অনেকে এই মিষ্টির সঙ্গে ওড়িশার তুলনা বা প্রভাব টেনে থাকেন। বিস্তৃত গবেষণা না হলেও, এটুকু হলফ করে বলা যায়, পড়শি রাজ্যে যে ক্ষীরমোহনের চল রয়েছে, যার সঙ্গে রসগোল্লার নিবিড় যোগ, তা সোমড়াবাজারের নিটোল গোল মিষ্টির চাইতে অনেক আলাদা।
ক্ষীরমোহন
শেষ আপডেট: 22 June 2025 12:21
‘বাংলার মিষ্টি-কথা’র আজকের কিস্তিতে এমন এক মিষ্টান্নের কথা বলব, যা খেতে হলে আপনাকে কাটতে হবে কাটোয়া লোকালের টিকিট৷ এক্সপ্রেস নয়, নির্ভেজাল লোকাল৷
তারপর সিটে বসে ঢুলতে ঢুলতে ট্রেনের দুলুনির ছন্দ কানে নিয়ে, হাওয়ার গন্ধ গায়ে মেখে যখন সোমড়াবাজার ঢুকবেন, তখন সহযাত্রীর কনুইয়ের গুঁতো নয়, আপনা থেকেই ঝিমুনি যাবে কেটে। শুনতে পাবেন হাঁকডাক ‘ক্ষীরমোহন… ক্ষীরমোহন’। তন্দ্রা কাটবে। দু'চোখ হাল্কা কচলাবেন। আর সামনে তাকালেই দেখতে পাবেন কাঁসা বা স্টিলের ইয়া বড় থালা মাথায় মিষ্টি বেচতে লোকালে উঠে পড়েছেন গুচ্ছের হকার।
লোকাল ট্রেন এমনিতে চলমান খানা খাজানা। কিন্তু এই মামলায় কাটোয়া লোকালকে আলাদা করেছে ক্ষীরমোহন। এমন মিষ্টি, যা দোকানের বদলে ট্রেনে বেচা হয়৷ তৈরি হয় হুগলির সোমড়াবাজারে। ভোলা সরকার থেকে ঘঁটু ময়রা। অনেক জনপ্রিয়, কিংবদন্তি মিঠাইওয়ালা ক্ষীরমোহনকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছেন। কিন্তু কেউই আলাদা করে দোকান খুলে সেভাবে বিক্রি করেননি। কোভিডের সময় অনেক দিন ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় খুচরো কেনাবেচা শুরু হলেও ক্ষীরমোহন ঐতিহাসিকভাবে লোকাল ট্রেনের নিজস্ব সম্পদ!
অনেকে এই মিষ্টির সঙ্গে ওড়িশার তুলনা বা প্রভাব টেনে থাকেন। বিস্তৃত গবেষণা না হলেও, এটুকু হলফ করে বলা যায়, পড়শি রাজ্যে যে ক্ষীরমোহনের চল রয়েছে, যার সঙ্গে রসগোল্লার নিবিড় যোগ, তা সোমড়াবাজারের নিটোল গোল মিষ্টির চাইতে অনেক আলাদা।
‘উৎকল-পক্ষে’র দাবি: পুরীর মন্দিরে লক্ষ্মীর প্রসাদ হিসেবে ক্ষীরমোহন নিবেদিত হয়ে থাকে। দেখতে ঈষৎ লালচে। কিন্তু রসসিক্ত৷ এককথায় কড়াপাকের, চড়া মিষ্টির রসগোল্লা।
<em><strong>ওড়িশার ক্ষীরমোহন</strong></em>
কিন্তু ‘বাংলা-পক্ষে'র মিঠাইখানি শুকনো। রস আছে। কিন্তু তা অন্ত:সলিলা, ভেতরে আঁট বাঁধা।
যদিও প্রভাব যে একেবারেই নেই, সেটা জোরগলায় বলা মুশকিল। এই নিয়ে লৌকিক কিংবদন্তিও বেশ জনপ্রিয়। কথিত আছে, শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে আসামাত্র ক্ষীরমোহনের বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন। বাড়ি ফিরে পার্ষদ, অনুচরদের কাছে গল্প করেন। সেই শুনে শান্তিপুর, ফুলিয়ার অনেক মিষ্টির কারিগর ওড়িশার পুরোপুরি অনুকরণ নয়, অনুসরণ মেনে নিজস্ব কৌশল মিশিয়ে ক্ষীরমোহন বানাতে থাকেন।
কোথায় এই দুই জায়গার মিষ্টি আলাদা হয়ে গেল? আগেই বলেছি, ফারাকটা রসের। দু'জায়গাতেই প্রধান উপকরণ ছানা। অনুপান চিনির রস। তাই দিয়ে তৈরি হল রসগোল্লা। তারপর তাকে রসের সঙ্গেই জ্বাল দেওয়ার পালা। অনেকক্ষণ ধরে। তাতে রসগোল্লার সাদা রং বদলে যাবে বাদামিতে। আঁচ বাড়ালে গাঢ় বাদামি। বেরতে শুরু করবে সুন্দর গন্ধ৷ এরপরই জ্বাল বন্ধ। খানিক বাদে কড়াই নামিয়ে ঠান্ডা করা। তৈরি হবে ওড়িশার রসবন্ত ক্ষীরমোহন।
<em><strong>বাংলার ক্ষীরমোহন </strong></em>
বঙ্গজ মিঠাইওয়ালারা এখানেই ট্যুইস্ট এনেছেন। তাঁরা সেই বাদামি রসগোল্লাকে ঠান্ডা করার পর হাত দিয়ে চিপে রস নিংড়ে নিয়েছেন। তাতে মিষ্টিগুলি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপচে গিয়ে ফের ফুলে ওঠে। তারপর উপরে ক্ষীরের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই ‘বাংলার’ রসস্থ ক্ষীরমোহন রেডি!
বিজনবিহারী ভট্টাচার্য (‘বঙ্গীয় মিষ্টান্ন সংস্কৃতির একদিক’) আরও এক ক্ষীরমোহনের সন্ধান দিয়েছেন। তা গোল হলেও চ্যাপ্টা। বাইরে ছানার আস্তরণ। ভেতরে ক্ষীরের পুর। বিজনবিহারীর অনুমান, বাংলার লোকজ ‘মৌচাক’ও ক্ষীরমোহনের উত্তরসূরী। তফাত একটাই। ক্ষীরমোহন গোলাকার। মৌচাক দ্বিখণ্ড—দেখতে আধখানা চাঁদের মতো!
সোমড়াবাজারের ভোলা সরকার প্রায় ৪৭ বছর ধরে ক্ষীরমোহন বিক্রি করে চলেছেন। লকডাউনের সময় হাতের টাকা জমিয়ে দোকান খুলেছেন৷ তাঁর বাবা ধীরেন, জেঠু অঘোরও এই মিষ্টি বানাতেন। আজও বীরেন দে, ক্ষিতীশ সাহার মতো অনেকে এই ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। দোকান খুলেছেন বটে। আজকাল খুচরো বিক্রিও শুরু হয়েছে। কিন্তু ট্রেনের হকারদের পাইকারি ক্ষীরমোহন বেচেই আসে আসল মুনাফা।
নিত্যযাত্রীদের পরম সম্পদ ক্ষীরমোহন সর্বার্থে ‘হিডেন জেম’!