শেষ আপডেট: 9th January 2025 22:50
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শীতকাল পড়ে গিয়েছে। মাঝে একটু টালবাহানা করলেও মকর সংক্রান্তি কাছে আসতেই ইউ-টার্ন নিয়ে ফের রাজ্যে দাপট দেখাতে শুরু করেছে ঠান্ডা। ভোজনরসিক বাঙালির কাছে শীতকাল মানেই একটা স্পেশ্যাল আকর্ষণ। ডিসেম্বর মাস এসে গেলেই অফিসিয়ালি শীতের কাউন্টডাউন শুরু হয়। তা যত শেষের দিকে যায় আবহাওয়ার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বছর শেষ ও নতুন বছর শুরুর উন্মাদনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে যেমন তেরো পার্বণ, আর সেখানে খাওয়াদাওয়া থাকবে না তা একেবারেই হয় না। শীতকালে যেসব জিনিস নিয়ে মানুষের উন্মাদনা বেশি থাকে তার মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতেই রয়েছে জয়নগরের মোয়া। শুধু মোয়া নয় এই সময় নলেন গুড়ের নাম না নিলে বাঙালিরা একটু চোখ অবশ্যই বেঁকাবেন। কিন্তু জয়নগরের মোয়া এখন আর কেবল জয়নগরে নয়, বানানো হয় বহু জায়গায়। ফলে নকলের ভিড়ে আজ হারিয়ে যাচ্ছে আসল মোয়া।
কীভাবে চিনবেন খাঁটি জয়নগরের মোয়া? তা জানতে কেনার আগে কয়েকটি বিষয় একটু মাথায় রাখলেই হবে।
আসল মোয়া কোথায় পাবেন
মোয়া আদতে কী তা জানতে প্রথমেই চলে যেতে হবে শিয়ালদহ শাখার দক্ষিণে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে জয়নগর মজিলপুরে। লোকাল ট্রেনে চেপে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সেই মোয়ার দেশে। প্রশ্ন উঠতেই পারে শীতকালে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মোয়া বিক্রি হয়।
কিন্তু জয়নগর কেন? কারণ খুঁজলে জানা যায় মোয়া তৈরির জন্য বিশেষ যেটা উপকরণ সেই কণকচূড় ধানের খই বা খাঁটি নলেন গুড় সেটা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আবহাওয়াতেই ভাল হয়। জয়নগর মজিলপুরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মোয়ার আবিষ্কার প্রথম এখানেই হয়। স্টেশনের কাছেই শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার অর্থাৎ বুঁচকি বাবুর হাত ধরেই মোয়ার সঙ্গে মানুষের পরিচয়।
কোন সময় পাবেন মোয়া?
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বছরভর জয়নগরের মোয়া পাওয়া গেলেও জানেন কি মোয়া শুধুমাত্র শীতকালেই তৈরি হয়! এ সময় জয়নগরে একবার ঢুঁ মারলে দেখবেন শুধুমাত্র জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে মোয়ার দোকান। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা অন্য ব্যবসা করলেও শীতকালে মোয়ার ব্যবসা হাতছাড়া করতে চান না। যদি পুরসভার বিচারে হিসেব করা হয় তাহলে জয়নগর পুরসভার ১১ ওয়ার্ড মিলিয়ে যা দোকান রয়েছে গুণে শেষ করা অসম্ভব। কিন্তু জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর স্বীকৃত কিছু দোকান রয়েছে যারা সত্যিই মোয়ার গৌরব বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তবে জাঁকিয়ে শীত না পড়লে মোয়া কিনতে এসে নিরাশ হবেন। কারণ ঠান্ডা বাড়লে তবেই খাঁটি নলেন গুড় পাওয়া যায়। যা মোয়া তৈরির অন্যতম উপকরণ।
হাজারো দোকানের মাঝে আসল চিনুন
এই সময়ে জয়নগরে একশো শতাংশ মোয়ার দোকান থাকলে পুরনো মিষ্টির দোকান বা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ঘেঁটে তবেই টাকা খরচ করুন। জয়নগরে নেমে যা পেলাম সব অমৃত এমন ভাবলে ভুল করবেন। জয়নগর থেকে মোয়া নিয়ে যাবেন বটে তবে আসল পাবেন কী না বলা মুশকিল। কীভাবে জানবেন আসল ঠিকানা? বর্তমান দিনে ইন্টারনেটে নজর রাখলে অনেক দোকানের নাম উঠে আসবে। অনেক দোকান মোয়ার সূচনা লগ্ন থেকে যেমন জনপ্রিয় তেমনি কিছু নতুন দোকানের মোয়াও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দৈনিক বা মাসিক আয় ব্যয়ের হিসাব করলে জয়নগরের সবচেয়ে বেশি মোয়া বিক্রি হয় রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকেই। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার বা খোকনের মোয়ার নাম একটু হলেও এগিয়ে। এছাড়া মধূসুদন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মুক্তরাম সুইটস, কমলা সুইটস, লোকনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার-সহ অনেক দোকান আছে। তবে যেখান থেকে কিনবেন দেখে নেবেন দোকান জিআই সার্টিফায়েড কি না। তবেই কিনুন, নাহলে না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এই এলাকার মোয়ার স্বাদ অন্যত্র নেই। শহর কলকাতায়-পথে-ঘাটে হলুদ সেলোফেনে চাপা দিয়ে মোয়ার মতো দেখতে কিছু জিনিস বিক্রি হয়। শহরে ১০০ টাকার প্যাকেটে যেগুলো বিক্রি হয় তা মরিশাল ধানের খই। অনেকে আসল জয়নগরের মোয়া ভেবে খেয়েও নেন। কিন্তু ওস্তাদ খাইয়েদের মুখে জয়নগরের মোয়া পড়লে এক মুহূর্তে ধরে ফেলবেন।
বহড়ু নাকি জয়নগর, মোয়া কার?
মোয়া কার বহড়ুর নাকি জয়নগরের? এ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। অনেকে বলেন, জয়নগরে সেই আগের মোয়া নেই, মোয়া মানে বহড়ুর। আসল বিষয় খোলসা করা যাক জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রে পড়ে বহড়ু। থানা জয়নগর। সড়ক পথে জয়নগর স্টেশন থেকে বহড়ু স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। সেখানেও শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভান্ডারের মতো একাধিক দোকান রয়েছে যা মোয়ার গরিমা বাড়িয়েছে। তবে ব্যবসায়িক দিক ও দৈনিক বেচাকেনার হিসাবে জয়নগরের বহু দোকান বহড়ুকে বলে বলে গোল দেবে। তবে বর্তমানে ভেদাভেদ ভুলে মোয়ার রফতানি বাড়াতে এক হয়েছে জয়নগর-বহড়ু মোয়া ব্যবসায়ীরা।
মূলত সোশ্যাল মিডিয়া ও রিয়েলিটি শোতে বহড়ু ও জয়নগরের অনেক মোয়া ব্যবসায়ী জনপ্রিয় হয়েছেন। সেখান থেকেই বেড়েছে ব্যবসা। বহড়ুর শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভান্ডার বা জয়নগরের নতুন খোকনের মোয়া বা লোকনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মতো অনেক দোকানের মালিকরা টিভির পর্দায় মুখ দেখিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, বেড়েছে ব্যবসাও।
আসল মোয়া কিনতে কত খরচ
রাজ্যের অনান্য প্রান্তের মতো দেড়শো-দু'শো টাকা প্রতি কেজি দামের মোয়াও জয়নগরে যেমন পাবেন কিন্তু ভাল মোয়া খেতে গেলে কম করে হাজার টাকা খরচ করতে হবে। ব্যবসায়িক দিক থেকে বিচার করলে যেমন দাম, যেমন দোকান ঠিক তেমন মানের মোয়া পাবেন এটা স্বাভাবিক। কম দামের মোয়াও পাওয়া যায় কিন্তু তা কিনতেও প্রতি কেজি ৫০০ টাকা খরচ। কণকচূড় ধান, নলেন গুড়, ঘি, পেস্তা, কাজু, কিশমিশের মান ও পরিমাণের উপর দাম ওঠানামা করে।
কতদিন পাওয়া যায়?
যতদিন শীত, জয়নগরে মোয়ার ব্যবসা ততদিনের। ঠান্ডা শেষের সঙ্গে সঙ্গে জয়নগরে স্তব্ধ হয়ে যায় মোয়া বিক্রি। অন্য সময়ে বাইরের যে কোনও প্রান্তে মোয়া পেলেও সেটা যে জয়নগরের এমন ভাবলে ভুল হবে। সরস্বতী পুজোর পর শীত বিদায় নিলে মোয়ার ব্যবসাও শেষ হয়ে যায়।
মোয়ার হাব
জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে পুরসভার একটি মাঠ। সেখানে সাড়ে চার কাঠা জমিতে গড়ে উঠেছে মোয়া হাব। দু’কোটি ১২ লক্ষ টাকা খরচ করে প্রজেক্ট হয়েছে। চলতি বছরে মোয়ার মরসুম শুরুর আগেই হাবের উদ্বোধনের কথা থাকলেও বারবার জায়গা বদলের পরিকল্পনা হওয়ায় কাজ থমকে ছিল। তবে জয়নগরে হাব তৈরির পরিকল্পনা হয় প্রায় তিন বছর আগে।
প্রথমে জয়নগরের সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল ও পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুজিত সরখেলের উদ্যোগে মিত্রগঞ্জে জায়গা দেখা হয়েছিল। কিন্তু সেই জায়গা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল খাদি বোর্ড। ফলে কাজ পিছিয়ে যায়। এরপর পুরসভার ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। চেয়ারম্যান সুকুমার হালদার হাব তৈরির জন্য তিন নম্বর ওয়ার্ডে জায়গা চিহ্নিত করেন। গত জানুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু হয়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী জয়নগরের বহড়ুতে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে এসে মোয়া হাবের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন। তবে সব কাজ শেষ হলেও শুধু প্যাকেজিং মেশিন নেই বলে হাবের উদ্বোধন হচ্ছে না। মেশিন এলেই দ্রুত কাজ শেষ করে উন্নত প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে মোয়া রফতানি করা যাবে বলে মত ব্যবসায়ীদের।
আগ্ৰা হোক বা আমদাবাদ এক ক্লিকে মিলবে মোয়া
এখন অনলাইনে বাড়িতে বসেও মোয়া পাওয়া যায়। আগ্রা হোক বা আমদাবাদ। ঘরে বসে বেছে নিন মোয়া-মেনু। www.joynagar.com চালু করেছেন জয়নগর-বহড়ুর মোয়া ব্যবসায়ীরা। গাড়ি মোয়ার দোকান থেকে থরে থরে মোয়া নিয়ে সোজা কলকাতা বিমানবন্দরে আসে। সেখান থেকে দেশে বিদেশে পৌঁছে যায়। তবে চোখে পরখ করে দেখে কিনলে রথ দেখা, কলা বেচা দুটোই হবে। নতুন বছরের শুরুতে ছুটি দেখে একবার ঢুঁ মারতেই পারেন।