শেষ আপডেট: 10th September 2022 10:16
উৎসবের সঙ্গে প্রকৃতির এমন নিখুঁত মেলবন্ধন আর কখনও দেখিনি। আকাশের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে কতই না ছবি! শরতে ক্যানভাসটার রং হয়ে যায় গাঢ় নীল। আলাদা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। উৎসব এগিয়ে আসছে বুঝিয়ে দেয় তুলো তুলো মেঘের দল। শিউলি গাছগুলো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বারোমেসে শিউলিও এই সময়টাতে বেশি বেশি ক'রে ফুটে ওঠে। বাজার আলো করে তোলে সাদা বেগুনি লাল শাপলারা। বাড়ি ফেরার সুর বেজে ওঠে বাঙালির মনের মধ্যে।
ঈদের সঙ্গে চাঁদের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে ঠিকই তবে দুর্গাপুজোর আগে যেভাবে প্রকৃতি সেজে ওঠে, এমনটি আর কোনও উৎসবে দেখা যায় না। দিঘির পদ্ম, নদীর ধারের কাশবন, উঠোন জুড়ে শিউলির আলপনা’— এসব তাঁর আগমনীবার্তা।
ঘর সাজাতে হবে। নিজেকেও সাজাতে হবে। পুজোর আগের আবহাওয়া ঘরদোর রং করার জন্য আদর্শ। রঙের পোঁচ লাগে অনেক বাড়িতে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাড়ির ছেলেমেয়েরা পুজোর কটা দিন বাড়ি ফিরবে, আনন্দ করবে। পছন্দমতো খাবার খাবে।
পুজো মিটে গেলে যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে, তাদের বুকের ভেতরে আবার অন্য বাঁশি বাজে। সে বাঁশির সুরে অজানা আনন্দ নাকি অজানা আতঙ্ক থাকে, সে উত্তর একমাত্র ভবিষ্যতই দিতে পারে। প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রেও নিজের বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাবার প্রাক্কালে একটা মনকেমনের সুর বেজে ওঠে বুকের মধ্যে। যে মেয়েকে তার মা উঠতে বসতে খিচির খিচির করতেন… "ওরে একটু কাজকম্ম শেখ ভালো করে, নিজে মাছ পছন্দ করিস না বলে মাছের ঝোলটাও রাঁধা শিখলি না! শাশুড়ি মুখ করবে আর বলবে মা কিচ্ছু শিখিয়ে পাঠায়নি..." ’— সেই মা'ও পুজোর সময় মেয়েকে একটু আহ্লাদ দেন। আর কটা দিন পরেই তো চলে যাবে মেয়েটা! একটু আনন্দ করুক। গোপনে চোখের জল মোছেন। মেয়ের মনে নানান ভাবনা দোলা দেয়। আচ্ছা বিয়ের পরে এই নিজের বাড়িটা নিজেরই থাকবে তো! তার ভাই,বোন একইরকমভাবে তাকে ভালোবাসবে? এই বাগান, বাগানের চাঁপাগাছটা, পেয়ারাগাছটা তাকে মনে রাখবে? নাকি বিয়ের পর সে অতিথির মতো আসবে আর যাবে! টিনের ছোট্ট সুটকেসটায় জমিয়ে রাখা বন্ধুদের চিঠি, পুরী থেকে আনা রঙিন ঝিনুক, ময়ূরের পালক, মেজ মাসির দেওয়া হাতির দাঁতের দুল, শরৎচন্দ্রের 'রামের সুমতি', প্রতিভা বসুর 'জীবনের জলছবি' মা যত্নে রেখে দেবে? এইসব ভাবনা এলেই চোখ জ্বালা করে। কতটা পরিবর্তন হল জীবনের, আর এই বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা আলগা হল সেটা পরের পুজোতে বোঝা যাবে।
হরিমতি বালিকা বিদ্যালয় যে মেয়েটির শিক্ষার ভিত গড়ে দিয়েছিল, সেই মুসলিম মেয়েটির কাছে ঈদের খুশি আর পুজোর আনন্দ একইরকম ছিল বললে মিথ্যে বলা হবে। ঈদের দিনে ভালোমন্দ খাওয়া আর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা হওয়া— এটুকুই ছিল ঈদের প্রাপ্তি বা খুশি উদযাপন। পুজো মানে ছিল আরেকটু বেশি খুশি। স্কুল কলেজের লম্বা ছুটি। বন্ধুদের চিঠি লেখার সুখ। অষ্টমী বা নবমীতে বিকেল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বেলডাঙা বাজারের প্রতিটা প্যান্ডেল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটু রাত করে বাড়ি ফেরা। প্রতিটা প্যান্ডেলে বেজে উঠা বাংলা গান আর সেই গানের কলিকে মনের মধ্যে গেঁথে বাড়ি ফেরা।
'আমার পূজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে ,তুমি যেন ভুল বুঝো না'... 'মহুয়ার জমেছে আজ মউ গো'…
'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে'… এসেছিল কি? মেয়েটা বুঝতে পারে না। ১৯৯৪ সালে সেরকম একটা পুজো কাটানোর পর কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। সেবার পুজোয় বাংলা গানের সঙ্গে একটা বিশেষ হিন্দি গান প্যান্ডেলে ব্যাপক তুফান তুলল। 'দিদি তেরা দেবর দিবানা...'
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দিদিদের দেবরেরা মাঞ্জা দিয়ে ঘুরলেও অতটা আগ্রহ দেখায়নি মেয়েটা। পরের মাসে আশীর্বাদের পরেরদিনই কোনওরকম পরিকল্পনা ছাড়াই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল। মুর্শিদাবাদ থেকে উত্তর চব্বিশ পরগণার একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে মেয়েটি অবাক হয়ে দেখল শ্বশুরবাড়িতে তারও একখানা রেণুকা সাহানির মতো সলমন খান টাইপের 'দেবর' আছে।
মেয়েটি সুন্নি, ছেলেটি শিয়া। মানুষজন শিয়া-সুন্নিতে লাঠালাঠি কাটাকাটি দেখেছে, কিন্তু বিয়ে দ্যাখেনি। মজা দেখার জন্য রাত ১২টায় ওই অজ পাড়াগাঁয়ে মেলা বসে গেল। ছেলে তার জামাইবাবু আর দু চারটে বন্ধু নিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে একেবারে বিয়ে করে ফিরেছে— এমন অস্বাভাবিক ঘটনা দেখার জন্যে ব্যাপক ভিড় জমে গেল। মেলা-মেলা ভাব দেখে একজন ফচকে কিশোর বলা কওয়া নেই হঠাৎ ভেঁপু বাজাতে শুরু করে দিল। দুধের বাচ্চাদের পাকা ঘুম চটকে যাওয়ায় তারা কিচ্ছু বুঝতে না পেরে বিকট জোরে কাঁদতে শুরু করল। শিশুদের কান্না ভীষণ সংক্রামক। সেই বীভৎস কান্না এপাড়া সেপাড়া হয়ে শেষে বেপাড়ায় গিয়ে মিলিয়ে গেল।
তিন মুখওয়ালা বিশাল মাটির চুলোয় একদিকে নারকেলের দুধে আতপচাল ফুটতে শুরু করল। কে একজন কোত্থেকে বিলিতি আমড়া জোগাড় করে আনল। ঘুমন্ত মুরগি আর হাঁসদের ঘুমের দফারফা করে তাদের তুষের ঘর থেকে ডিম সংগ্রহ ক'রে নারকেলের দুধে ডিম-আমড়া রাঁধতে শুরু করল আর একটা দিকের চুলোতে। মাঝখানের চুলোয় ছাঁকা তেলে মশলা মাখানো চাকা চাকা করে কাটা বেগুন ছাড়া হল। শিয়া-সুন্নির বিয়েতে পাত পেড়ে খাবে বলে প্রতিবেশীরা খুব উৎসাহের সঙ্গে কলাবাগানে গিয়ে রাশি রাশি কলাপাতা কেটে আনলেন। বাড়ির লাগোয়া পুকুরে জাল ফেলে রুইমাছ ধরা হল। সেই মাছ ফুলকপি দিয়ে রান্না হল। অ্যাম্বাসেডর থামিয়ে নতুন বর বুদ্ধি করে মসলন্দপুর থেকে অনেক রকমের মিষ্টি, মাখা সন্দেশ, দই ইত্যাদি এনেছিলেন বলে ভোজ মহাভোজে পরিণত হতে পেরেছিল। মুরগির বদলে নারকেলের দুধ দিয়ে হাঁসের মাংস রান্না করা হল। পাড়ার শিয়া প্রতিবেশীরা নতুন বউকে যাচাই করার উদ্দেশ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার তার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। নতুন বউ ট্যাংরা, শিঙি বা মাগুর মাছ খায় কিনা! উফ্! শীতের দুপুরে ডিমভরা দেশি ট্যাংরার ঝাল! তাতে পেঁয়াজকলি বা বড়ি দিলে আরেকরকম স্বাদ। মটরশুঁটি এবং নতুন আলু দিয়ে শিঙিমাছের পাতলা ঝোল! — জিভ ভিজে ওঠে নতুন বউয়ের।
মা ক'ভরি গহনা দিল? বাপের বাড়ি ক'তলা? ’— এসব জিজ্ঞেস না করে তারা খালি জিজ্ঞেস করছিল নতুন বউ ট্যাংরা শিঙি, মাগুর খায় কি না! নতুন বউ প্রশ্নের তল না পেয়ে বরের দিকে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিতে তাকাতেই বর ইশারা করে জানায়, না বল, না…
নতুন বউ তাই করে। জানায় সে ট্যাংরা, শিঙি, মাগুর খায় না। শিয়া প্রতিবেশিনীরা উত্তর শুনে ভারী খুশি হয় আর নতুন বউয়ের চিবুক ধরে নাড়া দেয়। পরে নতুন বউ জেনেছিল যে শিয়ারা আঁশবিহীন কোনও মাছ খায় না। কুসংস্কার বা প্রচলিত কোনো কাহিনির ভিত্তিতেই হয়ত এই নিয়ম গড়ে উঠেছে। তবে খেতে বসে নতুন বউ কিচ্ছু খেতে পারল না। যা খেতে যায় কেমন একটা গন্ধ লাগে। নিজের অঞ্চলের রান্নার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির রান্নার সামান্যতম সাদৃশ্যও খুঁজে পেল না। নারকেলের দুধে ডিম আমড়াও খেতে পারল না। এইরকম অদ্ভুত কম্বিনেশনের খাবার জীবনে খায়নি নতুন বউ। নারকেল দুধের পোলাওয়ের বদলে একটু সাদা ভাত খুঁজছিল সে। ভাজা পেঁয়াজ আর শুকনোলঙ্কা ভাজা দিয়ে একটু আলুসেদ্ধ যদি পেত, কটা ভাত খেতে পারত।
ওই পাড়াতেই বীরভূমের একটা মেয়ে ছিল। তারও কিছুদিন আগে ওই পাড়ার একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েটি তার ঘর থেকে এক বাটি সাদা ভাত আর পোস্ত-নারকেল বাটা এনে দিলে নতুন বউ চাট্টি ভাত খেয়ে শান্তি পেয়েছিল।
নতুন বউ যখন বেশ পুরনো হল, শ্বশুরবাড়ির রান্নার স্বাদ তার জিভে বসে গেছে ততদিনে। আর নারকেলের দুধে ডিম আমড়া এখন তার অন্যতম প্রিয় একটি পদ। সেই কবে শ্বশুরবাড়ি থেকে শেখা নতুন বউয়ের সেই দুটো প্রিয় রান্নার রেসিপি রইল আজ, আপনাদের জন্য। (Food Blog)
উপকরণ: নারকেলের ঘন দুধ এক কাপ, হাঁসের ডিম চারটে, চারটে বিলিতি আমড়া, পেঁয়াজবাটা দু টেবিল চামচ, কাটা পেঁয়াজ হাফ কাপ, রসুনবাটা আধ চা চামচ, আদা বাটা এক চা চামচ, জিরে গুঁড়ো এক চা চামচ, ধনে গুঁড়ো আধ চা চামচ, হলুদ এক চিমটি, লংকা গুঁড়ো এক চা চামচ, নুন, চিনি, গোটা গরমমশলা, তেজপাতা, গোটা কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল।
প্রণালী: নারকেল কুরে তাতে অল্প গরম জল দিয়ে হাত দিয়ে চেপে চেপে দুধ বের করে নিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। আমড়ার খোসা ছাড়িয়ে সামান্য জলে ভাপিয়ে নিয়ে টক জলটা ফেলে দিতে হবে। হাঁসের ডিমগুলো সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে একটু চিরে নুন হলুদ আর লংকার গুঁড়ো মাখিয়ে তেলে হালকা করে ভেজে নিতে হবে। ওই কড়াইতে আর একটু তেল যোগ করে ওতে তেজপাতা আর গরমমশলা ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের সুগন্ধ বেরোলে কাটা পেঁয়াজগুলো ভেজে নেবেন। পেঁয়াজের রং বাদামি হলে পেঁয়াজবাটা দিয়ে নেড়েচেড়ে বাকি বাটা মশলাগুলো দিয়ে কষিয়ে নিয়ে আমড়াগুলো দিয়ে দিতে হবে। মশলার সঙ্গে আমড়াগুলো ভালো করে নেড়ে গুঁড়ো মশলাগুলো দিন, সঙ্গে অল্প নারকেলের দুধও দিতে হবে। মিনিট তিনেক ঢাকা দিয়ে রেখে তারপর ডিমগুলো দিয়ে আর একবার নেড়ে বাকি নারকেলের দুধটুকু দিয়ে দিন। এই রান্নাটা শুধু নারকেলের দুধ দিয়েই হবে। জল না দিলেই ভালো। এরপর নুন দিতে হবে। অনেকটা চিনি দিতে হবে।
ঝোল গাঢ় হয়ে উঠলে চেরা কাঁচা লংকা দিয়ে দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে। (Food Blog)
পোস্ত - নারকেলবাটা
উপকরণ: পোস্ত ২ টেবিল চামচ, নারকেল ১ টেবিল চামচ, নুন, কাঁচালঙ্কা ছ্যাঁচা, কাঁচা সর্ষের তেল।
প্রণালী: নুন দিয়ে পোস্ত আর নারকেল মিহি করে বেটে নিতে হবে। এবার গ্রেটারে কাঁচালঙ্কা ছেঁচে নিয়ে ওর মধ্যে দিতে হবে। তারপর কয়েকফোঁটা সর্ষের তেল দিয়ে পুরো জিনিসটা মেখে নিতে হবে। (Food Blog)
খুব উপাদেয় একটি পদ। গরমভাত দিয়ে অপূর্ব লাগে খেতে।