শেষ আপডেট: 2nd October 2022 10:26
উৎসবে বেশি বেশি আনন্দ করতে চাইলে রান্নাঘরে একটু কম ঢুকতে হবে। বুদ্ধি করে একটা দুটো এমন আইটেম রাঁধতে হবে, যেটা হিট হবেই। অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার মতো। চোখা চোখা সংলাপ, আবেগ, বৌদির অঝোর কান্না, দজ্জাল শাশুড়ির কুচুটেপনা, বড় ভাইয়ের স্নেহ, সততার জয়— এই সমস্ত দিয়ে কষানো একখানা ছবি। দর্শক হাসিমুখে হল থেকে বেরোবেন। মাথা হালকা। মেজাজ ফুরফুরে। ভালো কোয়ালিটির মাটনও অনেকটা এইরকম। একাই একশো। তাতে ঠিকঠাক মশলা পড়লে, আর রাঁধুনির সবটুকু মন সেই রান্নায় থাকলে রান্না অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার মতোই সুপারহিট হবে। মাটনের দাম পিলে-চমকানো হলেও উৎসবের দিনগুলোতে ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য আলাদা একটা টাকা ধরাই থাকে বলে অত গায়ে লাগে না।
সবচেয়ে ঝামেলাবিহীন রান্না হল মাংস রাঁধা। মশলা দিয়ে ভুনে বা কষে দু'তিন কাপ গরম জল ঢেলে দাও। ঝোলটা ফুটলে এবং মাংস আধসেদ্ধ হলে আগে থেকে ডুমো ডুমো করে কেটে ভেজে রাখা চন্দ্রমুখী আলু দিয়ে দাও। ঢেকে দাও। মাংস আর আলু নরম হয়ে এলে উপরে গরমমশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে গ্যাস অফ করে দাও। ভাত, রুটি, পরোটা এমনকি পাউরুটি দিয়েও এইরকম থকথকে মাংসের ঝোল হিট। সপ্তাহে একদিন রেঁধে জ্বাল দিয়ে রেখে রেখে খাও। ঝুরো ঝুরো হয়ে যাওয়া পর্যন্ত খাও। রোজ বাসি মাংস খেতে হচ্ছে ব'লে এদিকে নিজের আত্মা কাঁদছে। ফোনের ওপারে কাঁদছেন জন্মদাত্রী। "তখনই বলেছিলাম কলকাতার মধ্যেই কাজের চেষ্টা কর। দিল্লির ইন্টারভিউটা দিস না। শুনলি না। আচ্ছা তোকে যে সেই পোস্ত দিয়েছিলাম! ওটা বের কর। এক চা চামচ তেল দিয়ে খানিকটা পোস্ত হালকা ভেজে কাঁচা গন্ধটাকে তাড়া। তারপর ওটা মিক্সিতে পিষে নে। এবার বাসি মাংসগুলো ঝোল থেকে তুলে হাত দিয়ে ছিঁড়ে কুচি কুচি কর। কড়াইতে তেল দিয়ে একটু বেশি করে কাটা পেঁয়াজ ,দুটো শুকনোলঙ্কা হালকা ব্রাউন করে নে। ওতে মাংসগুলো দিয়ে নেড়ে চেড়ে একটু নুন, জিরেগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে পোস্তটা মাংসে ভালো করে মিশিয়ে একটু চাপা দিয়ে রেখে আর একটু ভাজা ভাজা হলে দু একটা গোটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে গ্যাস অফ করে দে। খেয়ে জানাস!"
শেষ বাক্যের গর্বটুকু বেহালা থেকে ফোনের ভেতর দিয়ে গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে দিল্লির নেহেরু প্যালেসের অনতিদূরে একটা পিজি'র ঘরের দেওয়ালে। (Food Blog)
আমরা মনে করি মাটনভুনা রান্না করা বেশ ঝামেলার কাজ। বিশেষ করে মাংসটা তুলতুলে নরম করতে পারা। প্রেশারকুকারে সেদ্ধ করলে মাংস নরম হবে। কিন্তু পরতে পরতে ছিঁড়ে আসবে এমন মাটন রান্না করতে চাইলে মন প্রাণ ঢেলে মাটন রান্না করতে হয়। সবাই পারে না। প্রেশারকুকার হাড় থেকে মাংস আলাদা করে দিলেও মাংসের ফাইবারে মাখনসদৃশ মোলায়েম ব্যাপারটা আনতে অক্ষম। প্রেশারকুকার যদি মাংসের তুলোভাব আনতে পারত তাহলে তপসিয়া, পার্ক সার্কাস আর রাজাবাজারে এত্ত হাঁড়ি বা ডেগচি বিক্রি হত না! তামার হাঁড়ি লাগবে না। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি হলেই হবে। সঙ্গে লাগবে খাপে খাপ টাইপের ঢক্কন। আপনি মাংস ভুনতে চান, অথচ হাঁড়িতে যুতসৎ ঢাকনা নেই ,অমনটি হ'লে আপনার ভুনা মাংস রাঁধার অউকাদ-ই নেই। সাতশো বা সাড়ে সাতশো টাকা কেজি দরের মাটন কিনে আনলেই আপনার অউকাদ প্রমাণিত হয় না। হাঁড়ির মুখের সাইজের ঢাকনা চাই। কেন চাই? বাবুসোনার বাদ দেওয়া টুপসানো থালা দিয়ে হাঁড়ি ঢাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? মহাভারত অশুদ্ধ না হলেও শুদ্ধ ভুনা হবে নাৎ
ধরা যাক ,আমার কথা আপনারা শুনলেন। ঢাকনা-সমেত হাঁড়ি এল। মশলাও রেডি। এবার মাংস। খাসির মাংসের জন্য সবাই যে কেন হাজি মিটশপগুলোকেই ভরসা করে জানি না! কঠোর কঠিন হিন্দুরাও এই একটি ব্যাপারে বেশ নরম। 'হাজি' শব্দটা খুব কাজে দেয়। ক্রেতার মনের ওপর গভীর ছাপ ফ্যালে। সততা এবং নির্ভরতার প্রতীক। অরিজিনাল ছাগলই পাওয়া যাবে দোকানে। ছাগলের মতো অথচ ছাগল নয়— এসব সন্দেহ থেকে মুক্ত। (Food Blog)
আমি ওরকমই এক হাজি মিটশপে রোজ সকালে একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখতাম। বলি? লেখা বড় হচ্ছে বলে যেন মনে-মনে আমাকেই জবাই করবেন না।
যে ছাগলগুলোকে জবাই করা হবে তারা লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকত। যিনি ছাগলদের মুখের সামনে নিয়মিত কাঁঠাল পাতা ধরেন, দোকানের দেওয়াল মুছে চকচকে করে তোলেন ,ওজনযন্ত্র পরিষ্কার করেন— তিনি এক বদনা জল আর একটা ক্যাপসুলের পাতা হাতে নিয়ে ছাগলগুলোর সামনে এসে দাঁড়াতেন। আর একটা ছোকরা এসে দুহাত দিয়ে এক একটা ছাগলের মুখ ধরে হাঁ করাতো আর ওই ক্যাপসুল হাতের ব্যক্তিটি একটা করে ক্যাপসুল ছাগলের মুখের ভেতরে চালান করে দিয়ে এক ঢোঁক জল গিলিয়ে দিতেন। সবকটা ছাগলকে ক্যাপসুল খাওয়ানোর পর তাদের ক্রমানুযায়ী জবাই করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হত। দোকানের মালিকের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। আমার কৌতূহল দেখে এবং প্রশ্ন শুনে হাজী সাহেবের উত্তরসূরি দোকানের দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো 'বিসমিল্লাহ্' লেখাটার দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে দশ মিনিট পার করে দিয়েছিলেন। আর কতক্ষণ দাঁড়ানো যায়! কৌতূহলের নিরসন না ঘটিয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
হাজি মিটশপের মাটন যদি সত্যিই ভালো হয়, তবে তার ভুনা হবে জবরদস্ত। সেই ভুনার মহিমাই আলাদা। মনে রাখতে হবে, মাংসের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাসনে আছে ছাগলের মাংস। খাসির বিরিয়ানি সর্বসেরা। গরু, মহিষ, ভেড়া, কুক্কুট সেখানে ডাহা ফেল। ছাগলের দুগ্ধও না কি অনেক পুরাতন রোগের ঔষধি। কালো ছাগমাতার দুধ খেলে না কি হাঁপানিও সেরে যায়। আমি শিশুকালে রুগ্ন ছিলাম ব'লে আমার মাতৃদেবী আমাকে নিয়মিত কালো ছাগলের দুগ্ধ পান করাতেন। কাঁথায় শোয়া অসহায় অবোধ আমার প্রতি কী সব অত্যাচার হয়েছে ভাবলে এখন রাগ হয়। তবে যবে থেকে আমার বোঁচা নাক ঘ্রাণ নেবার উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল এবং সুগন্ধ দুর্গন্ধের পার্থক্য করবার জ্ঞান অর্জন করেছিল, তারপর থেকে মাতৃদেবী মেরেধরেও আমাকে আর কালো ছাগলের দুধ খাওয়াতে পারেননি। যদিও নিন্দুকেরা বলেন আমার ফর্সা রং আমার বাবা-মায়ের জিন থেকে নয়, কালো ছাগলের দুধ থেকে পাওয়া।
প্রিয় লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় কোন একটা লেখার মধ্যে লিখেছিলেন ছাগলের জন্মই হয়েছে মানুষের জিভের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য। তার আর কোনও কাজ নেই। একেবারে নির্ভেজাল সত্যবচন। লাঙল চালাতে পারে না। গাড়ি টানতে পারে না। গোবরের বদলে নাদি ত্যাগ করে, যা সার তৈরির ক্ষেত্রেও তেমন জনপ্রিয় নয়। গোবরের অনেক রকমের প্রয়োগ আছে। ঘুঁটে এবং উৎকৃষ্ট সার হয়। কঠোর হিন্দুূদের কাছে উঠোন বা মার্বেলের মেঝে শুদ্ধ করার উপচার হিসেবেও গোবরের ব্যবহার হয়। উন্নতমানের দামি ব্যাগ, বেল্ট, জুতো তৈরিতে গরুর চামড়া লাগে। আর কমদামি নিম্নমানের জুতো, ব্যাগ, পার্স ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয়। অর্থাৎ চর্মশিল্পেও গরুর চামড়ার চাহিদা বেশি। প্রতিবেশীর গরু যদি বাগানের কাঁঠাল চারা মুড়িয়ে খেয়ে নেয়, চিন্তা নেই। কদিনের মধ্যেই দ্বিগুণ পাতা গজিয়ে গাছ ফনফনিয়ে উঠবে। কিন্তু কাঁঠাল চারা ছাগলে খেয়ে গেলে মুশকিল। গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে।
মায়াবী চোখের দৃষ্টি দিয়েও গরু ছাগলকে হারিয়ে দিয়েছে। ছাগলের চোখে মায়াবী ভাষা নেই। নেই ছুরি হাতে গলার নলি কাটতে উদ্যত হওয়া কোনও মানুষকে থামিয়ে দেওয়ার মতো মায়াময় চাউনি। চোখের চাউনি, চোখ মেলে তাকানো এসব খুব দামি ব্যাপার। কতকিছু সেট হয়ে যায় ওই একবার তাকানোতেই। জাস্ট একটা মায়া ভরা লুক, যা উড়ন্ত চুম্বনের চেয়েও বেশি কার্যকরী। যিনি সন্ন্যাসী হবেন ভেবে সংসার থেকে পা প্রায় বাড়িয়েই রেখেছিলেন, তিনি এইরকম একটা চোখের পাল্লায় প'ড়ে বিকেলবেলায় মোড়ের দোকান থেকে ম্যাচিং করে চায়ের কাপ-প্লেট কিনে আনলেন। ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে একটা বনেদি ড্রেসিংটেবিলের বায়না দিয়ে এলেন। খুনখারাপি, চুরি-ডাকাতি করা ছাড়া যার জীবনে আর কোনও ভালো কাজ নেই, তাকেও ভ্যাবলা টাইপের ভালো করে দিতে পারে কোনও জলভর্তি করুণ চোখের আকুতি।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম— ছাগলের চোখ সুন্দর না হলেও আপনার চোখে চোখ ফেলতে পারে। মোটা দাগের দৃষ্টি। ছ্যাবলামি করে আপনি দোতলা থেকে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ আওয়াজ করলে ছাগল লম্বা কানটাকে একটু নাড়িয়ে ডাইরেক্ট দোতলার বারান্দার দিকে মুখ উঁচু করে আপনার চোখের দিকে তাকাবে। মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকলে কথাটা মিলিয়ে নেবেন।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি দেশি ছোট সাইজের কালো ছাগলগুলোর কান ছোট হয়। আর পাটনাই বা হাইব্রিডের ছাগলগুলোর কান ইয়া বড়ো। তাদের গায়ে বিচিত্র সব রঙের ছিটেফোঁটা থাকে। এদের মাংসই বদবুদার। পাঁঠাগন্ধী। যাঁরা চিরতরে ছাগলের মাংস খাওয়া ছেড়েছেন, তাঁরা এই বদবুদার ছাগলের মাংস খেয়েই অমন মা-কসম টাইপের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার আর ও পথ মাড়াননি। আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি দেশি কালো ছাগলের মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলে তাঁরা খাসির মাংসের ওপর থেকে ভরসা হারাতেন না।
যদুবাবুর বাজারের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় রাস্তার বাঁ-দিকে যে পর পর ছাগলের মাংসের দোকানগুলো আছে— তার সামনে দিয়ে গেলে বোঁটকা গন্ধে আমারও কতবার মনে হয়েছে জীবনে খাব না। কিন্তু তপসিয়ার ভেতরে জ্বিন মসজিদের কাছে একটা অনামী দোকানের ছোট কানওয়ালা এবং নরম হাড়ের ছাগলের মাংস খেয়ে সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি।
আসলে যাঁরা খাসি কিনতে যান, তাঁরা সকালবেলার হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা দেখতে চান না বলেই একটু বেলায় যান। ততক্ষণে পাটনাই না দেশি, কালো না পাটকেল— কিচ্ছুটি বোঝার উপায় থাকে না।
মাংস কেনার সময় এক্সট্রা চর্বি না নেওয়াই ভালো। একদা, দোকানি মাংসের সঙ্গে একটুকরো মেটে দিতেন ফাউ হিসেবে। যবে থেকে 'আচ্ছে দিন' এসেছে মানুষের জীবন থেকে সব ফাউ চলে গেছে। এখন দোকানি ফাউ হিসেবে চর্বির তাল দেন। ভাবখানা এই, "ফাউ নিবি? নে। খেয়ে মর।" আমি বলি চর্বি লাগবে না, চর্বির মাপের মাংস দিন। দোকানি দাঁত খিঁচিয়ে বলেন "চর্বি নিতে হলে নিতে নিন নইলে… "বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে ওর লাভ কীভাবে কমে যাচ্ছে, সেই ইতিহাস শোনাতে শুরু করেন।
শুধু চর্বি কেনারও খদ্দের আছে। অনেকে বিরিয়ানি রাঁধার সময় মাংসে একটু চর্বি দেন, তাতে তেল ঘি কম লাগে। কেউ কেউ খাসির চর্বি দিয়ে ছোলার ডাল রাঁধেন। ঘুগনি বানান। একরকম কাবাবেও খাসির ফ্যাট লাগে।
দোকানির লসের হিস্ট্রি না শুনে মাংসটা কিনে সবজি বাজারে ঢুকতেই হয়। তুলতুলে ভুনার জন্য একটা টাটকা এবং ডাঁটো পেঁপে সবচাইতে বেশি জরুরি কি না!
ভুনা শব্দের অর্থ কষা। বাংলা অভিধানে কষা'র অর্থ আছে অল্প আঁচে ভাজা। মশলা দিয়ে কষিয়ে অল্প আঁচে মুখ বন্ধ হাঁড়িতে মশলার রসে প্রায় এক বা দেড় ঘণ্টা ধরে যে মাংস রচিত হবে সেটাই হল ভুনা। ভুনার তুলতুলে মাংসের জন্য টাটকা কাঁচা পেঁপের আঠা বা রস লাগবে। আঠার পদ্ধতিটা আমি শিখেছিলাম রাজাবাজারের এক ফুটপাতবাসিনীর কাছ থেকে। স্বামী, ভাশুর, দেওর, জা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটি একান্নবর্তী পরিবার। রাস্তার ওপরেই।
ফুটপাতের ওই একান্নবর্তী পরিবারটির খানদানি ব্যবসা ছিল প্লাস্টিকের বোতল কুড়নো। দড়ি দিয়ে বাঁধা রাশিরাশি বোতল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার পাশে। কোরবানির সময় তারা ঘুরে ঘুরে প্রচুর মাংস সংগ্রহ করত। গরু, ছাগল, উট— এই তিনরকম মাংস একসঙ্গেই একটা প্রকান্ড হাঁড়া (বিশাল বড় হাঁড়ি)তে ঢেলে দিয়ে রান্না করত।
ওই পরিবারের এক বৃদ্ধা আমাকে ভারি পছন্দ করতেন। আধার কার্ড আছে কি না, এতগুলো পেট স্রেফ বোতলের ব্যবসাতেই চলে, না কি আরও অন্য উপায় আছে! পুলিশকে কিছু দিতে হয় কি না— এসব প্রশ্ন করে তাঁকে বিরক্ত করতাম না বলে আমাকে দেখলেই তিনি নিশ্চিন্তে তাঁর গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতেন। তাঁর যে এককালে কত সুখ ছিল— সেসব গল্প।
ওখানেই দেখেছিলাম পেঁপের আঠা দিয়ে মাংস ম্যারিনেট করে রাখতে। আঠা তো তেতো, একথা বলাতে তিনি আমার অজ্ঞতায় হেসেছিলেন। আরও বলেছিলেন তোলা উনুনে রান্না করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাংস গলে ক্ষীর হয়ে যাবে। তিনি পায়েস নয়, ক্ষীর শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন। নবমীর দুপুরে যারা বাড়িতেই মাংস রাঁধবেন ঠিক করেছেন, তাঁদের জন্য রইল ভুনা আর গলৌটি কাবাবের সহজ রেসিপি। খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছিল... (Food Blog)
মাটন ভুনা
উপকরণ: মাটন এক কেজি, একটা মাঝারি সাইজের কাঁচা পেঁপে, ঝিরি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ অনেকটা, আদা-রসুন বাটা, এক কাপ টক দই অথবা একটা বড় সাইজের টমেটো, হলুদ জিরে লঙ্কার গুঁড়ো, গোলমরিচের গুঁড়ো, আস্ত শুকনো লঙ্কা, আস্ত গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, নুন, চিনি, সর্ষের তেল, চার/ পাঁচটা গোটা লাল সবুজ কাঁচা লঙ্কা।
প্রণালী: এক কেজি মাটনের জন্য একটা মাঝারি সাইজের কাঁচা পেঁপে কুরিয়ে নিন। এবার কোরানো পেঁপে চিপে রস বের করে সেই রস আর নুন দিয়ে মাটনটা ম্যারিনেট করে রেখে দিন আধঘণ্টা মত। আর হ্যাঁ, মাটন ভালো করে ধুয়ে, সুতির কাপড় দিয়ে জল মুছে তারপর ম্যারিনেট করবেন। ধুতে গিয়ে ফালতু চর্বি, যেগুলো জলে ভেসে উঠবে, ফেলে দেবেন।
এবার হাঁড়িতে সর্ষের তেল গরম করুন। খুব বেশি তেল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। টক দই পড়লে এমনিই তেল ছাড়বে।
তেল গরম হলে দুটো তেজপাতা, দুটো শুকনোলঙ্কা, দশটা গোটা গোলমরিচ, তিনটে ছোট এলাচ, দারচিনির একটা বড়ো কাঠি দিয়ে দিন। মশলাগুলো চড়বড় করে ফুটলে ঝিরি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজগুলো দিয়ে দিন। পেঁয়াজ সোনালি হলে আদা রসুনের পেস্ট দিন। একটু নেড়ে পেঁপের রস সমেত মাংসটা ঢেলে দিন। নাড়তে নাড়তে হলুদ গুঁড়ো,ধনে জিরে লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে দিন। আঁচ একেবারে ঢিমে করে দিয়ে ভুনতে থাকুন। গোলমরিচের গুঁড়ো দিন অল্প। এখন আপনি পেঁপের রস, আদারসুনের রস দিয়ে মাংস কষছেন। এবার এককাপ টক দই ভালো করে ফেটিয়ে মাংসে দিন। টক দইয়ের কাপধোয়া জলটুকুও দিয়ে দিন। (Food Blog)
শুরু হল দ্বিতীয় প্রস্থের কষা। যাঁরা টক দইয়ের বদলে টমেটো দিতে চান তারা এককাপ টমেটোকুচো এখনই দিয়ে দেবেন। এই পর্বের কষার সময়েই দেখবেন মাংস ছেড়ে ছেড়ে আসছে। এবার টাইট ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
বাষ্পের জলে বাকি রান্নাটা হয়ে যাবে। হাঁড়ির তলা যাতে না ধরে যায়, সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। হাঁড়ির ঢাকনার ওপরে পাঁচখানা ছোট এলাচ রেখে দিন। গরমে কুড়মুড়ে হয়ে গেলে শিলে গুড়িয়ে মাংসে দিন। তার আগে নুন চিনি দিতে হবে স্বাদমতো। সবশেষে চার-পাঁচটা বোঁটাশুদ্ধ আস্ত কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে দিয়ে ঢাকনা এঁটে গ্যাস বন্ধ করে দিন।
কাটা মশলায় মাংস
উপকরণ: মাটন ১ কেজি, ঝিরিঝিরি করে কাটা আদা ২ চা চামচ, রসুন কুচি ২ চা চামচ, পেঁয়াজ একটু মোটা করে কাটা ১ কাপ, শুকনোলঙ্কা কুচো ১ টেবিল চামচ, হলুদগুঁড়ো, আস্ত জিরে ১ চা চামচ, আস্ত গোলমরিচ ৭/৮ টা, ছোট এলাচ ৫ টা, লবঙ্গ ৪ টা, দারচিনি ২ টো কাঠি, ১ টা তেজপাতা দু টুকরো করা, নুন, পরিমাণমতো সর্ষের তেল বা সাদা তেল।
প্রণালী: মাংসের সঙ্গে সমস্ত উপকরণ ভালো করে মিশিয়ে একঘণ্টা ম্যারিনেট করে রাখুন। তারপর যে হাঁড়িতে বা ডেগচিতে মাংস রান্না করবেন,তাতে ম্যারিনেট করা মাংসগুলো ঢেলে ঢাকনা এঁটে মাঝারি আঁচে রান্না করুন। যদি মনে হয় জল দেওয়ার প্রয়োজন আছে তবেই আধকাপ বা এককাপ উষ্ণ জল দিয়ে রান্না করে দিন। মাংস সেদ্ধ আর মাখামাখা হলে খরে মশালা গোশত বা কাটা মশলায় রান্না মাংস নামিয়ে নিন।
গলৌটি কাবাব
উপকরণ: মাটন কিমা ১ কেজি, কাঁচা পেঁপে বাটা, পেঁয়াজবাটা, আদাবাটা, রসুনবাটা, লঙ্কার গুঁড়ো, নুন, ভাজবার জন্যে তেল, গলৌটি মশলা (বড় এলাচ, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ, জিরে, ধনে, জায়ফল, জৈত্রেয়ি, শুকনো গোলাপের পাপড়ি। মশলাগুলো মিহি করে গুঁড়ো করে নিতে হবে।)
এর সঙ্গে লাগবে ৫০ গ্রাম বেসন, ৫০ গ্রাম ছোলার ডাল বাটা। আর লাগবে গোলাপ জল।
প্রণালী: প্রথমে মাংসের কিমা মিক্সিতে মিহি করে পেস্ট করে নিতে হবে। ওর মধ্যে পেঁয়াজ বাটা,আদা রসুনবাটা, পেঁপে বাটা, লঙ্কারগুঁড়ো মাখিয়ে ঘণ্টাখানেক ম্যারিনেট করে রাখতে হবে। তারপর সমস্ত গুঁড়ো মশলা, বেসন, ডাল, নুন মাখিয়ে মণ্ড বানিয়ে ফ্রিজে আরো দু ঘণ্টা রেখে দিন। মণ্ডটা জমে গেলে ওর থেকে ছোট ছোট গোল্লা বানিয়ে একটু চ্যাপটা করে গড়ে গরম তেলে দুইপাশ সোনালি করে ভেজে তুলুন।
সারাবছর যেমনতেমন খেলেও পুজোর দিন কটা একটু ভালোমন্দ খাবার সকলেই খাবেন। প্রতিবেশী কাকু কাকিমার কাছেও বাটিভর্তি সুখাদ্য পৌঁছে যাবে। কাকিমা সেই বাটি ফাঁকা পাঠাবেন না। নিজের হাতে নারকেল নাড়ু তৈরি করে পাঠাবেন। সেই নারকেল নাড়ুর গায়ে লেগে থাকবে হালকা কর্পূরের গন্ধ। খাওয়াদাওয়া, আনন্দে, আড্ডাতে পুজোর দিনগুলো প্রকৃত অর্থেই মহোৎসব হয়ে উঠুক।
সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানালাম।