ট্রেনের কামরায় খুব সাধারণ পোশাকে একজন মানুষ এসে বসে। খুব নম্রভাবে জিজ্ঞেস করে—আপনি কি খেলতে চান? প্রশ্নটা শুনতে যতটা নিরীহ, উত্তর ততটাই ভয়ানক। এ ভাবেই শুরু হয় ‘স্কুইড গেম’-এর মঞ্চ। কোরিয়ান এই সিরিজটির বাইরের মুখোশ যতটা রক্তাক্ত, ভিতরের গল্পটা ততটাই দগদগে বাস্তব।
স্কুইড গেম
শেষ আপডেট: 2 July 2025 08:15
ট্রেনের কামরায় খুব সাধারণ পোশাকে একজন মানুষ এসে বসে। খুব নম্রভাবে জিজ্ঞেস করে—আপনি কি খেলতে চান? প্রশ্নটা শুনতে যতটা নিরীহ, উত্তর ততটাই ভয়ানক। এ ভাবেই শুরু হয় ‘স্কুইড গেম’-এর মঞ্চ। কোরিয়ান এই সিরিজটির বাইরের মুখোশ যতটা রক্তাক্ত, ভিতরের গল্পটা ততটাই দগদগে বাস্তব। পুঁজিবাদ, মানবিকতা, মনস্তত্ত্ব—সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর খেলা, যেখানে হার মানে মৃত্যু, আর জেতার পুরস্কার—অজস্র টাকা, যার বিনিময়ে মানুষ হয়তো কিছুটা শান্তি কিনতে চায়, কিন্তু তার অন্তর আত্মা বিকিয়ে ফেলে চিরতরে।
সিরিজের মূল চরিত্র সেওং গি-হুন। জীবনে ব্যর্থ, পরিবারে অপ্রিয়, সন্তানের চোখে অপদার্থ এক মানুষ। সাধারণ। তার সমস্যাগুলোও বাস্তব—ঋণ, অসুস্থ মা, বাবার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া একরাশ অপরাধবোধ। তার শুরু হয় যাত্রা, এক ভয়ঙ্কর গেমে যেখানে ৪৫৬ জন মানুষ নিজেদের জীবন বাজি রাখে, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার স্বপ্নে। সবাই এসেছে সমাজের ভিন্ন প্রান্ত থেকে—কেউ অভিবাসী, কেউ প্রতারিত, কেউ বিশ্বাসঘাতক, কেউ চোর। কিন্তু একেকজন একেকভাবে মানুষ। তারা ভালো, খারাপ, দ্বিধায় ভোগে, মিথ্যা বলে, কখনও কাঁদে, আবার কখনও বিশ্বাস করে এক অপরকে।
স্কুইড গেম শুরু হয় ছোটবেলার বেশ কিছু খেলার মাধ্যমে। লাল আলো, সবুজ আলো। পরিচিত গেম। কিন্তু এখানে আলো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে বন্দুকের গুলি। আসে মৃত্যু। এক মুহূর্তে দর্শক বুঝে যান—এটা শুধুমাত্র থ্রিলার নয়, এটা মানুষের ভিতরের নৃসংশতা আর ভয়কে একসঙ্গে এমন এক জায়গায় দাঁড় করায়, এমন এক আয়নার সামনে, যেখানে কেউই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।
একটা একটা করে নতুন খেলা—টাগ অব ওয়ার, মার্বেল, গ্লাস ব্রিজ। প্রত্যেকটি খেলার মধ্যে যে ভয় ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, তা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। সবচেয়ে কষ্টের দৃশ্য আসে এক গুলি খেলায়। যেখানে বন্ধুরা, দম্পতিরা, এমনকি সদ্য-পরিচিতরাও দাঁড়িয়ে যায় বিপরীত দিকে। এখানে হেরে যাওয়া মানেই মৃত্যু। অথচ এখানেই মানবতা আর বিশ্বাসের সবচেয়ে গভীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। কিছু চরিত্র শেষ মুহূর্তে সরে যায়, কারও পকেটে গুলি ঢুকিয়ে দেয়, কেউ এপর প্রতিদ্বন্দীকে বলে—‘তুমি বেঁচে থেকো।’
চো সাং-উ চরিত্রটা যেন এক মনস্তাত্ত্বিক ধাঁধা। বাইরে থেকে পরিপাটি, সফল এক ছাত্র, অথচ গেমে ঢুঁকে সবচেয়ে হিংস্র ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সে যেন সমাজের সেই অংশের প্রতিনিধি, যারা নিজের ভাবমূর্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের মানবিকতাকেই হত্যা করে ফেলে। তার সঙ্গে গি-হুনের সম্পর্ক একধরনের ভাই-ভাই সম্পর্ক, যেখানে বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা পরস্পরের হাত ধরে চলে। আর কাং সে-বিয়ক নীরব, সংবেদনশীল চরিত্র। যার মুখে যত কম শব্দ, মনে তত বেশি ব্যথা। তার স্বপ্ন কেবল নিজের ভাইকে ভালোভাবে রাখা। নিজের জন্য কিছুই সে চায় না। তার মৃত্যু, যেন পুরো সিরিজের নীরবতম চিৎকার।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চমক আসে যখন জানা যায়, ও ইল-নাম, যাকে সবাই নিরীহ এক বৃদ্ধ ভাবছিল প্রত্যেকে, তিনিই পুরো গেমের মূল উদ্যোক্তা। এখানেই স্কুইড গেম দর্শককে একটা ভয়ানক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—আপনি যদি সবকিছু পান, সব ভোগ করেন, জীবনে আর কিছুই না পাওয়ার থাকে না, তখন আপনি আনন্দের জন্য কী করবেন?
সিরিজটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা একেকটা গেম, যেখানে আমরা সবাই খেলোয়াড়। আমরা কেউ কেউ হারি, কেউ কেউ জিতি, কেউ আবার হারতে হারতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যাই যে, জিততে ভয় পাই। পরিচালক হোয়াং ডং হিউকের পরিচালনায় প্রতিটি রঙ, প্রতিটি সেট, এমনকি প্রতিটি খেলা চূড়ান্ত পরিকল্পনার ফসল। পিঙ্ক-গার্ডদের নির্লিপ্ততা, বিশালাকার পুতুলের চোখের ভয়, ভেতরে লুকিয়ে থাকা লাল লিফট, সব কিছুতেই এক অস্বস্তি ঢুকে পড়ে।
গি-হুন বেঁচে আছে কিন্তু সে আর আগের মতো নেই। তার চোখে এখন এক শূন্যতা, এক প্রশ্নবিদ্ধ অস্তিত্ব। তার হাতে বিপুল অর্থ, কিন্তু হৃদয়ে অপূরণীয় ক্ষত। সিজনের গোড়ার দৃশ্যগুলোতেই বোঝা যায়, এ এক অন্যরকম লড়াই। এবার আর জীবন বাঁচানোর খেলা নয়, এবার নিজের ভিতরের মানুষটার মুখোমুখি হওয়া। যারা প্রথম সিজনে গেম থেকে ফিরে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই ভেঙে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে, আর সমাজে ফিরেও তারা সমাজের অংশ হয়ে উঠতে পারেনি। এই সিজন ঘনীভূত হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের নীরব মানসিক সংলাপ—‘তুমি বেঁচে আছো, ঠিক আছে, কিন্তু কেমন করে বাঁচছো?’
গি-হুন তার টাকা ছুঁয়েও না দেখে, ঘুরে বেড়ায়, ঘুমের মধ্যে মৃত্যু দেখে কিন্তু জেগে ওঠে বেঁচে থাকার অপরাধবোধে। সে নিজের মেয়েকে দেখতে যায় না, মাকে হারিয়ে ফেলে, লাল চুলে রঙ করে নিজের পুরোনো ‘আমি’কে কবর দিেয় দেয়। তাকে যখন আবার খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন তার চোখের অভিব্যক্তি বলে দেয়—সে এবার খেলবে, তবে অন্যভাবে। সে খেলবে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, খেলবে গেম ভাঙার জন্য, নিয়ম বানানোর বিরুদ্ধে। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সিজনের মূল কাঠামো গড়ে ওঠে—একটি প্রতিশোধ নয়, বরং একটি বোধ।
এই সিজনে চরিত্ররা শুধুমাত্র শিকার নয়, কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াও জানায়, কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে, কেউ কেউ নিজের ইচ্ছেতে গেমে ফিরে আসে, আবার কেউ কেউ পালাতে চায়, কিন্তু পারে না। নতুন গেমারদের মধ্যে একজন তরুণী আছে, যার ছোট ভাইকে বাঁচাতে গেমে যোগ দেয়। তার চোখের মধ্যে ভয় নয়, বরং তীব্র রাগ। এক নতুন মুখ আসে, একজন প্রবীণ মহিলা, যিনি বলেন—‘আমি তো বাইরেও প্রতিদিন মরছি, অন্তত এখানে মরলে জানব কেন মরছি।’ এই কথাগুলো গেমের নির্মমতা নয়, সমাজের রক্তশূন্য নির্মমতাকেই উল্টেপাল্টে দেয়।
গেমগুলো এবার বেশি মনস্তাত্ত্বিক। একটা গেম, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় তারা জীবনে কাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। সেই আঘাতের প্রতিরূপ দাঁড়িয়ে থাকে তাদের সামনে। সেখানে কেউ নিজের মা, কেউ মৃত সন্তান, কেউ নিজের প্রেমিকাকে দেখে। খেলোয়াড়দের মুখে তখন আর ভয় থাকে না, থাকে আত্মগ্লানির প্রতিচ্ছবি। এই গেম আসলে এক প্রতীকী ট্রায়াল, যেখানে বিচারক আর অভিযুক্ত একসঙ্গেই দাঁড়িয়ে থাকে।
সিজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গি-হুনের বিবর্তন। একসময় যে মানুষটা তার বেঁচে থাকার জন্য অকারণে মিথ্যে বলত, সে এবার জীবন বাজি রেখে অন্যদের রক্ষা করতে চায়। সে বুঝেছে—একজনই খেলাটিকে বদলে দিতে পারে, যদি সে নিয়ম না মানে। এই সিজনে একটা অনবদ্য মুহূর্ত আসে যখন একজন খেলোয়াড় হেরে গিয়ে বলছে—‘ধন্যবাদ, আমাকে মরার একটা সুন্দর কারণ দিলেন।’ এই সংলাপটি মানবিকতা আর মৃত্যু, দুইয়ের মাঝের সরু সীমারেখায় হাঁটে, যা শুধু খেলা থাকে না, এক ধরণের নৈতিকতা হয়ে ওঠে।
সিজনের শেষে এসে গি-হুন একজন গেমারের সঙ্গে দেখা করে, যে বাইরের জগতে খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। তার হাসি স্বাভাবিক, কাপড় পরিচ্ছন্ন, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে এক কৃত্রিম স্পর্শ, যেন প্রতিদিন বাঁচার অভিনয় করে সে। তারা দু’জনে কথা বলে, কিন্তু সেই সংলাপ শীতল, অব্যক্ত। গি-হুন তখনই বুঝে যায়—এই সিস্টেম যদি চলতেই থাকে, তাহলে আরও গেম তৈরি হবে, আরও খেলোয়াড় আসবে, আরও মৃত্যু হবে, এবং মানুষের মূল্য কমতে থাকবে।
পরিচালক হোয়াং ডং হিউক এবার গেমের রঙিন রূপ কমিয়ে, মানুষ ও সমাজের জটিল সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছেন। আলোর ব্যবহার, নিঃশব্দ মুহূর্ত, চোখের এক্সপ্রেশন, একেকটি ফ্রেমে একেকটি গল্প। রক্ত ছাড়াও যে একটা সিরিজ দর্শককে শিহরণে বাঁধতে পারে, তার প্রমাণ এই সিজন।
শেষের দিকে যখন গি-হুন আমেরিকার বিমানে না উঠে ফোন কেটে দেয়, তখন বোঝা যায়—গেমটা সত্যিকারের শুরু এখনই। সে পালাচ্ছে না, সে দাঁড়াতে চায় খেলা ভাঙার খেলায় বদ্ধ পরিকর সে। তার সেই একা দাঁড়িয়ে থাকা, হাওয়ায় উড়তে থাকা লাল রঙের চুল, সমাজের বিরুদ্ধে একজন একা মানুষের চিৎকার। সেই চিৎকার হয়তো কেউ শুনবে না, হয়তো থামিয়ে দেবে, কিন্তু গি-হুন জানে, সে এবার খেলোয়াড় নয়—সে একজন মানুষ, যে জানে কাকে হারাতে চায় আর কাকে বাঁচাতে।
স্কুইড গেম সিজন ২ আমাদের ফের মনে করিয়ে দেয়—গেম শুধুমাত্র টিকে থাকার নয়, গেম নিজেকে প্রশ্ন করার, গেম নিজেরই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার। আর সেই যুদ্ধে জেতা না জেতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রশ্নটা—‘তুমি আদৌ মানুষ হিসেবে বেঁচে আছো তো?’
স্কুইড গেম একবার দেখা যায় না। এটা দেখা হয় ধীর, রক্তচাপ আর মানসিক ঝড় পেরিয়ে, নিজের জীবনকে একবার ফিরে দেখে। এই সিরিজ দেখার পর আপনি আর আগের মতো থাকবেন না—আপনি হয়তো আরও কিছুটা সতর্ক হবেন, কিছুটা মানুষও হতে পারেন আবার কিছুটা ভয়ঙ্করও। এটাই হয়তো স্কুইড গেম-এর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আগের দু’সিজনে মানুষদের টিকে থাকার নৃশংস খেলা চলেছিল। এবার সেই খেলার ভিতরে ঢুকে যায় প্রশ্ন, আর প্রশ্নের ভিতরে গর্জে ওঠে এক জেদ—এবার খেলাটা পাল্টাতে হবে। গি-হুন আর খেলোয়াড় নয়, সে এখন প্রতিশোধ নেবে, এক আদর্শহীন সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা প্রশ্নপত্র। নতুন সিজন শুরু হয় সেই রক্তমাখা চুলগুলো দিয়ে—তার লালচে রঙটা যেন প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এক দগদগে অভিমানের।
পুরো সিরিজের মূল যে জিনিসটা অবিচল থাকে, তা হল এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা। এখানে প্রতিটি চরিত্র যেন নিজেরই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে। যারা খেলতে আসে, তারা শুধুই টাকার জন্য নয়, নিজের অক্ষমতা, পরাজয়, সমাজের প্রতি ক্রোধ বা একরকম আত্মবঞ্চনার ক্ষত নিয়ে আসে। এবার সেই ক্ষতগুলো আরও খোলামেলা। গেমগুলো আগের মতো রঙিন হলেও, তার ভিতরকার ভয় অনেক বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন।
গি-হুনের চোখে প্রতিশোধের আগুন। তবে সে কাউকে খুন করতে আসে না, বরং খেলাটাকে ভিতর থেকে ভাঙতে আসে। সে জানে এই খেলায় প্রতিপক্ষ শুধু যারা গেম খেলে তারাই নয়, যারা দেখে, যারা চালায়, যারা নিয়ম বানায়। তার লড়াই এবার নিয়মের বিরুদ্ধে, নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে। এই সিজনে একটি কথা বারবার ফিরে আসে—‘নিয়মের ভিতর থেকেও নিয়মকে ভাঙা যায়।’
নতুন চরিত্রদের মধ্যে যে দু’তিনজন সামনে আসে, তারা প্রত্যেকেই যেন আগের সিজনের চরিত্রদের ছায়া। কেউ একজন সেই প্রথম সিজনের এলি চরিত্রের মতো অবসন্ন, কেউ সাং-উ’র মতো কৌশলী, কেউ আবার গি-হুনের মতো দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু এই সিজনে চরিত্ররা ভাঙে আরও বেশি। তারা রোবটের মতো খেলে না, তারা প্রশ্ন করে, তারা নিয়ম মানে না, আবার তারাই বিশ্বাসঘাতক।
একটি খেলা যেখানে প্রতিযোগীদের একে-অপরের নাম বলতে হয়, যাদের তারা বিশ্বাস করে। পরদিন সকালে তারা আবিষ্কার করে, যাদেরকে তারা নিজেদের নাম বলেছে, তাদের হাতেই গেমে জীবন-মরণ নির্ভর করছে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অপরাধবোধ, আত্মরক্ষা—সব একসঙ্গে মিশে তৈরি হয় এক মানসিক যন্ত্রণা, যা অনেকের মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। এখানেই স্কুইড গেম সিজন ৩ নিজের মানবিক আলোচনায় পৌঁছে যায় এক অদ্ভুত উচ্চতায়।
এই সিজনে দর্শকরা আর শুধু ভোগবিলাসী ধনকুবের নয়, বরং ‘নতুন শ্রেণির দর্শক’—যারা শুধু দেখছে না, সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়াচ্ছে, রিয়েল টাইম ভোট দিচ্ছে, কে বাঁচবে কে মরবে তা ঠিক করছে। এক জায়গায় এক খেলোয়াড় প্রশ্ন তোলে—‘আমরা কি নিজেদের ইচ্ছেতে খেলছি, নাকি অন্যদের পছন্দ অনুযায়ী বেঁচে থাকার অভিনয় করছি?’ সেটাই হয়তো সবচেয়ে গভীর প্রশ্ন যা সিজন ৩ ছুঁড়ে দেয় এই সমাজে।
পরিচালক হোয়াং ডং হিউক এবার নির্মাণের গাঁথুনি আরও সরল রেখেছেন, কিন্তু তার ভিতরের প্রতীকগুলোর গভীরতা অনেক বেশি। খেলাগুলো শিশুসুলভ হলেও, প্রতিটি গেমের মাধ্যমে উঠে আসে একেকটা দর্শনের প্রতিচ্ছবি—আত্মপরিচয়, শ্রেণিবিভাজন, নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা, ভয়ের রাজনীতি।
গেমের এক পর্যায়ে একটি চরিত্র হঠাৎ বলে—‘আমি চাই হেরে যাই, যাতে অন্তত নিজেকে রক্ষা করতে পারি।’ এই লাইনটা পুরো সিজনের সারমর্ম। এবার জেতা মানে শুধু টাকা নয়, হার মানে শুধু মৃত্যু নয়—বরং নিজের ভেতরের একটি মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখাও একরকম জয়।
সিজন ৩-এ একটা মুহূর্ত আসে যেখানে গি-হুন মুখোমুখি দাঁড়ায় সেই মুখোশধারী লিডারের, এবং মুখোশ খুলতেই দেখা মেলে এমন এক পরিচিত মুখের, যা গা ছমছম করে তোলে। এখানেই সিরিজ প্রমাণ করে দেয়—শত্রু সবসময় বাইরে থাকে না, অনেক সময় সে নিজেরই এক সংস্করণ।
শেষ পর্বে যখন আবার ট্রেন আসে, আবার কেউ প্রশ্ন করে—“আপনি কি খেলতে চান?” তখন গি-হুন কেবল চুপ করে তাকিয়ে থাকে। এবার সে উত্তর দেয় না, এবার তার চোখে স্পষ্ট সেই নীরব বিদ্রোহ—যা চিৎকার করে বলে, গেমটা শেষ হয়নি, কিন্তু আমি এবার খেলতে আসিনি, আমি এসেছি খেলা বন্ধ করতে।
স্কুইড গেম সিজন ৩ আমাদের যে আয়নায় দাঁড় করায়, তাতে নিজেকে দেখার পর হয়তো কেউ আর আগের মতো থাকতে পারবে না। এখানে হারজিতের বাইরেও একটা প্রশ্ন উঠে—আপনি আদৌ খেলবেন তো? না কি নিজের ভেতরের মানুষটাকে বাঁচাতে সবকিছু ছেড়ে দেবেন? এই সিজনটি শিখিয়ে দেয়—খেলার মধ্যে থেকেও কেউ কেউ দর্শক হতে চায় না, কেউ কেউ নিয়ম মেনে খেলতে চায় না, কেউ কেউ জিততে চায় ঠিকই, কিন্তু নিজের ভেতরটাকে মেরে নয়। এটাই স্কুইড গেম সিজন ৩-এর সবচেয়ে বড় জয়—আপনার মনকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, আপনার মানবিকতা আর ভয়কে মুখোমুখি দাঁড় করায়, আর শেষে যখন আলো নিভে যায়, তখনও সেই প্রশ্নটা জ্বলজ্বল করে ওঠে—‘আপনি এখনও মানুষ আছেন তো?’
স্কুইড গেম শেখায়, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে গিয়ে মানুষ কেমনভাবে নিজের নীতিবোধ, সম্পর্ক আর মানবতাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কিন্তু সেই একই লড়াইয়ে কেউ কেউ আবার খুঁজে পায় নিজের ভেতরের সত্যিকারের মানুষটিকে। এই সিরিজ বিশ্বাস করে—ভয়, লোভ, এবং সমাজের চাপ মানুষকে বদলে দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নেওয়ার অধিকারটা মানুষ নিজেই রাখে। টিকে থাকা যতটা জরুরি, তার থেকেও জরুরি—কীভাবে বেঁচে আছো, মানুষ হয়ে নাকি শুধুমাত্র প্লেয়ার হয়ে।