Latest News

খালি গায়ে অভিনয় করেও যেতে হয়নি জিমে, নিখাদ বাঙালিয়ানায় বাজিমাত করেছিলেন তুলসী

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শুভদীপ চক্রবর্তী

জিমচর্চিত শরীর এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। টিভি সিরিয়াল বা কমার্শিয়াল সিনেমা—সবেতেই জিম করা শরীরের রমরমা। অভিনয় পরের কথা, আগে যেন সুচর্চিত শারীরিক গঠন জরুরি, তা চরিত্রের সঙ্গে মানাক বা না মানাক।

কিন্তু ভাবুন, আমাদের প্রিয় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty)!

একেবারে উদোম গায়ে কত চরিত্রই না অভিনয় করেছেন! কোনওখানেই শরীর প্রদর্শনটা মূল বিষয় হয়ে ওঠেনি। অথচ কোনও অর্থেই তিনি ‘সুপুরুষ’ ছিলেন না। বেশ নেয়াপাতি ভুঁড়ি আর সাদামাঠা পিঠ বাগিয়েই দাপিয়ে গিয়েছেন অভিনয়ের আঙিনায়। এক আদরমাখা মুখ, পায়েস খাওয়া নির্মল হাসি আর নিখাদ বাঙালিয়ানা তাঁর ইউএসপি। ছবিতে তিনি থাকলে, নায়ক নায়িকার চেয়েও আরও বেশি করে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতেন তিনি। অথচ অভিনয়ের ঈশ্বর হয়েও যিনি কখনও প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পাননি ইন্ডাস্ট্রিতে। আজ গোটা রাজ্যে একটা মূর্তি পর্যন্ত নেই তাঁর। অথচ পর্দায় তিনি এলে, আজও সময় ভুলে চোখ আটকে যায় দর্শকদের।

উত্তমকুমারকেও ছাপিয়ে গেছিলেন তুলসী (Tulsi Chakraborty)

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির পোস্টারের কথা মনে পড়ে? মূল আকর্ষণ ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty)। উত্তমকুমার সেখানে ব্রাত্য। এ কথা কেরিয়ারের শুরুর দিকের গল্প বলতে গিয়ে নিজেই লিখে গেছেন মহানায়ক উত্তমকুমার। তাঁর কথায় “সাড়ে চুয়াত্তর ছবির বিজ্ঞাপনে প্রথম যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল, তা ছিল এই রকম– “প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি”। সেসময়কার প্রথম শ্রেণির চিত্রগৃহে বাংলা ছবি মুক্তি পাওয়া যেন ছিল একটা বিরাট কৃতিত্ব অর্জনের পরিচয় বহন করা। আর দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল, তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) অভিনীত একটি ছবি। নায়ক হিসেবে আমার কোন হদিসই রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। আমি নগণ্য, আমি সামান্য।”

সাড়ে চুয়াত্তরকে সত্যিই তুলসী-মলিনা জুটির জন্যই বেশি মনে রেখেছে বাঙালি দর্শক। যদিও সেখানে উত্তম-সুচিত্রা নবীন বসন্তের হাওয়া এনেছিলেন, তবুও এ ছবির আসল স্টার, আসল প্রাণ তুলসী-মলিনাই। উত্তম ও সুচিত্রা দু’জনেই পরে বলেছেন, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর আসল নায়ক নায়িকা তুলসী চক্রবর্তী-মলিনা দেবী।

বউ মানে কী? আজও মনে রেখেছে দর্শক

তৎকালীন ‘রুপমঞ্চ পত্রিকা’ তে সাড়ে চুয়াত্তর ছবি রিভিউয়ে  লেখা হয়, “তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty), ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনা দেবী বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সুচিত্রা সেন যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করেছেন।”

কিন্তু রামপ্রীতি উত্তম কুমার? তৎকালীন পত্রিকা তাঁকে আর গ্রাহ্যই করেনি অভিনয় সমালোচনায়। কিন্তু ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়েই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু তো বটেই। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) একটা মেসের মালিক ছিলেন। প্রতি হপ্তায় শনি-রোববার শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসতেন বৌ-বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে। আজকাল যাকে বলে ফ্যামিলি টাইম।

সেখানেও তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty) মুখে লা জবাব ডায়লগ। মলিনা দেবীকে বললেন, “বউ মানে কী? বউ মানে গাছতলা, মানুষ তেতেপুড়ে এসে গাছতলায় বসে। তা তুমি হচ্ছো আমার খেজুর গাছ। কাঁটা আছে, ছায়া নেই।”

মলিনা দেবীর প্রত্যুত্তর “তা বেশ তো। ছায়া আছে এমন গাছতলায় গিয়ে বসলেই তো পারো!”

দর্শকদের নিশ্চয়ই আর একটা দৃশ্যের কথা মনে আছে। স্বামীকে ধরে রাখতে মলিনা দেবী প্রতিবেশিনীর কথা শুনে রুজ-পাউডার-লিপিস্টিক মেখে লুচি-মিষ্টি-মন্ডা সাজিয়ে তুলসী চক্রবর্তীকে সোহাগ করছেন। এ দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) তাঁর চাহনি ও শরীরী ভাষায় একইসঙ্গে যে বিস্ময়, লজ্জা, পুলকের ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা আর কোনও কমেডিয়ান পারলেন কই!

চার্লি চ্যাপলিন বেঁচে থাকলে…

চিন্ময় রায়, অনুপ কুমার, রবি ঘোষ—সকলেই গুরু মানতেন তুলসী বাবুকে। তাঁরা অনেকের অভিনয় নকল করলেও কখনও তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty) অভিনয় নকল করতে পারেননি। চিন্ময় রায় বলেছিলেন “চার্লি চ্যাপলিন যদি বেঁচে থাকতেন তবে এ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখে বলতেন এমন অভিনয় করলে আমি আরও নাম করতে পারব।”

কেন এমন বঞ্চনা

এ হেন তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty) ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল কেন? কেন তাঁর মতো অভিনেতার যথাযোগ্য চরিত্র আর রচনা হল না বাংলা ছবিতে বড় রোলে?

একমাত্র ব্যতিক্রম ‘পরশ পাথর’। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty) চলচ্চিত্রপঞ্জিতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে ‘পরশ পাথর’-এর ব্যবধানে ওঁকে মুখ্য চরিত্রে রেখে আর ছবি নেই।

আমরা অনেক পড়েছি তাঁর অভাব যন্ত্রণার গল্প। কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করিনি। জানতে গেলে জানতে হবে তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty)শুরুর দিনগুলোর গল্প।

অনেক অভিনেতাই অনেক বই পড়ে শিক্ষিত হয়ে আসেন চলচ্চিত্র জগতে। অনেকে চলচ্চিত্রের ডিগ্রি নিয়ে আসেন। কেউ কেউ আসেন রূপের জোরে, কেউ আবার আসেন টাকার জোরে। এর কোনও কিছুই না থেকেও তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের চেষ্টা আর কাজের প্রতি ভালোবাসায় লেজেন্ড হওয়া যায়। অভিনয়ের দক্ষতায় দাগ কাটা যায় দর্শকমনে।

ছোটবেলা থেকেই লড়াই

কেমন ছিল তাঁর শুরুর দিনগুলো? শতবর্ষ পেরিয়ে গেছেন তুলসীবাবু (Tulsi Chakraborty)। কিন্তু শতবর্ষে তাঁকে ইন্ডাস্ট্রি কোনও শ্রদ্ধার্ঘ্যই দেয়নি। অথচ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তুলসী বাবু নিজেই একজন ‘পরশপাথর’।

তুলসী চক্রবর্তী গোয়ারি নামক এক ছোট গ্রামে ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী ভারতীয় রেলের কর্মী ছিলেন। মা নিস্তারিণী দেবী। বাল্যকালে অবিভক্ত বাংলায় নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাঁর বাবাকে। ছোটবেলায় কলকাতার জোড়াসাঁকোতে তাঁর কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে কিছুকাল থাকতে হয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীকে। অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগ, তাই পড়াশোনা বেশি দূর এগোতে পারেননি। বহুবিধ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন অর্থের জন্য।

সার্কাস থেকে নাটকে তুলসী (Tulsi Chakraborty) 

বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে বোস সার্কাসের সঙ্গে পালিয়ে গেছিলেন রেঙ্গুনে। খেলাও দেখালেন সার্কাসে। কখনও বা জোকার সেজে নেমে পড়তেন সার্কাসে। কিন্তু সেখানেও মন টিকল না। ফিরে এলেন কলকাতা। ছাপাখানার কম্পোজিটার কি মদের দোকানে কাজ। তাঁর জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তী দুর্দান্ত হারমোনিয়াম বাদক ছিলেন। সেই সূত্রেই স্টার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তুলসী তখন রোজ জ্যাঠার টিফিন পৌঁছে দিতে যেতেন স্টারে। সেখানেই নাটকের প্রেমে পড়ে গেলেন। নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁর।

শেষমেশ নিজেই নেমে পড়লেন নাটক করবেন বলে। অভিনয় থেকে গান এমনকি পুরুষ হয়ে নাচও রপ্ত করলেন। তাঁর প্রথম নাট্যগুরু অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কত পেশা ঘুরে, ভাগ্য তাঁকে নিয়ে এল নাট্যমঞ্চে। যেন পূণ্যভূমির সন্ধান পেলেন তুলসী। তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম নাটক ‘দুর্গেশনন্দিনী’। এর পরে নাটকে তাঁর নাম হতে থাকল, নাটকসূত্রেই পেলেন ফিল্মের অফার।

প্রথম জীবনে কমেডি নয়, সিরিয়াস চরিত্রেই মাতিয়েছিলেন আসর

প্রথম ছবি ‘পুনর্জন্ম’ (১৯৩২)। তবে তাঁকে সাফল্য পরিচিতি এনে দিল ‘শচীদুলাল’ ছবিটি। এই ছবিতে তিনি নিমাই গৌরাঙ্গর গুরু অদ্বৈতাচার্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

সবাই ভাবেন তুলসী বাবু মানেই কমেডিয়ান। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম দিকের ছবিগুলোতে কমেডিয়ান রোল ছিলনা। সিরিয়াস চরিত্রেই অভিনয় করতেন তিনি। দর্পচূর্ণ, জয়দেব, শ্রীগৌরাঙ্গ, মানদন্ড, মেজদিদি, বামুনের মেয়ে, শেষবেশ, কবি, নবীন যাত্রা, পণ্ডিতমশাই, রাজনটী বসন্তসেনা—আরও কত। বাংলার পাশাপাশি প্রায় পঁচিশটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। এসব ছবির বেশিরভাগেরই প্রিন্ট নেই।

সফল গীতিকারও ছিলেন তুলসী (Tulsi Chakraborty)

তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) ছিলেন একজন গীতিকারও। বহু ছবির গান মুখেমুখে রচনা করে গেয়ে দিতেন। গানের গলাও ছিল সুমধুর। তাই তাঁকে বলা হত জন্মকবি। অসম্ভব ভালো টপ্পা কীর্তন গাইতেন। অনেক সিনেমায় কবিয়ালের ভূমিকায়, তরজার দৃশ্যে দুরন্ত অভিনয় করেছেন।

আত্মভোলা মানুষ, সুযোগ নিল সবাই

এ হেন তুলসী চক্রবর্তীকে বড় ছবি জুড়ে রোল দেওয়া হল শুধু ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ। এর পরে আবার সেই একই অবস্থা। ছোট রোলে দেখা যেতে লাগল তুলসী চক্রবর্তীকে (Tulsi Chakraborty)।

শুধু প্রযোজক-পরিচালকদের দোষ দিলে অবশ্য হবে না। তুলসী চক্রবর্তী সাড়ে চুয়াত্তরে বিশাল সাফল্য পাওয়ার পরেও নিজে ছবি চয়নে সচেতন হননি। না বাড়িয়েছেন তাঁর পারিশ্রমিক, না বাড়িয়েছেন স্বভাবের গাম্ভীর্য। আরও একটা ব্যাপার হল, তিনি কোনও দিন কোনও ফিল্ম কোম্পানিকে ফেরাতেন না। যা অফার আসত সেটাই নিয়ে নেতেন। এমনকি কেউ তাঁর পারিশ্রমিক কম দিলেও, সেটা নিয়েই চলে আসতেন। না প্রতিবাদ, না ছবির নির্বাচন, না পারিশ্রমিক বৃদ্ধি।

এর মূল কারণ দারিদ্র্য। অভাবের আশঙ্কায় সব ছবি সাইন করতেন তিনি। যার ফল হল অত্যন্ত নির্মম। ভাল কাজ সরে যেতে লাগল। বারবার তাঁকে চাকর-বাকরের রোলে ভাবা হতে থাকল। একই ধরনের লঘু চরিত্রে তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) বারবার কাস্ট হতে থাকলেন। অথচ শোনা যায়, উনি কোনও দিন সাহস করে বলেননি, এই রোল করব না।

অথচ বাংলা-হিন্দির বেশিরবাগ ছবিতে কমেডিয়ান মানে তো ভাঁড়। ফলে আমোদ আনতেই যেন তাঁকে ছোট রোলে জোর করে ঢোকানো হত জোকার হিসেবে। অথচ তুলসী চক্রবর্তী যে চরিত্রই পেয়েছেন, যত ছোটই হোক, নিজের জাত বুঝিয়ে দিয়েছেন বারবার।

আরও একটা ব্যাপার হল, উনি মাটিতে পা দিয়ে চলেছেন চিরকাল। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে বাড়ি ফিরেছেন। কোনও স্টারডমের ছটা লাগতে দেননি গায়ে। এমন ক’জন পারেন। অথচ এর পাশাপাশিই তিনি থেকে গিয়েছেন নিঁখুত চলচ্চিত্রের ভগীরথ হয়ে।

ধারালো দু’চোখ দুটোই সম্পদ ছিল তুলসীর (Tulsi Chakraborty)

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ওঁর সম্পর্কে বলেছেন “কেউ যদি দেখাতে পারেন অমুক ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী খারাপ অভিনয় করেছেন, তাহলে আমি লক্ষ টাকার বাজি হেরে যাবো। নাটক এবং চলচ্চিত্র দু’ক্ষেত্রেই কী সাবলীল স্বাভাবিক অভিনয়! কখন অভিনয় কেমন করতে হবে, সে মাপটাও যে কখন বদলাচ্ছেন, কেউ ধরতেই পারত না। কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই খুব উঁচু দরের সহজাত অভিনয়-ক্ষমতার মালিক ছিলেন তিনি।”

আসলে তুলসীবাবু বহু মানুষ দেখতেন। পতে চলতে ফিরতে, বহু পেশার খাতিরে, বহু মানুষ দেখেছেন তিনি। তাই যে কোনও চরিত্র করতে গেলে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা মানুষের ছাঁচেই সেই ফিল্মের চরিত্রটা গড়ে নিতেন। এমন অবজারভেশন-ক্ষমতা ক’জনের আছে?

যদি সত্যজিৎ রায় ওঁকে নিয়ে ‘পরশপাথর’ না বানাতেন, তুলসী চক্রবর্তীর সঠিক মূল্যায়নই হতো না। তুলসী বাবুর অপূর্ব উজ্জ্বল একজোড়া চোখ ছিল। যে চোখ জুড়ে ‘পরশপাথর’-এর পোস্টার করেন সত্যজিৎ রায়। চোখের ভাষাকে হাতিয়ার করে এমন একটি ছবির কি বিশ্বমানের চলচ্চিত্রায়ণ!

সে দিন তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) কেঁদে ফেলেছিলেন

আবার ‘পথের পাঁচালী’ র পণ্ডিত মশাই। পাঠশালা আর মুদির দোকানের মিলমিশ। পণ্ডিতমশাই তুলসীবাবুর (Tulsi Chakraborty) একটা ছড়ি ছিল, যে ছড়ি দিয়ে ছাত্র পেটানো শুধু নয়, নিজের পিঠ চুলকানো, মশা-মাছি তাড়ানো, বা নিজের পিঠের ঘাম মোছা—সবই চলত। ওই ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখেই সত্যজিৎ ‘পরশ পাথর’-এর মুখ্য চরিত্রে নির্বাচিত করেন তুলসীবাবুকে। সত্যজিৎ রায় নিজে তুলসী চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে অফার দেন ‘পরশপাথর’-এর জন্য। সে দিন তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) কেঁদে ফেলেছিলেন, যে এত বড় পরিচালক তাঁর বাড়িতে এসেছেন!

পরশপাথরের শ্যুটিংর সময় সত্যজিৎ রায় তাঁকে গাড়িতে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। হাওড়া থেকে টালিগঞ্জ। কিন্তু তিনি বলেন “না রে বাবা আমার ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসই ভালো। গাড়িতে চেপে এলে বাকি প্রোডিউসাররা ভাববে আমি বেশি টাকা চাইব। ওরা আর কাজে ডাকবে না।”

পরশপাথর শেষ হওয়ার পরে সত্যজিৎ রায় তাঁকে বলেছিলেন “এত কম টাকায় রাজি হলেন কেন, আপনি তো এ ছবির নায়ক?” উত্তরে তুলসী বাবু বলেছিলেন “আমি যদি এত হাজার টাকা পাই তবে পরে আর আমায় কেউ নেবে না। সবাই বলবে, তুলসী রেট বাড়িয়ে দিয়েছে।”

এ কথা শোনার পরে সত্যজিৎ রায় প্রোডাকশান কন্ট্রোলের লোকদের বলে দেন, তুলসীবাবুর রেট একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

হলিউডে জন্মালে অস্কার পেতেন

পরশপাথর দেখার পরে সবাই বুঝেছিল শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীবিখ্যাত কমেডিয়ানদের তুলসী বাবু হারিয়ে দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন “তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা এ পোড়া দেশে না জন্মে হলিউডে জন্মালে অস্কার পেতেন।”

উত্তম-সুচিত্রা জুটির সাফল্যেও অনেকাংশে অবদান আছে তুলসী চক্রবর্তীর। ‘একটি জীবন’ কি ‘চাওয়া পাওয়া’র মতো অজস্র ছবিতে ছোট রোলেও কী তুখোড় অভিনয় করে গেছেন। ছবির নায়ক নায়িকা উত্তম-সুচিত্রা কি উত্তম-সুপ্রিয়া কি উত্তম-সাবিত্রী, কিন্তু তুলসীবাবু যেই পর্দায় এসেছেন, দর্শকদের হাসিভরা মুখে ভরিয়ে দিয়ে গেছেন।

রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গেও জমিয়ে দিয়েছিলেন

তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে শুধু মলিনা দেবী নয় রাজলক্ষ্মী দেবীর জুটিও খুব হিট ছিল। ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবি। জহর রায় আর বিশ্বজিৎ নায়ক। কিন্তু একটা দৃশ্যেই মাত করে দেন তুলসী-রাজলক্ষ্মী। সেখানে ৩০ বছর সংসার করার পরে ডিভোর্স করতে উকিলের কাছে ছুটে আসেন তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty) ও রাজলক্ষী দেবী।

ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই…

সে সিনেমায় আটখানা বাড়ি ছিল, আরও চারখানা বানিয়েছেন তুলসী। আট মেয়ের বিয়েতে দশ দশ করে আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন, তবু রাজলক্ষ্মীর মন পান না। তাই বিবাহ-বিচ্ছেদ চাই। তেরো বার তুলসীর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন রাজলক্ষ্মী। যদিও তুলসী বলেন ন’টি সন্তান তাঁর। রাত দুপুরে মদ গিলে মুখে গন্ধ নিয়ে বাড়ি ফেরে তুলসী, ‘ধিঙ্গি’ মেয়েদের নিয়ে হুল্লোড় করেন, তাই তুলসীর অমন টাকার মুখে ঝাঁটা মারেন রাজলক্ষ্মী।

এই একটা দৃশ্য দেখতেই এ ছবি দর্শকরা আজও দেখেন। দু’জনের কী দাপট!

নিঃসন্তান দাম্পত্য জীবনে শুধুই কষ্ট

আদতে শূন্য কোল ছিল চক্রবর্তী দম্পতির। নিঃসন্তান হওয়ায় তুলসী বাবু উত্তমকুমার, তরুণকুমার, অনুপকুমারদের ছেলে বলে ডাকতেন। সৌমিত্রকে বলতেন সৌমিত্তির।

উত্তমকুমার বলতেন, ’‘তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোন দিনই পারব না। ওঁর মতো ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। তুলসী চক্রবর্তীকে (Tulsi Chakraborty) প্রণাম জানানোর একটাই পথ আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুণ ভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ শোধ তো করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।’’

সুচিত্রা সেনকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করতেন আপনার প্রিয় অভিনেতা কে? মিসেস সেন বলতেন ‘তুলসী চক্রবর্তী’ (Tulsi Chakraborty)।

তুলসীবাবু (Tulsi Chakraborty) সংসার পাতেন স্ত্রী ঊষারানি চক্রবর্তীর সঙ্গে। মধ্য হাওড়ার দু’নম্বর কৈলাস বসু থার্ড লেনের এক সংকীর্ণ গলির দু’কামরার দোতলা বাড়ি কেনেন ছ’হাজার টাকায়। ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটি প্রাচীন পালঙ্ক, একটি কাঠের আলমারি, গোটাকয়েক টুল আর একটা ইজি-চেয়ার।

শেষজীবনে চরম অভাব

কিন্তু প্রচণ্ড দারিদ্র্য থাকা সত্বেও নিজের বাড়িটি দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। স্ত্রীর ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন নিঃসন্তান তুলসী (Tulsi Chakraborty)। কিন্তু নিজের মহানুভবতা গুণটি স্ত্রীর জীবনে দুঃখ ডেকে আনল।

আরও পড়ুন: স্যার সত্যেন বোসের ছাত্র ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনিই প্রথম পালন করেন মাস্টারমশাইয়ের জন্মদিন

শেষ জীবনে শরীর ভেঙে গেছিল তাঁর। অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরে সেরেও ওঠেন। সেরে উঠে বাজারে গিয়ে এক দিন কিনে আনলেন গলদাচিংড়ি, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি। রাতে যত্ন করে রাঁধলেন তাঁর স্ত্রী। খেয়ে শুলেন তিনি। ভোররাত থেকে শুরু হল ভেদবমি। ভোরে ডাক্তার আসতে না আসতেই সব শেষ। ১৯৬১-র ১১ই ডিসেম্বর তুলসী চক্রবর্তী চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে ন্যূনতম শেষযাত্রাটুকুও আয়োজিত হয়নি।

মহানুভবতার মাসুল দিয়েছেন স্ত্রীও

এর পরে স্ত্রী ঊষারাণি চক্রবর্তী লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবক’টি মেডেল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে কাটিয়েছেন ৩৫টা বছর। আর্টিস্ট ফোরাম থেকে ঊষারাণি দেবীকে কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। কোনও সরকারও তাঁর পরিবারের দিকে নজর দেয়নি। শেষ জীবনে কিছুদিন মিঠুন চক্রবর্তীর অনুদান যেত তাঁর কাছে।

ঊষারাণিও অনেক কষ্ট পেয়ে চলে যান শেষমেশ।

দারিদ্র্য কেড়ে নিল মানুষ দু’টিকে, কেড়ে নিল পুরস্কারগুলোও। তুলসী চক্রবর্তীর কোনও ইতিহাস আর রইল না।

অবহেলাই পেলেন জীবনে, মরণেও

মিঠুন চক্রবর্তীর ‘শুকনো লঙ্কা’  ছবিটা দেখেছেন? তুলসী চক্রবর্তীর (Tulsi Chakraborty) চরিত্রেই অভিনয় করেছেন মিঠুন। এক জন এক্সট্রা আর্টিস্ট কী ভাবে নায়কের রোল পেয়ে স্বপ্নে ভাসতে থাকে।

এত বড় একজন লেজেন্ড তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty), যাঁর অভিনয় হলিউড অভিনেতাদের কাছেও ঈর্ষণীয়, তাঁর কোনও ইতিহাস সংরক্ষিত হয়নি। তাঁর অভিনীত কত ছবির প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি কলকাতা শহরে তুলসী চক্রবর্তীর একটা মূর্তি পর্যন্ত নেই।

কিন্তু বাংলা ছবির এই পরশপাথরটিকে শালগ্রাম শিলা রূপে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পুজো করে চলেছে বাঙালি দর্শককুল।

You might also like