মেসির ক্যারিশমা বার্সেলোনার সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ক্লাবের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট আর্জেন্তিনীয় ফুটবল তারকা। ফলে তাঁর দল ছাড়াটা বার্সা সমর্থকদের কাছে ছিল বড় ধাক্কা।
লামিন ইয়ামাল
শেষ আপডেট: 16 May 2025 14:27
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কানু বিনে গীত নাই।
বার্সেলোনার (Barcelona) অন্দরমহল-বাহিরমহল, ড্রেসিংরুম, পার্কিং লন সর্বত্র এভাবেই বেজে উঠেছিল বিষাদের সুর। আজ থেকে চার বছর আগে।
কথাটা সত্যি, শুধু একটু নাটকীয় ঢঙে ঘুরিয়ে বলা। এখানে ‘কানু’ লিওনেল মেসি (Lionel Messi)। যিনি ২০২১ সালে স্পেন (Spain) ছেড়ে পাড়ি দেন মার্কিন মুলুকে।
মেসির ক্যারিশমা বার্সেলোনার সাফল্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ক্লাবের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট আর্জেন্তিনীয় ফুটবল তারকা। ফলে তাঁর দল ছাড়াটা বার্সা সমর্থকদের কাছে ছিল বড় ধাক্কা। তাঁরা খুঁজে চলেছিলেন স্বপ্নের নায়ক, যিনি একা হাতে শুধু ম্যাচ জেতাবেন বা গোল করবেন—এমনটা নয়, যার প্রতিভার ছটা, ড্রিবলং স্কিল, দুরন্ত ভলি ন্যু ক্যাম্পের প্রতিটি ঘাসে তৈরি করবে স্ফুলিঙ্গ।
এর উত্তর পেতে অবশ্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০২৩ সালেই রিজার্ভ বেঞ্চ ছেড়ে ময়দানে নেমে পড়েন এক কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার। নাম লামিন ইয়ামাল। মেসির মতোই শক্তিশালী বাঁ-পা। তেমনই দুরন্ত গতি, অনন্য বুদ্ধিমত্তা। ডান দিকের উইং ধরে ছুটে চলেন। অতর্কিতে মার্কারকে বোকা বানিয়ে ডজ করে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারপর একই সঙ্গে চারজন, পাঁচজন ডিফেন্ডারকে একা হাতে নাস্তানাবুদ করে বাঁকানো শটে বল জালে জড়ান।
১৫ বছর বয়সে প্রথম লা লিগা জিতেছিলেন লামিন ইয়ামাল (Lamine Yamal)। দু’বছর বাদে, গতকাল ফের একবার সেই ট্রফি হাতে তুললেন তিনি। দু’নম্বর ঘরোয়া লিগ জিতলেন মাত্র সতেরো বছর বয়সে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) যা হাসিল করতে ন’বছর সময় লেগেছিল!
ইয়ামালের অভিষেকের মরশুমে বার্সার দায়িত্বে ছিলেন জাভি হার্নান্ডেজ। রিয়াল বেটিসের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে ক্যাম্প ন্যুয়ে আত্মপ্রকাশ। মাত্র সাত মিনিটের জন্য। কিন্তু জয়ের স্বাদ পেতে, সমর্থকদের উন্মাদনা শুষে নিতে ওই সাত মিনিট পনেরো বছরের ইয়ামালের জন্য সত্তর মিনিটের সমতুল্য ছিল। ম্যাচ, লিগ এবং সিজন শেষে লা লিগা জেতার অভিজ্ঞতা ইয়ামালকে অনেক পরিণত করে তোলে।
কেউ শেখে সাফল্যে, কেউ ব্যর্থতায়। ইয়ামালের ক্ষেত্রে দুটোই সত্যি। ট্রফিজয়ের মরশুমের পরের বছরই ভরাডুবির সাক্ষী। দল বদলে যায়। কোচ পালটে যায়। হাতে কিছুই জোটে না। লা লিগা ঘরে আনে রিয়াল মাদ্রিদ, চ্যাম্পিয়নস লিগও। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্তুঙ্গ সাফল্য আর নিজেদের সমূহ বিপর্যয় ইয়ামালকে চূড়া থেকে সটান খাদের ধারে এনে দাঁড় করায়।
ওই বছর সবকিছু খুইয়ে ফেলে বার্সেলোনা—নিকষ আঁধারে সন্ধ্যাতারার মতো শুধু জেগেছিলেন ইয়ামাল। তার ধারাবাহিক পরিণতি বুঝিয়ে দেয়, আশা জোগায়—আগামী দিন সম্ভাবনাময়। ‘প্রতিশ্রুতিমানে’র খোলস ভেঙে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে গোকুলে বেড়ে উঠেছেনে বার্সেলোনার নতুন ত্রাতা—তাদের ‘দ্বিতীয় মেসি’।
চব্বিশের ইউরো জয় এই অভিজ্ঞানেই চূড়ান্ত সিলমোহর দেয়। স্পেনের পোড়খাওয়া কোচ লুইস দে লা ফন্তে পর্যন্ত বলে দেন, ‘ইয়ামাল অসাধারণ! ওর হাতে ঈশ্বরের জাদুদণ্ড!’ নতুন কোচ হান্সি ফ্লিকও অল্প ক’দিনের প্রি-সিজন ট্রেনিং শেষে বুঝে যান, তাঁর হাতে আস্ত ডিনামাইট রয়েছে। কিন্তু একে কাজে লাগাতে হবে বুঝেশুনে, রয়েসয়ে। দিতে হবে ওর প্রিয় জমি, পছন্দের ভূমিকা।
রাইট উইং এবং আক্রমণাত্মক খেলার অনুমোদন—ইয়ামালের জন্য যথেষ্ট ছিল। ফ্লিক তাতে ‘না’ করেননি। ব্রাজিলীয় রাফিনহা, যিনি বরাবর ডান প্রান্তে স্বচ্ছন্দ, তিনি দলের প্রয়োজনে, ইয়ামালের কথা মাথায় রেখে সরে যান তুলনায় কম পছন্দের লেফট উইংয়ে। লেওয়ানডস্কিকে নিয়ে তাঁরা গড়ে তোলেন অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ। যার ফসল মরশুমে শেষে শুধুমাত্র লা লিগাতেই ৯৫ গোলের রেকর্ড!
কিন্তু শুধু নিজে গোল করেই ক্ষান্ত নন। ইয়ামালের প্রধান ইউএসপি গোল করার দক্ষতা, ফাইনাল পাস বাড়ানোর ক্ষমতা। চলতি মরশুমে ১৩ খানা অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর নামে। সবচেয়ে বেশি ড্রিবলিংও তিনিই করেছেন। হাল-না-ছাড়া প্রতিযোগী, বিশ্বস্ত সহযোগী—দুই-ই ইয়ামাল। তাই মরশুম শেষের আগেই ৪২ গোল ও অ্যাসিস্টের রেকর্ড, লা লিগা, কোপা দেল রে এবং সুপারকোপা চ্যাম্পিয়ন—সবকটা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে—এই সাফল্য ইয়ামালকে ব্যালন বালঁ দ্য’রের দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই ঐতিহাসিক, গরিমাময় সম্মানের জন্য মনোনীত হওয়াটাও যে অভূতপূর্ব!
‘অ-ভূতপূর্ব’ বিশষণটা ইয়ামালের জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ইন্টার মিলানের বিরুদ্ধে হেরে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিয়েছে বার্সেলোনা। কিন্তু দলের হয়ে দুই লেগেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন লামিন ইয়ামাল। যা দেখার পর ইন্টার ম্যানেজার সিমনে ইনজাঘি বলেছিলেন, ‘লামিন অনন্য! এমন প্রতিভা ৫০ বছরে একবার আসে!’
আর বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিক? তিনি মুচকি হেসে জবাব দিয়েছেন, ‘আমি খুশি যে, ৫০ বছরে আবিভূর্ত হয় এমন ফুটবলার বার্সেলোনার হয়ে খেলে।‘