শেষ আপডেট: 13th June 2023 12:47
সম্প্রতি ঝটিকা সফরে কলকাতায় এসেছিলেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল (Style icon Bibi Russell latest fashion collection )। ব্যস্ততার মাঝে একমাত্র 'দ্য ওয়ালকে দিলেন এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ। কথা বলেছেন চৈতালি দত্ত।
শিল্প সৃষ্টির টানে নাকি ব্যক্তিগত সফরে কলকাতায় আসা?
আমার কাজই হল ধ্যান জ্ঞান।কাজের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাই। কাজই আমার স্বপ্ন। আর কলকাতা তো আমার প্রাণের শহর। কাজ তো ছিলই। পাশাপাশি একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলাম। সেখানে আমাকে সম্মাননা জানানো হয়। কাল ভোরের ফ্লাইটে বাংলাদেশ ফিরে যাব।
এখন কোন শিল্প সৃষ্টিতে আপনি আত্মমগ্ন হয়ে আছেন?
সব সময় চেষ্টা করি টেকসই শিল্পের উন্নয়ন করা যাতে তাঁদের পরিবার ভাল করে বাঁচতে পারে, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে ইত্যাদি। এখনও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। অনেক কাজ বাকি।
আপনি গামছাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেছেন। পাশাপাশি রিক্সা শিল্প আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে। এছাড়া নতুন আর কী কী শিল্প সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন সে ব্যাপারে যদি বলেন।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আমি প্রচুর কাজ করি। আসল শিল্পী কিন্তু গ্রামে বসে রয়েছেন। ফলে আজ গ্রামে গেলে যখন দেখি কেউ শাকসবজির চাষ করছেন বা রান্না করছেন কিংবা চাল ঝাড়ছেন এটার মধ্যেও কিন্তু আমি শিল্পকে খুঁজে পাই। টিনএজ পর্যন্ত আমি দেশের মধ্যে থাকলেও কোনদিনই ঘরবন্দি ছিলাম না। শৈশব থেকেই রাজনীতিবিদ, ফাইন আর্টের শিল্পী,সঙ্গীত শিল্পীদের আমাদের বাড়িতে আনাগোনা ছিল। ফলে এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার বেড়ে ওঠা। আর শৈশবে আমার গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল। তখন থেকেই মনের মধ্যে অনেক কিছু স্বপ্ন ছিল। যখন বড় হতে শুরু করি তখন আমার মনে হত গ্রামের মানুষেরা খুব গরীব হলেও এঁদের হাতে জাদু আছে। গ্রামের মহিলারা সারা দিনরাত পরিশ্রম করে অথচ তাঁদের মুখে নির্মল হাসি। যা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। এই উপলব্ধি আমার ছোট থেকেই শুরু হয়।
তারপর ?
ছেলেবেলার থেকে এঁদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা। তাঁতিরা বংশগতভাবেই তাঁত চালাতে শেখেন। আবার আমাদের বাংলাদেশে রিক্সার পেছনে যে আর্ট থাকে সেটা কিন্তু ওঁরা নিজেরাই করেন। সেই অর্থে লেখাপড়া না জানলেও ওঁরা কিন্তু রিয়্যাল আর্টিস্ট। অদ্ভুত সুন্দর হাতের কাজ। আমি যখন ওঁদের আর্টিস্ট বলে সম্মোধন করতাম ওঁরা খুব খুশি হয়ে যেত। আমি জানতাম কোনও একদিন রিক্সা বাংলাদেশ থেকে উঠে যাবে। তখন এই রিক্সা শিল্পীরা কি করবেন ? কিন্তু ক্রমশ দেখছি রিক্সার পেছনে যে আর্ট থাকতো সেটা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। আমার সবথেকে বেশি বিক্রি হয় গামছা, রিক্সা শিল্প এবং রিসাইকেল সামগ্রী। বাংলাদেশর প্রতিটা জেলায় গামছা আছে যা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু আমার বিদেশে পড়াশোনা করা তাই সেই চিন্তাভাবনা দিয়ে রিক্সা শিল্পকে নিয়ে হাতে চুড়ি, গয়না, জুতো, ব্যাগ, টেবিল, চশমার ফ্রেম, জলের গ্লাসে ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে আমি এই আর্ট নিয়ে কাজ করি। তবে আজকাল আধুনিক প্রযুক্তিতে এই শিল্পকে ডিজিটালের মাধ্যমে আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। আজও কিছু আঁকতে হলে আমি খাতা পেন্সিল দিয়েই আঁকি। রিক্সা শিল্পীরা জন্মগত শিল্পী। এভাবেই এখনও কাজ করে চলেছি।
নতুন আর কি কি কাজ করছেন?
ফ্যাশন এবং ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নের জন্য প্রতি তিন মাস অন্তর গামছার ভিন্ন ধরনের কালার, ডিজাইন, চেকস, স্ট্রাইভ আমি পরিবর্তন করি। রিপিট করি না। যাতে মানুষ নতুনত্বের স্বাদ পান। আমি তো কোনও সিনথেটিক নিয়ে কাজ করি না। সমস্ত ন্যাচারাল প্রোডাক্ট নিয়ে আমি কাজ করি। যাতে শরীরে কোনরকম র্যাশ বা ইরিটেশন না হয়। আর পুরোটাই আমার হাতে তৈরি হয়। আজ পর্যন্ত কোনও কিছু পাওয়ার লুমে আমি করিনি। আমি আজও গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেখানে মানুষদের ডিজাইন শেখাই। নকশা এবং শিল্পের মধ্য দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা, সেইসঙ্গে সৃজনশীলতার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করি। দেশীয় জিনিসপত্র দিয়ে কি করে ডিজাইনে উন্নয়ন করা যায় সেই সৃষ্টি আজও করে চলেছি। একটা শিল্পকে বাঁচাতে গেলে তার ভ্যারিয়েশন প্রয়োজন। সব কিছুর মধ্যে ব্যাকরণ আছে। সেটা আজকাল ডিজাইনারদের জানা খুবই জরুরি।
আপনি তো পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়াতে এখন কাজ করছেন -
হ্যাঁ। ফুলিয়াতে এখন বেশির ভাগই পাওয়ারলুম হয়ে গেছে। গত দু’বছর যাবত তাঁত রিভাইভ করছি। যাতে সেখানে তাঁতিরা হাতে তাঁত চালাতে পারেন সেই চেষ্টা করছি। এছাড়া ধনেখালিতেও কাজ করছি।
১৯৯৬ সাল থেকে আপনার স্লোগান 'ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট' নিয়ে নিরন্তর দেশে-বিদেশে কাজ করে চলেছেন-
(কথা শেষ না হতেই) ঠিকই বলেছেন। আমার তো বিদেশে বহু বছর কেটেছে। কিন্তু আমি সবসময়ই আমার দেশে আসতাম। কারণ আমার মা-বাবা যেহেতু বাংলাদেশে থাকতেন। লন্ডন ইউনিভারসিটি থেকে ফ্যাশন নিয়ে আমার পড়াশোনা করা। ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল ফ্যাডরিকো ম্যাইয়োর থাকাকালীন আমি 'স্পেশাল এনবয় ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট' উপাধি পাই। এরপর আমি 'আর্টিস্ট ফর পিস' ছাড়াও বিশ্বের বহু সম্মানিত উপাধি অর্জন করি। দেশের প্রধান থেকে অতি দরিদ্র মানুষও যে একটা কাপড় ছাড়া ঘর থেকে বেরোতে পারেন না বা থাকতে পারেন না এটা দিয়েও যে দেশের উন্নয়ন করা যেতে পারে এটা কিন্তু আমি উপলব্ধি করি। সে কারণেই বিদেশে অত বড় একটা কলেজে আমি পড়াশোনা করে ইউরোপীয় আদব-কায়দা করায়ত্ব করেও আমি কিন্তু নিজের দেশেই ফিরে এসেছি। আমি নিজে চার-পাঁচটা ভাষায় কথা বলতে পারি। কিন্তু তার জন্য কখনও নিজের মাতৃভাষাকে অসম্মান করি না। এখন তো নিজের মাতৃভাষায় কথা না বলে ইংরেজি ভাষায় কথা বলাটা অনেকেই স্মার্ট মনে করেন। যা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারি না। বাঙালিরা যখন আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন সত্যিই বিস্মিত হই। 'ফ্যাশন ফর ডেভলপমেন্ট' আমার স্লোগান যার স্বীকৃতি ইউনেস্কো ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশ দিয়েছে। যার অধীনে এখন প্রচুর মানুষের জীবন জড়িত।
আপনি তো স্পেনে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী নারীদের নিয়েও কাজ করেছেন। সেটা নিয়ে যদি কিছু বলেন?
হ্যাঁ। ওখানে বিভিন্ন দেশের মহিলারা নানা অপরাধের কারণে কারাগারে বন্দি। আমি ওঁদেরকে প্রশিক্ষণ দিই। কয়েক মাস আগে গিয়েও সেখানে কারাগারে কাজ করে এলাম। সেলাই, নানারকমের আর্ট প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওঁদেরকে মোটিভেট করি। হাতে তৈরি করা জিনিসপত্র শেখাই।
আপনার উৎসাহে গ্রামের নারীদের এবং তাঁদের পরিবারের উন্নয়ন হয়েছে। এই সময় দাঁড়িয়ে আপনার শিল্পের সঙ্গে কত সংখ্যক নারী যুক্ত হয়েছেন?
আসলে এটা আমার নিজের মুখ দিয়ে বেরোয় না। আমি যদি একলাখও বলি তবে সেটা এক শতাংশ হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলি পাঁচটা ধাপ পেরিয়ে তবেই একটা হ্যান্ডলুম শাড়ি তৈরি হয়। ফলে হাতে তৈরি একটা তাঁতের শাড়ি কেনা মানে দারিদ্র্যের হাত থেকে একটা পরিবারকে সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করা। ওঁরা সম্মান নিয়ে বাঁচেন, কারোর কাছে ভিক্ষা চাইতে যায় না।
অতিমারির সময়ও তো আপনি একা গ্রামবাংলার যাঁরা কুটিরশিল্পী তাঁদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেন-
আমি তো সব সময় একাই উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে যাই। অতিমারির সময় আমি খুবই ব্যস্ত ছিলাম। সেই সময় হাতে তৈরি প্রচুর গামছার স্কার্ফ, কাপড়ের ব্যাগ, মাক্স তৈরি করেছি। কারণ বাইরে বেরোনোর জন্য ওটাই ছিল অপরিহার্য। নিজের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর পাশাপাশি অন্যদেরকেও সাহায্যে এগিয়ে গেছি। আমার প্রতিষ্ঠান কিন্তু সেল্ফ ফান্ডিং। একজন মহিলা হয়ে সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটা ইতিবাচক ইমেজ আমি তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আমার স্বপ্নকে কারোর কাছে বিক্রি করি না। আমি আজ পর্যন্ত কনসালটেন্সি চার্জ করি নি। আমার প্রতিষ্ঠানে এক ঝাঁক সাধারণ ঘরের মানুষ কাজ করেন। তাই আমার প্রতিষ্ঠান ওঁদের নামে রেখেছি। আমি শুধু প্রতিষ্ঠানের সংস্থাপক মাত্র।
আপনি তো 'মনের মানুষ' ছবির পোশাকের জন্য ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আর ছবিতে কস্টিউম করলেন না কেন?
আমি নিজে ভীষণ খুঁতখুঁতে। পরিচালক গৌতম ঘোষ নিজেই বাংলাদেশে এসেছিলেন। উনি জানতেন লালনের উপর আমার বিস্তর পড়াশোনা করা। পুরো তিন মাস শ্যুটিংয়ে আমি ছিলাম। সেসব স্মরণীয় মুহূর্ত। বাংলাদেশেও আমি 'বিদ্যাসাগর' নাটকের জন্য কস্টিউম করে সম্মানিত পুরস্কারের পাশাপাশি যাবতীয় স্বীকৃতি পাই।
আপনি তো আফ্রিকাতেও প্রচুর কাজ করেছেন-
ঠিকই বলেছেন। এক্ষেত্রে একটা কথা বলি দীর্ঘ বছর ধরে আপনার সঙ্গে আমার পরিচিতি। সেজন্য পড়াশোনা জানা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমি নিজে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আজকাল মিডিয়াতে এত মানুষ এসে গেছেন অনেক ক্ষেত্রে না জেনে এমন প্রশ্ন করা হয় আমি হতচকিত হয়ে যাই। আমি আফ্রিকাতে এত কাজ করেছি যেখান থেকে আমি সব থেকে বেশি স্বীকৃতি পেয়েছি। নর্থ আফ্রিকাতে ক্রাফটম্যানদের জন্য দীর্ঘ বছর কাজ করেছি যেটা ছিল খুবই কঠিন।
আপনার আগামী দিনের পরিকল্পনা কী?
যাঁরা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করেছেন আমি যেন তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি সেটাই আমার আগামী দিনের পরিকল্পনা।
বাজারে এসে গেল মাত্র ৭০ টাকায় ল্যাপটপ শাড়ি, জেনে নিন ঠিকানা