শেষ আপডেট: 10th September 2023 08:35
সেদিন নীপাকে দেখলাম খুব সকাল সকাল কাজে যাচ্ছে। সাধারণত অত সকালে যায় না। ওর সংসার আছে। স্বামী সন্তান আছে। রান্না করে ঘরদোর গুছিয়ে তারপর কাজে যেতে হয়। তবে ওর স্বামী দেবা নিজে কাজে যাওয়ার আগে রাস্তার কল থেকে খাবার জল এনে দেয়। দুধ, পাউরুটি, ডিম কিনে আনে। ছেলেরা কাছেই একটা ইস্কুলে পড়ে। একজন পাঁচ, আরেকজন ছয়ক্লাসে। ওরা জ্যাম বা জেলি লাগানো পাউরুটি টিফিন নিয়ে যায়। কখনও কখনও ডিম পাউরুটি। আর নীপা কাজে না গেলে আলুর পরোটা। (Food Blog: two unique egg recipes)
যে ক'দিন বৌদি থাকবে না, সে কদিন ছেলেদের টিফিনে দশটাকার কেক নিয়ে যেতে বলেছে নীপা। সকালে উঠে কটা রুটি ওকে বানাতেই হয়। দেবাশিস খেয়ে যাবে। ছেলেরাও খাবে। দেবা বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এক মস্ত বড়লোকের বাড়িতে ড্রাইভারি করে। মাইনে আর দুপুরবেলায় খাওয়া দেয়। ড্রাইভারদের থাকার ঘরও আছে। দেবা থাকে না। তিলজলার এই দুকামরার ভাড়াবাড়িতে রাত্তিরে না ফিরতে পারলে তার মনখারাপ করে। বাড়ি ফেরার জন্য একটা 'টান' লাগে। নইলে সন্ধে ছটায় যার বাড়ি ফেরার কথা, যথাযথ 'টান' না থাকার কারণে তার বাড়ি ফিরতে দশটা এগারোটা বেজে যায়– এমন কত উদাহরণ আমরা দেখি চারপাশে। দেবার একটা নয়, দু-দুটো 'টান'। নিপু আর দীপু। ডিউটির কারণে মাঝেমধ্যে রাত হয়ে যায়। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিপু-দীপুর ঘুমোনোর আগে বাড়ি ফিরতে।
নীপা যে বাড়িতে রান্নার কাজ করে, সেই বাড়ির বৌদি বাপের বাড়ি গেলে নীপাকে একটু সকাল করেই যেতে হয়। দাদাকে চা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে হয়। ঘর মোছা, কাচার জন্য সরিতা বলে একটি মেয়ে আসে বেলার দিকে। বৌদি না থাকলে নীপা ঘরের আসবাবগুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নেয়। কাঠের আসবাবই বেশি। আলমারি ভর্তি বই। গল্পের বই, কবিতার বই। কতগুলো বই তো অ্যায়সা মোটা। তার গল্প পড়তে খুব ভাল লাগে। বইয়ের র্যাক ঝাড়তে ঝাড়তে একদিন হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রেমের গল্প এক পাতা পড়ার পর বইয়ের সঙ্গে একেবারে 'চিপকে' গিয়েছিল। সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে কম বই নিয়েছে! সুনীল গাঙ্গুলির বই পড়তে খুব ভাল লাগত। একবার পড়তে শুরু করলে আর ছাড়া যেত না। শুয়ে ঠ্যাং-এর ওপর ঠ্যাং তুলে বই পড়ার জন্য মায়ের কাছে কম বকুনি খায়নি! মেয়েমানুষ ইস্কুল থেকে এসে বাসন মাজবে, রুটি গোল করা শিখবে তা নয়! খালি গল্পের বই পড়া! মা বলত প্রত্যেক মেয়েমানুষের রান্নাবান্না শিখে রাখা উচিত। রান্না এমন একটা জিনিস, যা দিয়ে সহজেই মানুষের মনে পৌঁছনো যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকদের মন জয় করা যায়।
বিয়ের পর রান্না দিয়ে মন জয় করতে তার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। কটা দিনই বা সে দেবান্দিতে ছিল! হাওড়ার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল দেবান্দি। সেখানেই তার শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের আগে তার স্বামী কলকাতার একটা পত্রিকার অফিসে গাড়ি চালাত। মাইনে ভালই ছিল, কিন্তু ডিউটির ঠিকঠিকানা ছিল না। বিয়ের কিছুদিন পরে একটা ঠিকঠাক জায়গায় চাকরি হতেই বউ নিয়ে কলকাতা চলে এল দেবা। এখানেই পিঠোপিঠি দুই ছেলের জন্ম। ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড– সব হল। চোখের সামনে তিলজলার বস্তি ভেঙে বড় বড় আবাসন উঠল। ভদ্রলোকদের ভিড় বাড়ল। ময়লা ফেলার ঢিবিগুলো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। সেখানে চায়ের দোকান, ফুলের দোকান হল। ভ্যানের ওপর অস্থায়ী সবজির ঠেক– তাও হল। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা ভাগাড় এই আবাসনের পাল্লায় পড়ে আশেপাশে চাউমিন আর রোলের দোকানও দিয়ে ফেলল। বড় লোকেদের ফ্যাটবাড়িতে রান্নার লোক, বাসন মাজার লোকের প্রয়োজন পড়ল।
এদিকটায় রান্নার কাজের খুব ডিম্যান্ড। অনেক জায়গায় ফ্ল্যাটে বসবাসকারি বাসিন্দার সংখ্যা অনুযায়ী রাঁধুনির মাইনে ঠিক হয়। স্বামী স্ত্রী মা বাবা মিলে মোট চারজন থাকলে চারহাজার টাকা। মাথাপিছু হাজার টাকা। এখানে তেমনটা নয়। বাড়িতে যে কজনই মেম্বার থাকুক না কেন, রান্নার জন্য ছ হাজার এখানে ফিক্সড রেট। একবেলা রান্নার জন্য ছ হাজার টাকাটা কম নয়! সন্ধেবেলা একটুখানি সময়ের জন্য আর একবার কাজের বাড়িতে যেতে হয়। রুটি, চাপাটি আর ও বেলার তরকারি গরম করে দিয়ে আসতে হয়। পড়াশোনা জানা ভদ্রবাড়ির মেয়েরাও এখন রান্নার কাজ লুফে নিয়েছে। বাবুদের বাড়ি কাজ করি– এটা বলার চাইতে রান্নার কাজ করি… কথাটার ওজন বেশি। সম্মানও আছে। কামাই করলে তাদের গুরুত্ব টের পাওয়া যায়। (Food Blog)
বাবুদের বাড়ির বৌরা বেশিরভাগ চাকরি করে। আর যারা চাকরি করে না তারা খুব অলস। শুয়ে বসে মোবাইল ঘেঁটে দিন কাটায়। কোন্ কৌটোয় কালোজিরে আছে আর কোন্ কৌটোয় শুকনোলংকা– নিজেরাই জানে না। শুধু কী কী রান্না হবে সেটুকু বলে দিয়েই খালাস। বরঞ্চ যেসব বৌরা বাইরে কাজ করে, তারা বেশি সংসারি। তারা একেক দিন নিজেই বাজার করে বাড়ি ঢোকে। ছুটির দিনে বা কোনও গেস্ট এলে নিজেই রান্না করে।
নীপা যে বাড়িতে কাজ করে সেই বৌদির মনটা ভালো। নিজে যা খায়, নীপাকে তাইই খেতে দেয়। মাঝেসাঝে ছেলেদের জন্যেও খাবার দিয়ে দেয়। তবুও বৌদি সামনে থাকলে হটাম্ হটাম্ ক'রে যখন তখন ফ্রিজ খুলতে পারে না নীপা। কেমন যেন লাগে! বৌদির রান্নাঘরে কেক বানানোর মেশিন আছে। বৌদি ঘরেই কাবাব বানায়। মাখন মাখানো পাউরুটির মধ্যে ডিম, শসা, টমেটম ভরে একটা ছোট্ট মতোন যন্ত্রের ভেতরে ঢুকিয়ে সুইচ টিপে বৌদি দোকানের মতো স্যান্ডুইচ বানায়। মিক্সি আছে দুটো। আর কত সুন্দর সুন্দর বাসনকোসন আছে বৌদির! এমন রঙিন প্রেশারকুকার আগে কখনও দেখেনি নীপা। ননস্টিক কড়াই, চাটুগুলোতে কত্ত কম তেল দিয়ে রান্না করা যায়! অনেক দাম ওগুলোর। নীপা ভেবেছে এবার পুজোয় শাড়ি নেবে না। ননস্টিক কড়াই নেবে দুখানা। একটা প্রেসারকুকারও তার লাগবে। (Food Blog)
এদের মেয়েটা দেরাদুনের একটা ইস্কুলে পড়ে। হোস্টেলে থাকে। বৌদির বাপের বাড়ি কৃষ্ণনগরে। কয়েকবছর ধরে বৌদির মা খুব অসুস্থ। মা-কে মাঝেমাঝেই দেখতে যেতে হয়। বৌদি বাপের বাড়ি গেলেই নীপার খুব আনন্দ হয়। কটা দিনের জন্য এমন একটা সুন্দর রান্নাঘরের রানি হয়ে যায় সে। যখন বৌদি থাকে তখন সামান্য গা ম্যাজম্যাজ করলেও সে কাজে আসে না। এখন পা মুচকে গেলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজে আসবে।
দাদাবাবু খুব বই পড়ে। বৌদি না থাকলে বেশি বেশি পড়ে। ঘুমোনোর আগে দাদাবাবুর বই পড়ার অভ্যেস আছে। নীপা সকালে কাজে এসে বইগুলো সেলফে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। বই বদলে বদলে গেলেও গীতবিতানটা সবসময় বালিশের পাশেই থাকে। পার্মানেন্ট। সে যেমন এই বাড়ির পার্মানেন্ট রাঁধুনি, এত বছর একইভাবে রয়ে গেল! ঠিক তেমন।
এখন আমিও নীপার চোখমুখ, চাপা আনন্দ, হরিণীর মতো পথ চলা দেখে বুঝতে পারি বৌদি বাড়িতে নেই। বাপের বাড়ি গিয়েছে।
একদিন রাস্তাতেই নীপাকে চেপে ধরলাম। তুই যা করছিস সেটা কি ঠিক করছিস? তোর বর তো খারাপ মানুষ নয়। তোকে সাধ্যমত যত্ন করে। স্বভাব চরিত্রও ভালো। আর তুই কাজে গিয়ে বৌদির অনুপস্থিতিতে যা নয় তাই করছিস!
নীপার মুখটা চুপসে গেল। বলল "আমি কী করেছি দিদি? রান্নার কাজে যাই। রান্নাবান্না করে ঘরে ফিরি।"
– মিথ্যে বলিস না। বৌদি না থাকলে তোর মনে বাতাস লাগে কেন? দাদাবাবু একা থাকলে তোর সুবিধা হয়, না কি দাদাবাবুর?
"ওসব বোলো না দিদি।" ডুকরে উঠল নীপা। "দাদাবাবু খুব ভালো লোক। আমার 'মুখ'-এর দিকে তাকিয়েই কথা বলে। দরকার না পড়লে কথাই বলে না।"
– তাহলে ওঁর বউ না থাকলে তোর এত আনন্দ হয় কেন? ঘুড়ির মতো উড়িস কেন তখন। (Food Blog)
নীপা বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠল...
"ওদের রান্নাঘরটা একেবারে সিনেমার রান্নাঘরের মতো। আমার খুব খুব ভালো লাগে। বৌদি না থাকলে ওই কটা দিন নিজেকে ওই রান্নাঘরের মালকিন মনে হয় আমার। মনে হয় ওই রান্নাঘরটা আমার।" নীপার চোখের জল বাঁধ ভাঙল এবার।
আমারও খুব কষ্ট হল। আমিও যে কেন সবার মতো করে ভাবলাম! একটু অন্যভাবে ভাবতে পারলে নীপা আজও আনন্দ করেই বাড়ি ফিরতে পারত। অপরাধবোধটুকু আমার থাক, আপাতত নীপার কাছ থেকে শেখা ডিমের দুটো রেসিপি থাকল আপনাদের জন্য। (Food Blog)
লাল ডিম
উপকরণ: হাঁসের ডিম ৫ টা, আদা-রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, শুকনো লংকার বীজ ফেলে তারপর বেটে নেওয়া ১ টেবিল চামচ (বীজ ফেলে দেওয়ার জন্য ঝাল হবে না, কিন্তু টকটকে লাল হবে), একটা বড় টমেটো বাটা, দুটো মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি করে কেটে তেলে ভেজে তারপর বেটে নেওয়া, কাশ্মীরি লংকার গুঁড়ো, লাল রঙের কাঁচা লংকা বাটা ১ চা চামচ, হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, নুন, সর্ষের তেল, ছোট এলাচ দুটো, দুটো লবঙ্গ, একটা দারচিনির কাঠি, তেজপাতা, এক কুচি জয়িত্রি আর অল্প ধনেপাতা।
প্রণালী: ডিম সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে একটু চিরে চিরে দিন। ডিমগুলোর গায়ে নুন হলুদ আর কাশ্মীরি লংকাগুঁড়ো মাখিয়ে ভেজে নিন। অন্য চুলোয় একটা পাত্রে হাফ লিটার জল নিয়ে তাতে তেজপাতা সহ সব রকমের গরমমশলা দিয়ে জলটা ভালো করে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ছেঁকে রাখুন।
ডিম ভেজে নেওয়ার তেলেই সমস্ত বাটা মশলা আর টমেটো বাটা দিয়ে মশলাটা কষিয়ে নিন। নুন আর গুঁড়ো মশলাগুলোও দিয়ে দিতে হবে এইসময়।
ডিমগুলো দিয়ে আরও একবার নেড়েচেড়ে গরমমশলার জলটুকু ডিমের মধ্যে দিয়ে দিন। ফুটে উঠলে ঝোলের মধ্যে ভাজা পেঁয়াজ বাটাটুকু দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে দিন। গ্রেভি ঘন হয়ে এলে ধনেপাতা কুচি মিশিয়ে গ্যাস অফ করে দিন।গরম ভাতের সঙ্গে দারুণ জমে যাবে এই লাল ডিম।
আচারি আন্ডা
উপকরণ: ডিম ৬ টা, ১ টা মাঝারি সাইজের বেগুন, ২ টো বড় সাইজের পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি করে কেটে বেরেস্তা করে নেওয়া, পেঁয়াজ বাটা ১ চা চামচ, আদা রসুন বাটা ২ চা চামচ, জিরের গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, লংকার গুঁড়ো, গরম মশলার গুঁড়ো, চার পাঁচটা চেরা কাঁচা লংকা, আমের আচার ১ টেবিল চামচ, লবণ, চিনি, ছোট এলাচ ২ টো, দারচিনির কাঠি একটা, ধনেপাতা, সর্ষের তেল।
প্রণালী: ডিমগুলো সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। বেগুনটার গায়ে তেল মাখিয়ে পুড়িয়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে ভালো করে মেখে রাখতে হবে।
কড়াইতে তেল দিয়ে ঝিরিঝিরি করে কেটে রাখা পেঁয়াজের বেরেস্তা বানিয়ে তুলে রাখুন। এবার ওই তেলেই তেজপাতা আর গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিন। সুগন্ধ বেরোলে বাটা মশলাগুলো এক এক করে দিয়ে দিন। কষানো হলে গুঁড়ো মশলাগুলো দিয়ে একটু জল দিয়ে আবার একটু কষে নিন। এবার বেগুনপোড়ার পেস্টটা দিন। পেঁয়াজের বেরেস্তা দিন।পরিমাণ মতো নুন, চিনি, চেরা কাঁচালংকা আর দু'কাপ জল দিয়ে ঢেকে দিন। অল্প জল দিয়ে আমের আচারটাকে একটু থকথকে বানিয়ে মিনিট পাঁচেক পর সেটা ঝোলের মধ্যে দিয়ে দিন। এবার ডিমগুলো দিয়ে আবার কিছুক্ষণ ঢেকে রাখুন।সবশেষে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিন।