সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 16th October 2024 19:19
'শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি
সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি।
প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।'
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এ গান ছাড়া বাঙালির কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো সম্পূর্ণ হয় না। আলপনা, আম্রপল্লব, পান-সুপারি-সিঁদুরের মতো 'এসো মা লক্ষ্মী' গানও লক্ষ্মী পুজোতে অপরিহার্য। এ গান যেন পুজোর মন্ত্র হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এই গানটি কয়েক বছরের তফাতে দু-দু'বার রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু কেন? গানটির জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল, যে কারণে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দু'সময়ে দু'বার করে গাইতে হয় লক্ষ্মী পুজোর এই গান।
নেট পাড়ায় এই গান নিয়ে গুঞ্জন ঘুরছে, সন্ধ্যার প্রথম রেকর্ড করা 'এসো মা লক্ষ্মী' নষ্ট হয়ে যেতেই নাকি দ্বিতীয় বার ফের এই গান রেকর্ড করেন গায়িকা। এই তথ্য একেবারেই ঠিক নয়। তবে সন্ধ্যা কয়েক বছরের তফাতে গানটি আবার রেকর্ড করেন এটি সত্য। কেন দু'বার একই গান রেকর্ড করেছিলেন সন্ধ্যা?
দেবনারায়ণ গুপ্তের লেখা মঞ্চ সফল নাটক 'দাবী'কে রুপোলি পর্দায় এনেছিলেন পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়। থিয়েটারে অভিনয় করেন নীলিমা দাস,সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়,অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য। ১৯৭৪ সালে কনক মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় 'দাবী' ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। নায়ক-নায়িকা ছিলেন শমিত ভঞ্জ ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও ছিলেন তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সন্ধ্যারাণী,অসিতবরণ, বিকাশ রায়,দীপ্তি রায়, অনুপকুমার, শেখর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সংগীত পরিচালক অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই। ছবির গীতিকার ছিলেন মিল্টু ঘোষ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র,পিন্টু ভট্টাচার্য -র মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা গেয়েছিলেন। কিন্তু 'দাবী' ছবিটি সেভাবে সংরক্ষণই করা হয়নি, তাই আর দেখা যায় না। ছবি না পাওয়া গেলেও গানটি কিন্তু সংরক্ষিত।
১৯৭৪ সালে 'দাবী' ছবিটি সেভাবে দর্শকধন্য হতে না পারলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'এসো মা লক্ষ্মী' জনপ্রিয় হয়ে গেছিল বাঙালির ঘরে ঘরে। সবথেকে বড় ব্যাপার ১৯৭৪ সালের আগে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর জন্য এমন কোনও গান তৈরি হয়নি। সুরকার অমল মুখোপাধ্যায় ও গীতিকার মিল্টু ঘোষ তৈরি করে ফেললেন এমন এক গান। অমল মুখোপাধ্যায় গায়ক হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়তা পান। তাঁর কন্ঠে 'টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে', 'চুপ চুপ লক্ষ্মীটি' সেকালের সুপারহিট গান ছিল। সুরকার হিসেবে তাঁর প্রথম বড় হিট সুচিত্রা সেনের 'হসপিটাল'। গীতা দত্তের 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়' গানের সুরকার ছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়। অমল মুখোপাধ্যায় আর মিল্টু ঘোষ সুরকার-গীতিকার হিট জুটি ছিলেন সে সময়ের। মিল্টু ঘোষ লিখেছিলেন 'বড় একা লাগে' গানটিও। সে গানের সুর করেছিলেন অসীমা মুখোপাধ্যায়।
কয়েকজন অপপ্রচার করছেন, গ্রামাফোন কোম্পানির রেকর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়াতেই নাকি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় 'এসো মা লক্ষ্মী' আবার গেয়েছিলেন। এটা একেবারেই ঠিক নয়। রেকর্ড সংগ্রাহকদের কাছে আছে 'দাবী' ছবির সেই রেকর্ড। সংগ্রাহক অধ্যাপক জয়দীপ চক্রবর্তী জানালেন "১৯৭৪ তো বেশিদিনের কথা নয়। 'দাবী' ছবিটির প্রিন্ট আর বর্তমানে দেখা না গেলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানের রেকর্ড অনেকের কাছেই পাওয়া যাবে। গ্রামাফোন কোম্পানির কাছেও নষ্ট হয়নি। যেমন আমার কাছেই আছে। আশির দশকের শুরুতেই এল পি রেকর্ডে স্টিরিও সাউন্ডে নতুন করে গেয়েছিলেন সন্ধ্যা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-ও তো 'রানার','অবাক পৃথিবী' নতুন করে পরে গেয়েছিলেন এল পি র জন্য। আগের থেকে পরিণত গায়কী।
চাহিদার কারণে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'শঙ্খ বাজিয়ে' গান সম্বলিত 'দাবী' (১৯৭৪) ছবির রেকর্ড দশ বছর পর রি-রিলিজ করা হয় আবার ১৯৮৪ সালে। পুরনো রেকর্ড নষ্ট হয়ে থাকলে ১৯৮৪ সালে কীভাবে তা রি-রিলিজ হল? 'দাবী' ছবিতে দশটি গান থাকলেও কেবলমাত্র সন্ধ্যার 'শঙ্খ বাজিয়ে' ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। এখানেই বোঝা যায় কী অসামান্য জনপ্রিয়তা। নষ্ট হবার তো প্রশ্নই নেই গানটি। যদি কোনও গান ছবিতেই থাকত রেকর্ডে প্রকাশ না পেত,তাহলে হারিয়ে যাবার কারণ ছিল। প্রযোজকের একার অধীনে গান থাকলে হারিয়ে যেতেও পারে।
কিন্তু যে গান রেকর্ডেই আছে, দুবার প্রকাশ হয়েছে, সে গান হারাবে কেন?"
এই গানের সুরকার অমল মুখোপাধ্যায়ের কন্যা বললেন, "এসো মা লক্ষ্মী নষ্ট হয়ে গেছিল এমন কথা তো কস্মিনকালেও শুনিনি। গানটি তো রেকর্ডে ছিলই। আমাদের বৌদি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের লিপে ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এ গান।"
তাহলে আবার সন্ধ্যা রেকর্ড করলেন কেন 'শঙ্খ বাজিয়ে' আশির দশকের গোড়ায়? আসল কারণ হল গানটি প্রকাশ পায় তিন বার। প্রথম 'দাবী' ছবিতে প্লে ব্যাক করেন সন্ধ্যা। তখন মুক্তি পায় প্রথম 'দাবী' সিনেমার রেকর্ড। এরপর আশির দশকের শুরুতেই এল 'স্টিরিও' রেকর্ডের যুগ। ঐ সময় গ্রামাফোন কোম্পানি এলপি রেকর্ডে ১২ টি গান থাকত। সন্ধ্যা নিজের কিছু পুরনো গান এল পি র জন্য নতুন করে নতুন সংগীতায়োজনে গেয়েছিলেন। নতুন আধুনিক স্টিরিও রেকর্ডে গানের আধুনিকীকরণ করতেই গাওয়া। যেমন 'পথে হল দেরী'র 'এ শুধু গানের দিন' আবার গেয়েছিলেন সন্ধ্যা। 'শঙ্খ বাজিয়ে' দ্বিতীয় বার যখন সন্ধ্যা গাইলেন তখন তা শুনতে আরো ভাল লাগল, আরো স্পষ্ট লাগল। সুর কথা অবিকৃত ছিল। শুধু উন্নত মানে সংগীতায়োজন করেন ভি বালসারা। ১৯৮৪ তে আবার 'দাবী' ছবির রেকর্ডটি রি-রিলিজ হয় এই গানের চাহিদার কারণে। সন্ধ্যা এল পির জন্য নতুন করে গাইবার পরও পুরনো ভার্সনটি রি-রিলিজ করে।
এমনও রটনা আছে, 'দাবী' ছবিতে সন্ধ্যার গানের প্রিলিউডে নাকি ঘুঙুর বেজেছিল। এই তথ্যটিও সত্য নয়। 'দাবী' ছবির রেকর্ড শুনলেই শোনা যায় শুরুতে শঙ্খধ্বনিই রয়েছে। এমনকী অনেক সংবাদমাধ্যম বলে বসেছিল 'দাবী' ছবির পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়,যা আরো একটি ভুল তথ্য। ১৯৩৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'দাবী' নামে একটি ছবি করেন। পদ্মা দেবী, ধীরাজ ভট্টাচার্য অভিনয় করেছিলেন। তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রবেশই ঘটেনি বাংলা ছবিতে।
১৯৭৪ যদিও সন্ধ্যার কেরিয়ারের শেষের দিক। সহ-অভিনেত্রীদের লিপেও তখন গাইছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কারণ সুচিত্রা সেন ছবি করা কমিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা ছবিতে লতা মঙ্গেশকর,আশা ভোঁসলে, আরতি মুখোপাধ্যায়ের দাপট বেড়ে গেছিল সেই সময়। 'এসো মা লক্ষ্মী' গানটি যেন সন্ধ্যাকে নতুন করে শিরোনামে এনে দিয়েছিল। আজও আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এই গান ছাড়া ভাবা যায় না। আর কোনও লক্ষ্মীপুজোর গানই সন্ধ্যার 'এসো মা লক্ষ্মী' গানের বিকল্প হতে পারেনি।