কার পাপে
শেষ আপডেট: 9 May 2025 12:45
ইদানীং ওটিটি ওয়েব সিরিজের যুগে সাহসী কনটেন্ট দেখতে বাঙালি দর্শকরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তবে সেখানে শিক্ষামূলক বার্তা কিছুই থাকে না। শুধু নিষিদ্ধ যৌনতাকে দেখাতেই সিরিজগুলো তৈরি হয়। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর পাঁচের দশকের শুরুতেই এমন একটি সাহসী বাংলা ছবি তৈরি হয়েছিল। সেই বিতর্কিত ছবির নাম 'কার পাপে' (Kaar Pape)। গতকাল ছিল স্বর্ণযুগের অভিনেত্রী পরিচালিকা মঞ্জু দে-র (Manju Dey) জন্মদিন। 'কার পাপে' ছবিতে প্রধান চরিত্রে মঞ্জু দের অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। যৌনরোগ নিয়ে সচেতনতামূলক বাংলা ছবি (Adult Bengali Film) ইতিহাসে সেই প্রথম।
এইডস নিয়ে যেমন এখন সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমন তিন চারের দশকে সিফিলিস অতি মারাত্মক যৌন রোগ ছিল। বহুগামী সম্পর্কের থেকেই এই রোগ মূলত হত। শুধু তাই নয়, রোগটি ছিল ভীষণ ছোঁয়াচে। আর সেই রোগের চিহ্ন ফুটে উঠত সারা দেহে । বহুদিন চলা বিখ্যাত মামলার ভাওয়াল রাজাও সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালের ১৫ অগস্ট উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলা সিনেমা হলে মুক্তি পায় কালীপ্রসাদ ঘোষের ছবি 'কার পাপে'। সেদিন বাংলা ছবি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। যে শিখর ছুঁতে আর কোনও বাংলা ছবি পেরেছে কিনা সন্দেহ। অসিতবরণ, মঞ্জু দে, উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস, রেবা দেবী, রেণুকা রায় প্রমুখ অভিনয় করেন ছবিতে। উত্তমকুমার তখনও হিরোর রোলে সফলতা পাননি। এ ছবির মূল অভিনেতা অসিতবরণ আর মঞ্জু দে। অসিতবরণ সিফিলিস রোগীর ভূমিকায় অভিনয় করে এ ছবির খলনায়ক হয়ে উঠেছিলেন । ছবিটির পরিবেশক ছিল 'অগ্রদূত'।
অসীম (অসিতবরণ) এক সন্ধ্যায় রুমালে মুখ লুকিয়ে আসেন সিফিলিস রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বোসের (ছবি বিশ্বাস) চেম্বারে। পরীক্ষা করে চিকিৎসক বলেন অসীমের সিফিলিস হয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। অসীম অবিবাহিত কিন্তু বহুগামিতার কারণে এই রোগের কবলে। চিকিৎসক অসীমকে সাবধান হতে বলেন কিন্তু তিনি রোগের দাগ মুখ থেকে মিলিয়ে যাওয়ার পর ছেড়ে দেন চিকিৎসা। ডাক্তার বোস ছবি বিশ্বাস অসীমকে বিয়ে করতেও বারণ করেছিলেন। কিন্তু যৌন তাড়না থেকেই রোগের কথা গোপন রেখে বিউটিকে বিয়ে করেন অসীম। বিউটি ছবির নায়িকা মঞ্জু দে। বিউটি নাম সার্থক। মঞ্জুর প্রথম যৌবনের এ ছবিতে রূপের ছটা ফেটে পড়েছিল। কিন্তু সন্তানসম্ভবা বিউটির হঠাৎ কোমরের অসহ্য যন্ত্রণায় নষ্ট হয়ে যায় সন্তান। উত্তরাধিকারের মুখ দেখতে না পাওয়ায় বিউটির দর কমে যায় শাশুড়ির কাছে। অসীম বোঝেন স্ত্রীর সন্তান নষ্ট হওয়ার কারণ তাঁর সিফিলিস রোগ। বহুবার সন্তানের চেষ্টা করে শেষে এক রুগ্ন সন্তানের জন্ম দেন বিউটি। কিন্তু বিউটির সারা মুখে সিফিলিসের দাগ ফুটে উঠে। ওদিকে বিউটির বিধবা ননদ রেণুকা রায় বিউটির প্রসাধন নিয়ে সাজতেন। তাঁর মুখেও সিফিলিসের দাগ ফুটে উঠতে থাকে। অসীমের আনা রোগ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িতে। কিন্তু সেই যে আসল রোগের বাহক সেটা কেউ ধরতে পারে না। স্ত্রীকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না অসীম। ছোট ননদ শেষ অবধি বৌদি বিউটিকে নিয়ে যায় ডাক্তার বোসের চেম্বারে। ডাক্তার বোস জানতে পারেন, সিফিলিসে আক্রান্ত যে অসীমকে তিনি বিয়ে করতে বারণ করেছিলেন তাঁরই স্ত্রী এই বিউটি। বিউটি সব জানতে পেরে স্বামীকে এসে জিজ্ঞেস করে, কেন তাঁর থেকে গোপন করা হয় এই রোগ।
অসীম তাদের সন্তানের চিকিৎসাও ঠিক মতো করায় না। বরং নতুন করে বিয়েতে মেতে ওঠে। অসীমের মা নাতির মুখ দেখার আশায় অসীমের আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিয়ের দিন স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে বিউটি। আরেকটি নিরপরাধ মেয়েকে সিফিলিস রোগের হাত থেকে বাঁচায় বিউটি। এদিকে বিউটির ছোট ননদ বেবির (গীতশ্রী দেবী) বিয়ে হওয়ার কথা শঙ্করের (উত্তমকুমার) সঙ্গে। কিন্তু বেবিরও সিফিলিস ধরা পড়ে। ডাক্তার বোস বেবির সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। পাশে থাকে শঙ্কর ।
যৌন রোগ নিয়ে সরাসরি এমন বৈপ্লবিক কাজ বাংলা ছবিতে সেই প্রথম, সেই শেষ। ছবির বিশেষ শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় তৎকালীন রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় সহ শহরের নামী ডাক্তারদের। ছবি শুরু হওয়ার আগে রাজ্যপালের তহবিলে এক হাজার টাকা দেন ছবির কলাকুশলীরা। এমন সাহসী বিষয়ে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান চিকিৎসকরা। রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন 'হাজার টাকা দিয়ে কর্তৃপক্ষ যতখানি না কৃতজ্ঞতাপাশে বেঁধেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ এমন এক খানি ছবি বঙ্গবাসীকে উপহার দেওয়ার জন্য'।
'কার পাপে' বর্তমানে বিস্মৃত ছবি হলেও এমন সাহসী ও শিক্ষামূলক ছবি বাংলা ছবিকে সময়ের থেকে এগিয়ে দিয়েছিল। এই ছবি আজও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক।
তথ্য সহায়তা- ডাঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ