মনোজ মিত্রের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ থিয়েটারপাড়া
শেষ আপডেট: 12th November 2024 11:53
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলা থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি মনোজ মিত্র প্রয়াত। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। মঙ্গলবার অর্থাৎ আজ সকাল ৮.৫০-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন কিছুদিন ধরে, অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল। শোকের ছায়া নাট্যজগতে।
'বাঞ্ছার' চলে যাওয়া থিয়েটারের বড় শূন্যস্থান বলেই মনে করছেন নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। দ্য ওয়াল-কে তিনি বলেন, 'আমি যখন থিয়েটার করি না, তখন থকে মনোজবাবুর নাটক দেখেছি। তারপরে একসঙ্গে দীর্ঘদিন আমরা নাট্য অ্যাকাডেমিতে কাজ করেছি। উনি সভাপতি ছিলেন তখন। আমরা সদস্য। নাট্য অ্যাকাডেমিতে বসে মনোজদার সঙ্গে আড্ডা মারার স্মৃতি রয়েছে অনেক। মাঝে মাঝে ফোন করতেন। শেষের দিকে আমার আর যাওয়া হয়নি। এখন মনে হয় যে এই মানুষগুলো চলে গেলেন, আস্তে আস্তে থিয়েটারে বড় শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে। খারাপ লাগছে আমাদের এই ভেবে যে পরবর্তী প্রজন্ম যারা কাজ করতে আসছে তাদের অনেকেই এই মানুষগুলোকে আর জানলেন না। আমরা অনেকদিন থেকে ওঁর কাজ দেখেছি। লেখা পড়েছি। যতদিন বেঁচে থাকব সবটা মিলিয়ে আমাদের একটা স্মৃতি রয়ে গেল।'
নাট্যকার অভিনেতা সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'মনোজদা বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। এমন সময় তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল যখন বাংলা থিয়েটার নাট্যকারের অভাবে বিদেশি নাটকের অনুবাদ করছে। সেই সময় দু'জন নাট্যকার মনোজ মিত্র আর মোহিত চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। বাংলা থিয়েটারকে তাঁরা পুষ্ট করেছেন।'
অভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তীর শিক্ষক ছিলেন মনোজ মিত্র। তাঁর কথায়, 'রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর ডিরেকশনে আমি ক্লাস প্রোডাকশন করেছি। ওঁর লেখা 'পাখি' তে আমার প্রথম কাজ। একদিন আমায় বললেন, আমার নাটক টেলিভিশনে রেকর্ড হবে, দেখানো হবে। মানে তখনই চ্যানেল এসেছে আরকি। উনি জিজ্ঞেস করলেন তুমি একটা পার্ট করবে? আমি রাজি হলাম। সল্টলেকের বিদ্যুৎ ভবনের ওখানে একটা হলে শুটিং হয়েছিল। তাতে মনোজবাবু নিজেও অভিনয় করেছিলেন। সেই সব কথা মনে পড়ছে এখন। মৌলিক নাটকে ওঁর আলাদা জায়গা ছিল, সেটা আর রইল না।'
চন্দন সেনের মা সন্ধ্যা চক্রবর্তী মনোজ মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করতেন। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে অভিনেতা বললেন, 'মনোজ মিত্র হচ্ছেন এমন এক বিরল নাটককার। আমি মূলত আগে নাটককারই বলব, কারণ একই সঙ্গে তিনি নাট্যকার, নাটককার এবং অভিনেতা। এই তিনটি ক্ষেত্রে একই সঙ্গে প্যারালাল তৈরি করা খুব মুশকিল। নাটককার মনোজ মিত্র এমন এক স্বাক্ষর রেখে গেছেন যে আগামী দিনগুলোতে যতবার যত নাটক যেখানে অভিনীত হবে, সেখানে দেখা যাবে ওঁর নাটকই সবচেয়ে বেশি অভিনীত হচ্ছে। এখনও তাই হয়। ভবিষ্যতেও তাই হবে। আমার একজন মাস্টারমশাইকে হারালাম। আমার যে মাস্টারমশাইরা আছেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস্টারমশাইকে হারালাম।
নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, 'আমার থিয়েটার জীবনে 'উইঙ্কল টুইঙ্কলের' সঙ্গে আর একটা নাটকের নামও লোকে বলে, সেটা হল 'দেবী সর্পমস্তা'। এই নাটকের নাটককার ছিলেন মনোজ মিত্র। স্যারের বাড়িতে গিয়ে যখন নাটকটা করার অনুমতি চাইলাম, উনি বললেন, দেখ এটা আমি ভেবেছিলাম নিজেই করব। কিন্তু পারিনি। তুই যদি করতে পারিস দেখ। স্নেহ ছিল ওঁর মধ্যে। আমাকে বারবার ইনস্পায়ার করে গেছেন উনি। সেই মানসিকতার মানুষ এখন দুর্লভ। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকে উনি আমায় ভালবাসতেন। বিভিন্ন কাজে উনি আমায় এগিয়ে দিতেন। বলতেন এই কাজটা দেবেশই করুক। স্যারের আর আমার দু'জনেরই দেশের বাড়ি বাংলাদেশের সাতকিরায়। দেখা হলেই বলতেন, এই আমার দেশওয়ালি এসে গেছে।'
সেপ্টেম্বরেই গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন সকলের প্রিয় বাঞ্ছারাম। বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সেসময়। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, ক্রিয়েটিনিন এবং সোডিয়াম-পটাশিয়ামের সমস্যাও ছিল তাঁর।
অভিনয় জীবনে তপন সিনহা, সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বাসু চ্যাটার্জি, তরুণ মজুমদার, শক্তি সামন্ত, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য পেয়েছেন অগুনতি পুরস্কার। তাঁর অভিনীত 'বাঞ্ছারামের বাগান', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' আজও মুগ্ধ করে সিনেপ্রেমীদের।