শেষ আপডেট: 18th February 2024 13:48
'কি মিষ্টি, দেখো মিষ্টি, কি মিষ্টি এ সকাল' ... গতকাল ১৭ ই ফ্রেব্রুয়ারী সকাল আর মিষ্টি রইলনা। এই জনপ্রিয় গান মানেই যিনি সেই 'নায়িকা সংবাদ' ছবির নায়িকা অঞ্জনা ভৌমিক প্রয়াত হলেন সকালেই।
ষাটের দশকে যে কজন অভিনেত্রী বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবথেকে খ্যাতি পান যিনি তিনি অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিক। সুচিত্রা সেনের মতো ভুবনভোলানো হাসি অঞ্জনার ছিল না, সুপ্রিয়া দেবীর মতো দুঃসাহসী গ্ল্যামারও ছিলনা তাঁর। সত্যি কথা বলতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়ের দরও ছিল না অঞ্জনার। কিন্তু একটা আলগা সৌন্দর্য আর স্মার্টনেস ছিল যা তাঁকে সেসময়কার ইন্ডাস্ট্রির গুঞ্জন-কন্যা করে তোলে। মাত্র ১৬ টি ছবি করেছেন যার ৭ টি ছবিতেই উত্তমকুমার নায়ক। ৬ টি ছবিতে অঞ্জনার বিপরীতে উত্তমকুমার। উত্তমকুমারের চোখে পড়ে যেতেই অঞ্জনা তড়তড় করে উঠতে থাকেন উপরে। ম্যাসিভ হিট করে উত্তম-অঞ্জনা জুটির 'নায়িকা সংবাদ' ছবিটি। যা অঞ্জনাকে তারকার খ্যাতি এনে দেয়। ষাটের দশকের সব পুরুষের তখন ড্রিমগার্ল অঞ্জনা ভৌমিক। কিন্তু এই 'নায়িকা সংবাদ' ছবি অঞ্জনার করার কথাই ছিল না।
'থানা থেকে আসছি' ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে প্রথম উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেই অঞ্জনা উত্তমকুমারের নজরে পড়ে যান। 'রাজদ্রোহী' ছবির প্রযোজকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন অঞ্জনা। শুধু তাই নয় উত্তমকুমার চেয়েছিলেন অঞ্জনাই তাঁর নায়িকা হোক। গানে গল্পে মন্দ চলেনি ছবি।
সেসময় অগ্রদূতের বিভূতি লাহা 'নায়িকা সংবাদ' ছবি করবেন ঠিক করেন। ফিল্মের মধ্যে ফিল্মের গল্প। চলচ্চিত্রের এক নতুন নায়িকা। বেশ নাম করেছেন। নাম উর্মিতা (অঞ্জনা ভৌমিক)। একদিন রাত্রে নিখোঁজ হলেন চলন্ত ট্রেন থেকে। তিনদিন তিনরাত্রি তাঁর কোন সংবাদ নেই। শহর থেকে দূরে মৌরিয়া নামে এক পাহাড়ি স্টেশনে স্টেশন মাস্টার অলোকের (উত্তমকুমার) সঙ্গে দেখা হল উর্মিতার। অলোক জাননেনা উর্মিতা একজন চিত্রনায়িকা। তাঁদের আলাপ থেকে বিয়ে বিয়ে খেলার গল্প। এক নতুন হাওয়া আনল এই ছবি। আর তেমনই হিট হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান।
কিন্তু অগ্রদূতের পছন্দের নায়িকা চিরকালই ছিলেন সুচিত্রা সেন। সুচিত্রাকে ভেবেই নায়িকা সংবাদ ছবির গান গুলি লেখা হয়েছিল। 'কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো কে যেন ডাকে বারে বারে কেন, বলো কেন।' সন্ধ্যার এই গান সুচিত্রা সেন ছাড়া আর কারও লিপে কেউ ভাবতে পারবে? এ গান সুচিত্রা সেনকে ভেবেই বানানো।
কিন্তু সুচিত্রা সেন বম্বেতে খ্যাতি পাবার পর থেকেই উত্তম-সুচিত্রার ঠান্ডা লড়াই চলছিল। ১৯৬৩ সালে আবার সুচিত্রা সেন মস্কো থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান সাত পাকে বাঁধা ছবির জন্য। উত্তম বিহীন সুচিত্রাও পারেন সেই আত্মবিশ্বাস শ্রীমতী সেনের ভিতর তৈরী হচ্ছিল। উত্তমের সঙ্গে সপ্তপদী ছবি করা নিয়েও শ্রীমতী সেনের বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল। কিন্তু পর্দায় সেটা দেখলে বোঝার উপায় নেই। অঞ্জনা ভৌমিক একবার বলেছিলেন "নায়িকা সংবাদে তো উত্তমদা রমাদিকে বাদ দিয়ে আমায় নিয়েছিল।"
যে ছবি ভাগ্য বদলে দেয় অঞ্জনা ভৌমিকের। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে দুটি গান 'কেন এ হৃদয়' ও 'কী মিষ্টি' সুচিত্রা সেনের জন্যই ভাবা, সেই গানে নিজের সিগনেচার মার্ক রাখা কম কথা ছিল না। সেসময় সন্ধ্যা মানেই সুচিত্রা, সুচিত্রা মানেই সন্ধ্যা, এমন একটা ব্যাপার। সেখানে অঞ্জনা যে ভাবে সন্ধ্যার দুটি গান নিজের আইকনিক গান করে তুলেছিলেন তা করতে দম লাগে। সেটা কিন্তু অঞ্জনা ভৌমিক পেরেছিলেন। সঙ্গে ছিল পর্দায় মহানায়কের উপস্থিতি।
এমনকী ছবিতে ছিল উত্তম-সুচিত্রার মতোই উত্তম-অঞ্জনার আলিঙ্গন দৃশ্য। অঞ্জনা ভৌমিক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন "মনে পড়ছে 'নায়িকা সংবাদ' ছবিটার কথা। লাস্ট সিকোয়েন্সে আমাদের মিলন দৃশ্য রয়েছে। উত্তমবাবু আর আমি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরব। অমন একজন নায়কের কাছে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। উনি নিজেই সেই শটটার আগে বলে দিলেন "তুমি আমাকে আলগা করেই ধরো। আমি ম্যানেজ করে নেব।" কিন্তু ওটা তো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরব এমন সিকোয়েন্স। জাপটে ধরতে হবে তো। আমি কী যে করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। উত্তমবাবু নিজে থেকে আবার বললেন, "বলছি তো অত ভাবার কিছু নেই। তুমি আলগা করেই ধোরো।"
কখনও মেঘ, কখনও শুকসারী, কখনও চৌরঙ্গী তো কখনও রৌদ্রছায়া ছবিতে উত্তমকুমারের নায়িকা ছিলেন অঞ্জনা ভৌমিক। চৌরঙ্গী তো আইকনিক। উত্তমকুমারের সঙ্গে এত গুলো ছবিতে প্রেমের অভিনয় করতে গিয়ে অঞ্জনা কী কখনও উত্তমের প্রেমে পড়েছিলেন। অঞ্জনা বলছেন "ব্যক্তিগতভাবে আমারও মনের মধ্যে কখনও কখনও সংরাগ দলা পাকিয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু সেখানেই সেটাকে চেপে মেরে ফেলেছি। কেননা তখন উত্তমের জীবনে অনেকে রয়েছেন। একাধিক নারী। সবার ভিড়ে হারিয়ে যেতে চাইনি বলে কিছুই বলিনি। কিন্তু অনুভূতিটাকে অস্বীকার করি কী করে?"