাড়ির মানুষেরা কাঠের বীম এবং পাটাতন সহযোগে ফলস সিলিংয়ের মতো বানিয়ে ফেলতেন। কাঠের জায়গায় অনেকে ঘাসবোর্ড ব্যবহার করতেন। এই সমস্ত বাড়িগুলির আলোর ব্যবস্থা করতে কেরোসিনের কূপি, লন্ঠন কিংবা মাটির প্রদীপ জ্বালানো হত। সেই হ্যাজাক কারও বাড়িতে কেনা থাকত আবার কেউ বা হ্যাজাক ভাড়া করে নিয়ে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে অন্দরসজ্জার থেকেও গুরুত্ব পেত পুরো বাড়ির চত্বরটা জুড়ে একটা নিপুণ সুন্দর প্ল্যান। তুলসীমণ্ডপ থেকে গোয়ালঘরটা পর্যন্ত এক নিপুণ শিল্পীর প্ল্যানে সাজানো থাকত। বাড়িগুলি বেশিরভাগ সময় হত দক্ষিণমুখী। দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক খোলা রাখা হত। বাড়ির চারপাশে এমনভাবে গাছ লাগানো হত যাতে উঠোনে গাছের ডালে আটকে গিয়ে রোদ পড়তে অসুবিধে না হয়। আবার একইভাবে বিকেলের রোদ প্রতিরোধ করার জন্য বাড়ির পশ্চিম দিকে থাকত উঁচু বেড়া। এখন যেমন একটা বাড়ির সুন্দর অন্দরসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশের ল্যান্ডস্কেপ, গার্ডেন এসব সাজিয়ে তোলেন একজন অন্দরসজ্জাবিদ, গ্রামের বাড়িগুলো ঠিক ততটাই প্ল্যানমাফিক সাজিয়ে তোলা হত।
নববর্ষের বিশেষ এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আধুনিক বাঙালি বাড়ির অন্দরসজ্জা না ছুঁয়ে বরং চেষ্টা করলাম বাঙালির গর্বের ঐতিহ্য কিছুটা স্পর্শ করে আসতে। আজকের বাঙালির অন্দরসজ্জার মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকলেও সেদিনের বাঙালি বাড়ি এবং অঙ্গনের সাজ ছিল একেবারেই মৌলিক।