শেষ আপডেট: 3rd December 2024 11:51
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বলিউডের গ্রেগরি পেক, এভারগ্রিন ম্যাটিনি আইডল- এরকম হাজারও নামের ' ইংলিশ হ্যাট' যাঁর মাথায় রয়ে গিয়েছে, তাঁর নাম দেব আনন্দ। সাদা-কালো থেকে রঙিন সেলুলয়েডে যাঁর অবাধ গতিবিধি। সমসাময়িক এক সে বড় কর এক অভিনেতার দাপট তখন আরব সাগর তীরে। তার মধ্যেই মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের কুইন্স নেকলেসে জ্বলজ্বল করতে থাকা একটাই নাম দেবসাহাব। দেশের কোটি কোটি যুবতী যাঁর ফটো টাঙিয়ে ঘরে মালা পরাত। সিঁথিতে সিঁদুর দিত। নিজেকে দেব আনন্দের মানস-স্ত্রী রূপে কল্পনা করত।
দেব আনন্দের পুরো নাম ধর্মদেব পিশোরিমল আনন্দ। জন্ম পাক পাঞ্জাবের শাকরগড়ে ১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। মৃত্যু আজকের দিনে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর, লন্ডনে ৮৮ বছর বয়সে। ভারতীয় ছবিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তাঁকে পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মান দেওয়া হয়েছিল। প্রায় শতাধিক ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। যার মধ্যে অধিকাংশ সুপার-ডুপার হিট ছবি। এককথায় ভারতের সর্বকালের সেরা সফল অভিনেতাদের মধ্যে এখনও সবার উপরে সিংহাসন পেতে বসে আছেন দেবসাহাব। মাথায় সেই সিগনেচার হ্যাট, যা দেখে পরবর্তীকালে গুরু দত্ত থেকে শাম্মি কাপুর, শশী কাপুর এমনকী অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত অনেকেই তাঁকে নকল করতেন।
সবেমাত্র স্বাধীন হওয়া ভারতের কৈশোর বয়সের সমস্যা তাঁর অভিনীত-পরিচালিত ছবিগুলিতে উঠে এসেছে। বেকারি, চুরিছেঁচরামি, শিক্ষার অভাবে অন্ধকার পথের হাতছানি, কুসংস্কার, নারীদের উপর নির্যাতন, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নিপীড়নের মধ্যেই মেহনত-মজদুরির সৎ জীবন, হিন্দু সংস্কার, হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের কাহিনির সুতোয় যা দিয়ে ছবির মালা গেঁথেছিলেন তা হল প্রেম। অনন্ত প্রেম মিলবে দেব আনন্দের ছবিতে। তাঁর যে কোনও ছবির আদ্যপান্ত হল প্রেমের অনাবিল ঢেউ। সেখানে তিনি কোনওদিন আপস করেননি। তাই শিবের মতো বর পেতে মেয়েরা যেমন পুজো করে, তেমনই একসময় দেব আনন্দের মতো সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া প্রেমিকের খোঁজ করতেন উঠতি বয়সের মেয়েরা।
সেই দেব আনন্দই বহুবার জীবনে সত্যিতারের প্রেমে পড়েছিলেন। যাঁর মধ্যে একজন ছিলেন জিনাত আমন। সাতের দশকে হট-হট-হট জিনাত। হিন্দি ফিল্মের দুনিয়া জিনাতকে কেবলমাত্র স্বল্পবসনা ব্লোহট নায়িকা করে রেখেছিল, কোনওদিন তাঁর অভিনয় নৈপুণ্যের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। সেই জিনাত আমনও তাঁর জীবনে অসংখ্য প্রেমের কাছাকাছি এসেও প্রত্যাখ্যানের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন।
জিনাত নিজেই বলেছেন, অভিনেতা-প্রযোজক-পরিচালক সঞ্জয় খানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। সেই সময় বলিউডের অনেক তরুণ-মধ্য বয়সি অভিনেতা এই বিকিনি গার্ল জিনাতের সঙ্গে প্রেম করার জন্য পাগল। তাঁকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেও হৃদয় ভেঙে চুরমাচুর হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। দেব আনন্দও ছিলেন তাঁদেরই একজন।
জিনাতকে লন্ডনের মাটি থেকে তুলে এনে রাতারাতি ভারতের ফিল্মি দুনিয়ার তারা বানিয়ে দিয়েছিলেন দেব আনন্দ। হরে রাম হরে কৃষ্ণ নামে বিতর্কিত ছবিতে জিনাতকে দিয়ে অসামান্য করিয়ে তাঁকে নিমেষে দেশের যুব সমাজের হার্টথ্রব বানিয়ে নিজেকেও সামলাতে পারেননি দেবজি। তখন দেব আনন্দের বয়স ৪৭ বছর, আর জিনাত বছর ২০-র তন্বী।
এই সময়েই জিনাত আরও একটি ছবিতে সই করেন। সেটা হল রাজ কাপুরের সত্যম শিবম সুন্দরম। দেব আনন্দ মনে মনে পুষে রেখেছিলেন প্রেমের কথা। কিন্তু সেই গোপন কথাটি গোপনেই রয়ে গেল একটি অনুষ্ঠানে। যে অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জিনাত, রাজ কাপুর এবং দেব আনন্দ সকলেই। দেবসাহাব ২০০৭ সালের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, হঠাৎ একদিন আমি টের পেলাম জিনাতকে আমি অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি। আমি ওকে সেকথা জানাতেও চাই। তাজ হোটেলের একেবারে উঁচুতে উঠে সেখানে দাঁড়িয়ে ওকে আমি বলতে চাই, আমি তোমায় ভালোবাসি। ওখানে আমরা একদিন ডিনারও করেছিলাম।
কিন্তু মেট্রো সিনেমা (মুম্বই শহরে) হলে ইশক ইশক ইশক-এর প্রিমিয়ারে দেখলাম প্রকাশ্যে রাজ কাপুর জিনাতকে চুমু খেয়ে অসাধারণ কাজের জন্য শুভেচ্ছা জানালেন। দেব আনন্দ আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, আমার সেদিন খুব হিংসে হয়েছিল। কারণ রাজ কাপুরের সঙ্গে জিনাতের ঘন আচরণও ছিল খুবই স্বাভাবিক। যা দেখে মন ভেঙে গিয়েছিল দেব আনন্দের। ফলে আকাশের কোলের কাছে তাজ হোটেলের শীর্ষ থেকে আর বলা হয়নি প্রেমের কথা। দেব লিখেছেন, মনটা এত ভেঙে গিয়েছিল যে সেখান থেকে আমি চুপিসারে চলে আসি।
জিনাত ছাড়াও দেব আনন্দ প্রেমে পড়েছিলেন সেকালের অসাধারণ সুন্দরী অভিনেত্রী সুরাইয়ারও। কিন্তু সুরাইয়ার দিদিমা তাঁদের সম্পর্কের প্রবল বাধা ছিলেন। পরিবারের আপত্তি, ধর্মের বাধা সত্ত্বেও দেব আনন্দ সুরাইয়াকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে চেয়েছিলেন। সুরাইয়ার মা রাজি থাকলেও দিদিমার আপত্তির কারণে পিছিয়ে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী। তা জেনে ঠাসিয়ে সুরাইয়াকে চড় মেরেছিলেন দেব আনন্দ। চড় খেয়ে সুরাইয়া কেঁদে ফেলেছিলেন। তারপরেই চড় মারার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন দেব আনন্দ। সেই সুরাইয়াকে খুশি করতে দেবজি নিজের হাতে তাঁর একটা ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু, সেই ছবি সুরাইয়ার হাতে পৌঁছতে দেননি তাঁর দিদিমা। ফলে সেবারেও চোরাবালিতে ডুবে যেতে বাধ্য হয় দেবসাহাবের প্রেম।