বসন্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: 5 May 2025 23:16
প্রখর গ্রীষ্মে তাঁর জন্ম। কিন্তু নাম তাঁর বসন্ত। তিনি বাংলা ছবির সুদর্শন নায়ক বসন্ত চৌধুরী (Basanta Chowdhury)। আজ ৫মে এই লেজেন্ডারি অভিনেতার জন্মদিন। বসন্ত চৌধুরী 'ক্লাস' কী জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, রিল থেকে রিয়েল জীবনে।
শুধু অভিনয় নয়, প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে তাঁর প্রতিটি পোশাক কী হবে সেটাও তিনি নিজে তৈরি করতেন। প্রচন্ড গরমেও চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি কোট-প্যান্ট পরে শ্যুটিং করতে পিছিয়ে যেতেন না । ঘেমে নেয়ে স্নান করে যাচ্ছেন কিন্তু মুখে হাসি লেগে আছে। বেশি ঘাম হলে বলতেন 'এত গরমে ঘামে স্নান করে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি'। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্টুডিও তো তখন ছিল না কিন্তু তখনকার অভিনেতাদের এতটাই কাজের প্রতি একাগ্রতা ছিল।
বসন্ত চৌধুরী জমিদার বা মনীষীদের চরিত্রে যে এত ভালো মানিয়ে যেতেন তার আরেকটি কারণ বোধহয় জমিদার বংশের রক্ত তাঁর শরীরে ছিল। আন্দুলের দত্তচৌধুরী বংশের ছেলে তিনি। কিন্তু কখনও সেই পারিবারিক পরিচয়ের কথা তিনি কোথাও প্রচার করেননি। পদবীতেও শুধুই চৌধুরী। তাঁর পূর্বপুরুষরাই দত্ত পদবী ঝেড়ে ফেলে শুধু চৌধুরী হন এবং তাঁরা নাগপুরে বসবাস শুরু করেন। বসন্তর জন্ম নাগপুরে, ৫ মে ১৯২৮।
মাত্র তেরো বছর বয়সে বসন্ত চৌধুরীর পিতৃবিয়োগ ঘটে। নাগপুরের দীননাথ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হন। কলেজ পাশ করার পর ২২ বছর বয়সে বসন্ত কলকাতায় অভিনয় করতে আসার তাগিদবোধ করলেন। চাকরি নয়, অভিনয়ই করবেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। চলে এলেন কলকাতা। অচেনা শহরে স্ট্রাগলের পর স্ট্রাগল। তবে সিনেমার নায়ক হওয়ার মতো সুদর্শন চেহারা ছিল বলে প্রযোজক পরিচালকদের চোখে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। যে ছবি দিয়ে বসন্ত চৌধুরীর রুপোলি পর্দায় আবির্ভাব তা ছিল ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। তাঁর বিপরীতে ছিলেন নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। ছবির পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। বসন্ত ও অরুন্ধতী, দুজনেরই চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ এই ছবি দিয়ে। দেবদূতসম রূপবান নায়ক যেন পর্দা আলো করে এলেন । সালটা ১৯৫২।
উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে চিরকাল বাঙালি দুভাগে বিভক্ত হয়ে তর্কের আসর জুড়লেও উত্তমকুমারের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী শুরুর দিকে ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব তো অনেক পরে। উত্তমকুমার ‘ফ্লপমাস্টার’ তকমা পেয়ে স্ট্রাগল করছেন যখন, ততদিনে বসন্ত চৌধুরীর আধ্যাত্মিক অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছে জনমানসে।
দেবকীকুমার বসুর 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' ছবিতে নিমাই চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী আর বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় সুচিত্রা সেনের জুটি বিপুল আলোড়ন তোলে বক্সঅফিসে। কিন্তু প্রযোজক পরিচালকদের মাঝে বসন্তকে নিয়ে মাতামাতি ছিল কিছুদিনের জন্য। বসন্তর বিপরীতে সুচিত্রা সেন আর অরুন্ধতী দেবীকে নিয়ে সেভাবে আর ছবি করলেন না কেউ। দেবকী বসু বসন্ত-সুচিত্রাকে নিয়ে 'ভালবাসা' ছবি করলেও সে ছবি ফ্লপ করে।
'রাজা রামমোহন', 'যদুভট্ট' র মতো ছবি ছিল বসন্তর কেরিয়ারে মাইলফলক। যেন ইতিহাসের পাতার রামমোহন হয়েই তিনি রুপোলি পর্দায় উঠে এসেছিলেন। এছাড়াও 'দিবারাত্রির কাব্য',' আঁধারে আলো', 'দীপ জ্বেলে যাই', 'বধূ' একাধিক ছবিতে তাঁর নজরকাড়া অভিনয়ে। পাশাপাশি কিছু বলিউড ছবিতেও কাজ করেন।
চরিত্রগত দিক থেকে তিনি ছিলেন ভীষণ স্বচ্ছ। তাঁর চরিত্রে স্ক্যান্ডেলের দাগ কখনও লাগেনি। জীবনে একটি মাত্র নারীকেই ভালবেসেছিলেন বসন্ত। কিন্তু স্ত্রীর উগ্র আধুনিকতা পছন্দ ছিল না তাঁর। সংসারেও সুখী হননি তিনি।
১৯৫৭ সালে কবি অজিত চক্রবর্তীর ছোট ছেলে যুধাজিৎ চক্রবর্তীর কন্যা অলকাকে ভালবেসে বিয়ে করেন বসন্ত। সেই রেজিস্ট্রি বিয়ে কাউকে না জানিয়ে গোপনে করেছিলেন বসন্ত।
অলকার নামটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। আষাঢ় মাসের জাতিকা তাই গুরুদেব তাঁর নাম দিলেন অলকানন্দা।
অলকা যখন বসন্তর বাগদত্তা তখন তাঁকে ফিল্মে অভিনয়ের জন্য পছন্দ করেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায়ের পরিবারের সঙ্গে অলকার বাবা যুধাজিৎ চক্রবর্তী ও মা লাবণ্যলেখার পরিচয় থাকায় সত্যজিৎ চিনতেন অলকাকে। 'অপরাজিত' ছবিতে অপুর বান্ধবী লীলার চরিত্রে অলকা চক্রবর্তীকে নেন সত্যজিৎ। শ্যুটিংও শুরু হয়। কিন্তু এ খবর বসন্তর কানে পৌঁছয়। বসন্ত সটান চলে যান স্টুডিও ফ্লোরে। সত্যজিতের সঙ্গে বিশাল সংঘাত হয় । বসন্ত বাগদত্তা অলকাকে নিয়ে চলে আসেন। সত্যজিৎ রায় চিরতরে লীলা চরিত্রটি 'অপরাজিত' ছবি থেকেই বাদ দিয়ে দেন। বসন্ত চাননি তাঁর স্ত্রী কখনও ছবির জগতে পা রাখুন । বিয়ের আগেই তাই এমন পদক্ষেপ নেন তিনি। অপমানিত সত্যজিৎ রায় এই কারণে কখনও বসন্তকে তাঁর ছবিতে কাস্ট করেননি।
অলকা ছিলেন বসন্তের থেকে বয়সে অনেকটা ছোট। ছবি করতে না দিলেও ঘরোয়া মেয়ে অলকা ছিলেন না। ইন্টিরিয়র ডিজাইনার হিসেবে দিল্লির 'বঙ্গভবন' সাজিয়েছিলেন অলকা। অলকার খোলামেলা পোশাক থেকে প্রকাশ্যে ধূমপান করার অভ্যাস তীব্র অপছন্দ ছিল রক্ষণশীল বসন্তর। তবে নিজেকে ভীষণ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন অলকা। কিন্তু তাঁদের ঘর ভাঙল। দুই ছোট ছেলে সৃঞ্জয় আর সঞ্জিতকে ছেড়ে বসন্তকে ডিভোর্স দেন অলকা। দুই ছেলেকে একা হাতে বসন্ত চৌধুরীই মানুষ করেছিলেন।
অলকা এরপর এক কর্নেলকে বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসার পাতেন। বসন্ত আর বিয়ে করেননি। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কাছের বন্ধু ছিলেন অলকা চৌধুরী। মাধবী জানাচ্ছেন 'অলকার নেশা করার অভ্যেস আমারও পছন্দের ছিল না। তবে ওঁর সুন্দর সাজগোজ আর নিজেকে মেনন্টেন করার ভক্ত ছিলাম আমি। কেশসজ্জায় করত নানা বাহার। ডিভোর্সের পর আর খবর পাইনি। বহুদিন পর খবর পেলাম অভিনেত্রী স্মিতা সিংহর থেকে। 'মহানগর', 'স্ত্রীর পত্র' ছবিতে আমার সঙ্গে স্মিতাদি করেছিলেন। স্মিতা সিংহ অলকার পিসতুতো দিদি। উনি বললেন অলকা তো আবার বিয়ে করেছে কর্নেলকে। মন যাকে চায়, ভগবান তাকে মিলিয়ে দেয়। হঠাৎ একদিন অলকার সঙ্গে দেখা। দেখে চমকে গেলাম! সেই পরিপাটি সাজগোজ আর নেই। আলুথালু বেশে অলকা সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। মুখ ভরা শূন্যতা। নেশা ছাড়তে না পারলেও সেই ফিটফাট অলকাকে আর পাইনি।'
পরবর্তীকালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অলকা চৌধুরীর মৃত্যু হয়। বসন্ত চৌধুরী 'একা' জীবন কাটিয়েছিলেন শেষ দিন অবধি। আর কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াননি পর্দার রামমোহন। সুচিত্রা সেন অন্তরাল জীবনেও যে নায়কের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেছিলেন তিনি কিন্তু উত্তম নন, বসন্ত চৌধুরী। দু'জনে ঘুরতেও বেরতেন কলকাতার আনাচে-কানাচে। পর্দার রাধার সঙ্গের ছিল বসন্তর শ্রদ্ধার সম্পর্ক।
নিজের জীবনের শোক, বিরহ সব কিছু হাসির আড়ালে ঢাকতেন বসন্ত। কখনও নিজের জীবনের দুর্বিষহ বেদনা পরের কাছে বলেননি। শোক ভুলতে নিজের প্যাশনে মন দেন। দেখার মতো ছিল তাঁর শালের কালেকশন থেকে গণেশ মূর্তির সংগ্রহ । যাত্রা করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী টাকার জন্য নয়, গ্রাম বাংলার কুটির শিল্প সংগ্রহ করার জন্য।
পরবর্তী যুগের দেবশ্রী,শতাব্দী, মুনমুন,রূপা,সংঘমিত্রাদের সঙ্গেও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। কন্দর্পকান্তি রূপের জন্য তাঁর প্রেমে সবাই হাবুডুবু খেতে পারতেন। কিন্তু শ্রদ্ধার আসন থেকে তিনি টলেননি। গৌতম ঘোষ থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরবর্তী যুগের পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন বসন্ত চৌধুরী।
শেষ জীবনে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কর্কট রোগেও মুখের হাসি ম্লান হয়নি। কলকাতার শেরিফ পদেও ছিলেন তিনি। ২০০০ সালের ২০ জুন প্রয়াত হন লেজেন্ডারি অভিনেতা। কর্কট আক্রান্ত মরদেহ যেন সামনে না আনা হয় এমন নির্দেশ ছিল তাঁর। রাজার মতোই রাজাধিরাজের মহাপ্রস্থান হল লোকচক্ষুর আড়ালেই। শুধু চিরবসন্তের ফাগটুকু তিনি রেখে গেলেন চলচ্চিত্র দুনিয়ায়।