শেষ আপডেট: 23rd April 2024 12:55
বালিকাটি জন্ম থেকেই ছিল পরিচয়হীন। তার জন্ম পরিচয় সে সঠিক ভাবে জানত না। শুরুর জীবনে সে সয়েছে সমাজের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অপমান। অথচ সেই মেয়েই একদিন হয়ে উঠেছে সমাজের শীর্ষস্থানীয়াদের অন্যতমা। কলকাতা সহ বিদেশের নামীদামি মানুষজন তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে কৃতার্থ হয়েছেন। এ কোনও গল্পকথা নয়। রূপকথাকেই বাস্তব করে তুলেছিল মেয়েটি। কারণ শত অভাব অনটন অপমানের মাঝেও তার ছিল দুটো স্বপ্ন দেখার চোখ। সে মনেপ্রাণে বলত "পৃথিবীতে বাঁচলে বাঁচার মতো বাঁচব, সুখ পাবার অধিকার সবার আছে।" পদবীবিহীন মেয়েটি নিজের নামের সাথে দেবী উপাধি জুড়তে সক্ষম হয়েছিল। সত্যিকারের দেবী। সমাজের দেবী। জনতার দেবী। মেয়েটি চলচ্চিত্রের ভগবতী, কানন দেবী।
জন্ম ১৯১৬ সালের ২২ শে এপ্রিল। মতভেদে কাননের সত্যিকারের জন্মদিন ৮ই জ্যেষ্ঠ। তখন আর অবহেলার কন্যা সন্তানের জন্মদিনের কে হিসেব রাখত। তাও আবার যে মেয়ের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হল অগ্নিপরীক্ষা। পিতৃপরিচয়হীন হয়েই তাঁকে আজীবন থাকতে হয়েছে। কাননের জন্ম পরিচয়ে জড়িয়ে ছিল নিষিদ্ধপল্লীর ইতিহাস, যা তাঁকে সর্বসময় কুন্ঠিত করে রাখত। কিন্তু ঐ কুন্ঠাই ওঁকে শিখরে গিয়েও মাটিতে পা রেখে চলতে শিখিয়েছিল। কাননের মা ছিলেন নিষিদ্ধপল্লীর পতিতা। এমনও শোনা যায়, অন্য এক পতিতা অবৈধ সন্তান কাননকে ফেলে রেখে চলে যান। ঐ মহিলার কাছে যাকে কানন মা বলে জানতেন। পিতৃপরিচয় বলে কিছুই ছিল না। কানন তাই নিজের পিতামাতার পরিচয় এড়িয়ে বলতেন "কে বাবা কে মা এই ভেবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে লাভ কী? কানন নামটুকুই সব। আমি 'মানুষ' সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট।"
সুন্দর মুখ আর নিষ্ঠার জোরে স্টুডিও পাড়ায় সুযোগ পেতে কাননের বেশি সময় লাগেনি। বিখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে পড়েন বালিকা কানন। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ম্যাডান থিয়েটারের ব্যানারে কাননের প্রথম ছবি 'জয়দেব'। রাধার ভূমিকায় শিল্পী জীবন শুরু হল। তারপর এল সবাক ছবির যুগ। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জোর বরাত'। কাননবালা নামটা ধীরেধীরে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। রূপবাণী' সিনেমা হলে এক যুবক মোহগ্রস্ত হয়ে কাননের 'মানময়ী গার্লস স্কুল' ছবির রোমান্টিক দৃশ্যের সময় পর্দার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। নগরনটী বাসবদত্তার ভূমিকায় প্রথমে অভিনয় করতে চাননি কানন। শেষ অবধি তাঁকে সেই রোল করতে হয়। তাঁর ছবি প্রকাশ পেতেই সমাজে নিন্দার ঝড় ওঠে। অথচ সেই যুগে কতটা সাহসী অভিনয় করেছিলেন কানন।
প্রমথেশ বড়ুয়া 'দেবদাস' ছবিতে পার্বতীর ভূমিকায় কাননকে চেয়েছিলেন। কিন্তু কানন তখন রাধা ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে স্বপ্নের চরিত্র হারান। তবে আবার সুযোগ হল বড়ুয়া সাহেবের ছবি 'মুক্তি' তে নায়িকা হওযার। প্রমথেশ বড়ুয়ার নায়িকা হিসেবে 'মুক্তি'তে কাজ করেই কাননবালা পেলেন তারকা মর্যাদা। কাননবালা নায়িকা-গায়িকা দুই রূপেই শীর্ষস্থানীয়া হয়ে উঠলেন।
ব্রাহ্মসমাজের প্রথম সারির নেতা এবং সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র ছিলেন অশোক মৈত্র। অশোক মৈত্র পর্দায় কাননের প্রেমে পাগল হয়ে কাননের বাড়ির দরজায় গিয়ে নেশাতুর অবস্থায় পড়েছিলেন। কানন দরজা খুলে দেখেন পায়ের কাছে পড়ে রাজপুত্র। কানন ফেরাননি অশোককে। শুরু হয় প্রেমের তুফান মেল। কিন্তু শ্বশুর হেরম্বচন্দ্র মৈত্র সিনেমার অভিনেত্রীকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেননি। কাননের জন্ম পরিচয়েও ছিল পতিতাপল্লির দাগ। তাই হেরম্বচন্দ্রর প্রয়াণের পর কানন-অশোকের বিয়ে হয় ১৯৪০ ডিসেম্বরে। কিন্তু সব মেয়ের মতোই সেই ছোট্ট বেলার অভাবের দিন থেকে কানন নিজের ঘরের নিজের স্বামী সন্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কাননকে অন্তজ শ্রেণী থেকে উচ্চ শ্রেণীতে তুলে আনে মৈত্র পরিবারের বউয়ের পরিচয়। সমাজে কানন পান সম্মানের আসন। বা কিন্তু জীবন লিখেছিল অন্য গল্প। শাশুড়ি ভালবাসতেন কাননকে। কিন্তু অশোক মৈত্র চাননি বংশপরিচয়হীনা কাননের গর্ভে তাঁর সন্তান আসুক। কাননকে সিনেমা জগত ছেড়ে দিতে তিন বলেন। পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করেননি কানন। শেষমেষ ভেঙে যায় বিয়ে।
উভয়ের সম্মতিতে কানন অশোকের ডিভোর্স হয়ে যায়। আর কোনদিনই পরস্পরের মুখ দেখেননি তাঁরা। তবে একবার ঘটেছিল ব্যতিক্রম একবার দাঁতের ডাক্তারখানায় দেখা হয়েছিল ওঁদের। কানন দেবী কিন্তু সবসময় স্বীকার করেছেন অশোক মৈত্রর জন্যই কানন সমাজে প্রথম সম্মানের স্থান পেয়েছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্র জগতকে বিদায় জানানোর প্রস্তাব কানন মেনে নেননি। কাননের সন্তান হলেও সেই নিয়েও উঠত নানা প্রশ্ন। অশোক মৈত্র আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন।
ডিভোর্স হয়ে গেলেও আগের বিয়ের কাছের সম্পর্ক গুলো কানন ভুলে যাননি। শাশুড়ি কুসুমকুমারী মৈত্রর সঙ্গে কাননের মা-মেয়ের সম্পর্কের সুতোটা ছেঁড়েনি। মৈত্র পরিবারের আত্মীয় বন্ধু ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, রানি মহলানবীশ, অন্নপূর্ণা দাস বা ধীরেন দাস। এঁদের সঙ্গেও কাননের সম্পর্ক ছেদ হয়নি। ঐ অত আগের সময়ে দাঁড়িয়েও এঁরা ছিলেন কতটা মুক্তমনা। রানি মহলানবীশ কাননকে ইংরাজি পড়াতেন তখনও।
শুধু কী তাই? প্রাক্তন শাশুড়ি মা কুসুমকুমারী মৈত্র যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন সেই খবর পেয়ে গিরিডি ছুটে যান কানন। কে প্রাক্তন কে বর্তমান কাননের কাছে তা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াইনি। বিয়ে তো স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নয় পরিবারের সঙ্গেও। প্রাক্তন শাশুড়ির সেবা করতে কানন শ্যুটিংয়ের সব ডেট ক্যান্সেল করে এক মাসের জন্য গিরিডি চলে যান। পুত্র নয় পুত্রবধূই হয়ে ওঠে মায়ের আসল সন্তান। তাও যে পুত্রবধূ কিনা আইনত তাঁদের একেবারেই কেউ না। কুসুমকুমারীর শেষ দিনগুলি গিরিডিতে কাননের সঙ্গেই কেটেছিল। দুজনে মা মেয়ে হয়ে যান। কাননের জীবনের সে এক অমূল্য প্রাপ্তি। মধ্যগগনে থাকা কাননবালা, যাঁর কথায় প্রযোজকরা ওঠেন বসেন তিনি কাজ গ্ল্যামার লাইমলাইট ছেড়ে চলে আসেন প্রাক্তন শাশুড়ির জীবনের শেষ সায়াহ্নে সেবা করতে। কত বড় ত্যাগ। কত বড় শিক্ষা। এ ঘটনাই বোধহয় 'পারমিতার একদিন' ছবিতে ধার করেছিলেন অপর্ণা সেন। সনকা-পারমিতার সম্পর্ক সে কথাই মনে করায়। তবু কানন এ ভাবনা করে দেখান কত আগে।
পরবর্তী কালে কানন রাজ্যপালের এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্য কে বিয়ে করেন। হরিদাসকে পরিচালক বানিয়ে ছিলেন কানন। ছবির শ্যুটিং করতে করতে টেকনিশিয়ানরা কাননের হাতে ছোট মাছ খাবার আবদার করেছেন। কানন স্টুডিওতেই মাছ কাটতে বসে যেতেন। এ তো বায়োস্কোপের সাক্ষাত মা ভগবতী। দাদাসাহেব ফালকে সম্মানে ভূষিতা কানন দেবী তাঁর দুই স্বামীর আগেই প্রয়াত হন ১৭ ই জুলাই ১৯৯২। অশোক মৈত্র প্রাক্তন স্ত্রীর প্রস্থানে চোখের জল ফেলেছিলেন।
ছবি ও তথ্য সহায়তায়: ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ