Latest News

Bengali Delicacy: গোপন আবির, মনকেমন আর বসন্তের অচেনা রেসিপি

সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু

Image - Bengali Delicacy: গোপন আবির, মনকেমন আর বসন্তের অচেনা রেসিপি

পেপারে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বসন্ত উৎসবের ছবিগুলো আয়েশা খুব মন দিয়ে দ্যাখে। লাল বা সবুজ পাড়ওয়ালা হলুদ শাড়িতে এক একটা মেয়ে বসন্তের বউ কথা কও পাখি হয়ে ওঠে। (Bengali Delicacy)
হলুদ রঙের কত্তরকম শেড! ফিকে হলুদ, কুসুমরঙা হলুদ, খুব পেকে যাওয়া পাতিলেবুর মতো হলুদ, গুরু পূর্ণিমার চাঁদের মতো হলুদ। সেদিন অনিন্দ্য ওর গ্রামের বাড়ি থেকে হলুদ রঙের পলাশ এনে দিয়েছিল চৈতীর জন্য। হলুদ রঙের পলাশ আগে কখনও দ্যাখেনি আয়েশা। আগুনরঙা পলাশকেই শুধু চেনে সে। চৈতী ফুল ভালোবাসে। অনিন্দ্য ভালোবাসে চৈতীকে। চৈতী সেই ফুল মাথায় গুঁজলো, মালা গেঁথে গলায় পরল। ফেসবুকে ছবি দিল। ক্যাপশন দিল ‘ফুল -ফাগুন’।
আয়েশাদের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকে চৈতী। মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি। এমনই সে গণ্ডগ্রাম যে ইন্টারনেট সার্ভিস খাবি খায় সবসময়। বেসরকারি অফিসের ওয়ার্ক ফ্রম হোম করল কলকাতাতে বসেই। বাড়িতে নানান ঝামেলা। মাথার ওপর জেঠুর কর্তৃত্ব। মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা চাপিয়ে দিতে চায় চৈতীর ওপর। অনিন্দ্যও গ্রামের ছেলে। বাঁকুড়ার ওদিকে কোথাও ওর গ্রামের বাড়ি। বয়সে চৈতীর থেকে বেশ বড়। ব্যাঙ্কে কাজ করে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য টাকাপয়সা জমিয়েছে। ভালো ছেলে। রসিক। খুব হাসাতে পারে। ও মাঝে মাঝে আসে। তখন চৈতী আয়েশাকে ওর ঘরে ডেকে নেয়। খুব আড্ডা হয়।

চৈতীর থেকে আয়েশা অনেকটাই বড়। তবু চৈতী ওকে নাম ধরেই ডাকে। দিদি বা দিদিয়া বলে না। আয়েশার আব্বু মারা যাওয়ার পর মোটা পেনশন পায় আয়েশার মা। তাতে আরামসে সংসার চলে যায়। বন্ডেল রোডে নিজেদের বাড়ি। একতলায় একটা বড় ঘরে আয়েশা চারজন মেয়েকে নিয়ে নকশি কাঁথার কাজ করে। সুতির কাপড়ের ওপর সুতোর কাজ। রাসবিহারী এভিনিউয়ের একটা দোকান কাঁথাগুলো উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নেয়। এখন এইসব হাতের কাজের খুব চাহিদা। চেনাজানা মানুষরাও অর্ডার দেন। কারও অনুরোধে কবিতার লাইন বা গানের লাইন সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আগে নিজে হাত লাগাত, এখন ওই মেয়েগুলো নিজেরাই এত দক্ষ হয়ে গেছে যে তাকে হাত লাগাতে দেয় না। বলে “দিদি তুমি সামনে বসে থাকো শুধু।” আশেপাশেই থাকে ওরা। একজন কেবল সুভাষগ্রাম থেকে আসে। আয়েশা ঠিক করে রেখেছে চৈতীর বিয়েতে নিজের হাতে একটা কাঁথা তৈরি করে নবদম্পতিকে উপহার দেবে। পুরোটা সে নিজে সেলাই করবে। মরিয়ম, তুহিনা, কাজল বা মোতির মাকে একদম হাত লাগাতে দেবে না।

কাঁথার বর্ডারে কবিতার লাইন লিখবে। সবুজ আর লাল সুতোয়। বিয়েটা হলে হয়!

অনিন্দ্য ব্রাহ্মণ নয় বলে চৈতীর জেঠু আর বাবা অনিন্দ্যকে চৈতীর বর হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে চাইছে না। আশ্চর্য হয় আয়েশা। হিন্দু মুসলমানের মধ্যেই কত না দ্বন্দ্ব! তাতেও হচ্ছে না! হিন্দুদের নিজেদের ভেতরেও গোত্র ফোত্র নিয়ে কতরকম বিভাজন! ভালোবাসার চেয়ে এইগুলো বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে চৈতীর পরিবারের কাছে। আয়েশা ভাবে মুসলিমদের মধ্যেও কি বিভাজন নেই! হানাফি, ফরাজি, শেখ, কুরেশি, শিয়া, সুন্নি। চারিদিকে শুধু বিভেদের ছবি।

চৈতীর একটা বড় বদভ্যাস আছে। গাছ থেকে পটাং করে ফুল ছিঁড়ে নেয়। এই সবে গন্ধরাজ গাছটায় ফুল ধরেছে। চৈতী তুলে নিয়ে ঘরের টেবিলে রেখে দিল। আরে বাবা জানলার কাছেই তো গাছটা! সারারাত গন্ধ ছড়াতো। বললে বলবে “যা মশা! জানলা লাগিয়ে শুলে কীভাবে গন্ধ ঢুকবে!”

অনিন্দ্য বলে “ফুলগুলোকে গাছেই বেশি মানায়।”

চৈতী ঠোঁট ফুলিয়ে ঝগড়া করে “তার মানে আমার খোঁপায় মানায় না?”

অনিন্দ্য তো একদিন বলেই ফেলল “একমাত্র আয়েশার মস্ত খোঁপাতেই ফুলের শোভা বাড়ে”। ভাগ্যিস কথাটা চৈতী শোনেনি! শুনলে খুব রাগ করত। অথবা অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে রাখত। অনিন্দ্যকে চৈতীর অভিমান ভাঙাতে নিজের চোখে দেখেছে আয়েশা। দেখে গা শির শির করেছে। চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মন সরিয়ে নিয়েছে। মন কি সত্যিই সরাতে পেরেছে? অনিন্দ্য এলে ওর নিজের ভালো লাগে কেন? কেন অনিন্দ্য এলে যা হোক কিছুমিছু রাঁধতে বসে!

পাড়া প্রতিবেশীরা বলে আয়েশার বিয়ে হয়নি। ওটা ঠিক কথা নয়। সে নিজেই বিয়ের দিকে ঝোঁকেনি। তার মাকে এত বড় বাড়িতে একা ফেলে সংসার করতে মন চায়নি। আবার ঘরজামাই হিসেবে কাউকে মেনে নিতে মায়ের সমস্যা ছিল। এইসব নানান টানাপোড়েনে বিয়ের সেই মারাত্মক ইচ্ছেটা কবে যেন নষ্টই হয়ে গেল।

হলুদ পলাশ এই প্রথম দেখল আয়েশা। হলুদ পলাশ এখন চৈতীর খোঁপা থেকে স্থানচ্যুত হয়ে চেয়ারের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। কলকাতায় রুদ্র পলাশ গাছ প্রচুর দেখেছে আয়েশা। উদ্ধত, দুর্বিনীত রুদ্র পলাশ। তার তুলনায় হলুদ পলাশ অনেকটাই নম্র। স্নিগ্ধ। আয়েশা ফুলগুলোকে চেয়ার থেকে তুলে একটা চিনামাটির প্লেটে রেখে দিল। গন্ধ নেই। গন্ধ বেরোবার আশাও নেই, তবুও ফুলগুলোর গায়ে একটু জল ছিটিয়ে দিল আয়েশা। চৈতী একইরকম দুটো শাড়ি কিনেছে। মুচকুন্দ চাঁপার মতো হলুদ। পাড়ে ফুলছাপ। ব্যারাকপুরের গয়নাঘর থেকে পলাশ ফুলের গয়না কিনেছে। অরুণিমা দারুণ বানায় এই গয়নাগুলো। এমনই দারুণ যে আসল ফুলের সঙ্গে গুলিয়ে যায়।

গাছেই ফুল মানায়… আয়েশাও তাই ভাবে।

Image - Bengali Delicacy: গোপন আবির, মনকেমন আর বসন্তের অচেনা রেসিপি

আজ দোল। আয়েশা এবং চৈতী একইরকম সেজেছে। একই রঙের শাড়ি। চুল বাঁধার স্টাইলও এক। গলায়, কানে পলাশ ফুলের গয়না। আজ চৈতী রান্না করেছে চিকেন। গন্ধরাজলেবুর পাতা দিয়ে মুগডাল। আয়েশা বানিয়েছে কুমড়ো ফুলের বড়া। বড়ার ভেতরে বিভিন্নরকম মশলার পুর দেওয়া। আর বানিয়েছে পোড়া বেগুনের কোপ্তা। একটু বেলার দিকে ভেষজ আবির নিয়ে অনিন্দ্য আসবে। ওই আবিরে নাকি চুল বা ত্বকের কোন ক্ষতি হবে না! কে জানে! আয়েশা জীবনে রং খেলেনি। অমুসলিম বন্ধুরা হৈ হৈ করে দুদিন রং খেলত। তাকেও কেউ রং দিক- মনে মনে খুব চাইত আয়েশা। বন্ধুরা জানত হাজী সাহেবের বাড়ির আশেপাশে রং খেলা যাবে না। আব্বু এসব রং টং খেলা একদম পছন্দ করত না। আব্বু মারা যাওয়ার পর রং খেলাতে আর কোনও বাধা না থাকলেও ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। পনের ষোল বছর বয়সের ইচ্ছেরা কি আর আটত্রিশ বছর বয়সে মাথা চাড়া দেয়!

ছাদে রং খেলা হবে। মনে মনে হাসে আয়েশা। আসল রং খেলা হবে তো দুজনের মধ্যে! আয়েশা কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করবে।

চৈতী ছাদের টবগুলো একপাশে সরাতে ব্যস্ত। ছাদের মধ্যেখানটা ফাঁকা না রাখলে হবে!

আয়েশা খেয়াল করল চৈতী কানে পলাশের দুল পরেনি। তাড়াহুড়োতে ভুলে গেছে মেয়েটা। ঘরে রেখে এসেছে। এদিকে আয়েশার দোলের সাজ কমপ্লিট। আয়েশাই গেল চৈতীর ঘরে। দুলটা কোথায় যে রেখেছে মেয়েটা! উবু হয়ে ড্রেসিং টেবিলের নীচের ড্রয়ারটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরল তাকে। ওই শক্ত বেষ্টনী থেকে নিজেকে আলগা করার চেষ্টা করার মাঝখানেই এক খাবলা রং কে যেন তার মুখে লেপে দিল! বাঁধন আলগা হতেই ঘুরে তাকাল আয়েশা….

অনিন্দ্য! অনিন্দ্যর মধ্যে কোনও সংকোচ বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখতে পেল না। তবে মুখে বলল “সরি। আমি পেছন থেকে চৈতী ভেবেছিলাম!”

উঠে দাঁড়ালো আয়েশা। সামনে আয়না। গোলাপি আবিরে রাঙানো নিজের মুখটাকে ভীষণ অচেনা ঠেকল। আয়নাতে আর একটা অবয়ব। ঠিক তার পাশটিতে। এক ফ্রেমে আয়েশা আর অনিন্দ্য।
“আপনি ছাদে যান, আমি মুখ ধুয়ে যাচ্ছি।”

অনিন্দ্য চলে গেলে বেশ কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকল আয়েশা। অনিন্দ্য আর চৈতীর বিয়েতে যে নকশি কাঁথাখানা সে উপহার দেবে, সেই কাঁথার পাড়ে লাল আর সবুজ সুতো দিয়ে যে কবিতার লাইনগুলো লিখবে…মনে মনে আউড়ে নিলো আয়েশা। তারপর নিজের গোলাপি মুখের সেলফি নিলো। একটা। দুটো। তিনটে। থাকুক। এই রংটুকু গোপনে থাকুক।

পুর ভরা কুমড়ো ফুলের বড়া

উপকরণ: কুমড়ো ফুল ৬টা,বেসন,চালের গুঁড়ো, নুন, সর্ষে পোস্ত নারকেল কাঁচালঙ্কা একসঙ্গে বাটা তিন টেবিল চামচ, ভাজার জন্য তেল।

প্রণালী: একটা বাটিতে সর্ষে বাটা, নারকেল বাটা, পোস্ত আর কাঁচা লংকা বাটা একসঙ্গে নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হতে। এই মিশ্রণে দুচার ফোঁটা সর্ষের তেল মেশাতে হবে। মিশ্রণটা বেশ গাঢ় হবে। এটাই পুর। কেউ ইচ্ছে করলে এর সঙ্গে একটু চটকানো ছানাও দিতে পারেন।
এবার একটা ব‍্যাটার বানাতে হবে। বেসন, চালের গুঁড়ো, এক চিমটে নুন আর পরিমাণমতো জল দিয়ে একটা থকথকে মিশ্রণ বানাতে হবে। তারপর কুমড়ো ফুলটাকে আস্ত রেখে অতি সাবধানে পরাগরেণুটা বের করে ফেলে দিতে হবে। এবার ফুলের মধ্যে নারকেল-সর্ষে-পোস্তর পুর ভরে সেই পুরভরা ফুলটাকে বেসনের মিশ্রণে চুবিয়ে ছাঁকা তেলে ভেজে নিতে হবে।

পোড়া বেগুনের কোপ্তা

উপকরণ: একটা বড় সাইজের বেগুন, অল্প ছোট চিংড়ি, পেঁয়াজ কুচি, পেঁয়াজ বাটা, আদা রসুন বাটা ,কাঁচা লংকা বাটা, তেজপাতা, আস্ত জিরে, গোলমরিচের গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, লংকা গুঁড়ো, কাশ্মীরি লংকার গুঁড়ো, নুন, অল্প চালের গুঁড়ো, সর্ষের তেল, চার পাঁচটা আস্ত কাঁচালংকা, চার টুকরো টমেটো,গরম মশলার গুঁড়ো।

Image - Bengali Delicacy: গোপন আবির, মনকেমন আর বসন্তের অচেনা রেসিপি

প্রণালী: বেগুনের গায়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে গ্যাসে তারজালি বসিয়ে তার ওপর বেগুনটাকে রেখে পুড়িয়ে নিন। ঠান্ডা হলে খোসা ছাড়িয়ে মসৃণ করে মেখে একপাশে রেখে দিন। চিংড়ি খোলা ছাড়িয়ে ধুয়ে নিন। কড়াইতে খুব সামান্য তেল দিন। তারপর পেঁয়াজকুচি ভাজুন। খুব বাদামি করবেন না। এবার ওতে নুন, হলুদ, লংকাগুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে চিংড়ি মাছগুলো দিন। মাছ একটু নরম হলে এবং চিংড়ির গায়ে মশলা লেগে গেলে নামিয়ে নিন।

বেগুন যেটা মেখে রেখেছিলেন ওর মধ্যে নুন, কাঁচা লংকাবাটা আর অল্প চালের গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে মাখুন। মাখাটা একটু থসথসে হবে। ঘাবড়ে যাবেন না। হাতের তালুতে একটু তেল লাগিয়ে নিয়ে অল্প অল্প করে বেগুনের মিশ্রণ তুলুন আর গোল্লা পাকানোর চেষ্টা করুন। গোল্লার মাঝখানে তিন চারটে করে মশলা-মাখা চিংড়ি ভরে গোল্লাগুলোকে গরম তেলে ভেজে নিন। ডুবো তেলে নয় ,খুব অল্প তেলে আঁচ কমিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাজুন। ভাজা হলে তুলে নিন। ওই কড়াইতেই অল্প সর্ষের তেল দিন।

তেল গরম হলে জিরে এবং তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ বাটা দিন। ভাজা হলে আদা-রসুন বাটা এবং সমস্ত গুঁড়ো মশলা দিয়ে কষুন। টমেটো এবং নুন দিন। আবার মশলা ভালো করে কষিয়ে জল দিন। ঢেকে দিন। একটু পর ঢাকা খুলে বেগুনের কোপ্তাগুলো দিয়ে আবার ঢেকে দিন। নামানোর আগে কোপ্তাগুলো একবার সাবধানে উল্টে দিয়ে গরম মশলার গুঁড়ো এবং আস্ত কাঁচা লংকা দিয়ে ঢেকে গ্যাস অফ করে দিন।

বাংলা ছবির দোলের দলিল, ফাগুনে-আবিরে-প্রণয়ে-বিরহে রুপোলি পর্দায় রঙের বাহার

You might also like