
দেবশঙ্কর হালদার
আমার সঙ্গে শাঁওলি মিত্রের যোগাযোগ কিছুটা দূর থেকেই। এটা আমার দুর্ভাগ্য যে আমি ওঁর সঙ্গে সরাসরি মঞ্চে নাটক করবার, বা একসঙ্গে নাটকের কাজ করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু এই থিয়েটারের জগতে বা নাটকের আঙিনায় এসে পড়বার ক্ষেত্রে ওঁর একটা ভূমিকা আমি স্পষ্টতই অনুভব করি। যদিও এক্ষেত্রে ওঁর ভূমিকা খানিক পরোক্ষ, কিন্তু তা আমাকে প্রত্যক্ষভাবে নাড়া দেয় বলেই মনে হয়৷
সেটা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, আমার কৈশোর-যৌবন পর্বে আমি যখন ওঁর বাচিক অভিনয় বা রেডিও নাটকগুলি শুনতাম, তখন সেগুলি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করত। নাট্যগুণ মানুষকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে, আচ্ছন্ন অর্থে সদর্থকভাবেই, ওঁর কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে সেইরকমই একটা বিস্তার আমার মধ্যে টের পেতাম। সেটা ওঁর এই রেডিও নাটককে ঘিরে।
পরবর্তীকালে আমি যখন থিয়েটারের দিকে আর একটু মনোযোগী হলাম, মানে আমি নিজেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হব বলে মনস্থ করছি, বা এসে পড়ছি থিয়েটারের আঙিনায়, এই যে ‘এসে পড়ছি’ বলছি, এই এসে পড়ার ক্ষেত্রে ধাক্কা হিসেবে ওঁর অবদান স্বীকার করি আমি। সেই সময় নানাবিধ প্রযোজনায় ওঁর অভিনয় দেখতে দেখতে মুগ্ধ হচ্ছি।
যেহেতু আমি শম্ভু মিত্র বা তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় সেভাবে দেখার সুযোগ পাইনি, শাঁওলি মিত্রের অভিনয় আমাকে সেই মানুষগুলি সম্পর্কেও যেমন জানান দিচ্ছে, তেমনই একইসঙ্গে থিয়েটারমুখী করে তুলছে। শুধুমাত্র দর্শক হিসেবে নয়, একজন কর্মী হিসেবে, একজন অনুরাগী হিসেবে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ার কথা মনের ভেতর থেকে কেউ একজন যেন বলে দিচ্ছে।
এই ধাক্কাই হয়তো আমাকে পরবর্তীকালে ‘নান্দীকার’-এর সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করে। এরকমটাই আমার মনে হয়। মনে হয় যে ক্রমাগত এই নাটক দেখা, শাঁওলি মিত্রের অভিনয়ের তীব্রতা, তার যে শৈল্পিক প্রকাশ– সবকিছু মিলিয়ে এমনভাবে প্রভাবিত করল আমায়, যে মনে হতে লাগল এই পথটিতে যদি হাঁটতে পারা যায়, তাহলে মন্দ হয় না৷তার জন্য যে আমি শাঁওলি মিত্রর কাছে সরাসরি গেলাম, তেমনটা নয়। কিন্তু নিজেরই অজান্তে কোথাও থিয়েটারের সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল।
সেসময় যেসব প্রযোজনায় ওঁকে দেখেছি, এমনকি পরবর্তীকালেও যেসব নাটকে ওঁকে অভিনয় করতে দেখেছি, নির্দেশনা করতে দেখেছি, সাংগঠনিক ভাবে সক্রিয় হতে দেখেছি, সেই সমস্তই এক অর্থে দিশার মতো আমাকে ওঁর অনুজ নাট্যকর্মী হিসেবে পথ দেখিয়েছে।একইসঙ্গে ওঁর অভিনয় দেখতে দেখতে বুঝতে পেরেছি, নাটকের এই পরম্পরা বা ঐতিহ্য, সেটি কেমন! বুঝেছি, আধুনিক মানুষ হিসেবে একটি অভিনয়কে কেমন করে পুরোনো ঐতিহ্য ও পরম্পরার সঙ্গী করা যায়, এবং ভবিষ্যতের জন্য তার একটি প্রয়োগরীতি তৈরি করা যায়। ওঁর অভিনয়ের মধ্যে এই শিক্ষাটা সবসময় ছিল৷ এই নয় যে, উনি আমাকে হাতে ধরে শেখাচ্ছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাসই করি, যে কোনও উৎকৃষ্ট প্রযোজনা বা নাটক সবসময় একটা প্রামাণ্য বইয়ের মতো। যার পাতা উল্টে উল্টে অনেক কিছু পড়ে দেখা যায়। শিখে ফেলা যায়। আর চাইলে তাকে নিজের মতো করে আত্মস্থ করে প্রয়োগ করা যায়, নিজের জীবনে বা নিজের কাজে।
শাঁওলি মিত্রও তাঁর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে, নির্দেশনার মধ্য দিয়ে আমাকে এইভাবে ঋদ্ধ করেছেন।
প্রযোজনা হিসেবে অনেকেই ‘নাথবতী অনাথবৎ’, ‘কথা অমৃতসমান’, ‘বিতত বিতংস’ বা ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’– এগুলোর কথা সবাই বলবেন। আমিও যে সময় ওঁর নাটক দেখতে শুরু করেছি, তখন এগুলো উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা বটে, কিন্তু কোনও একটি বিশেষ নাটকের কথা আমি বলতে চাই না। আমার কৈশোর থেকে, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, শুনতে শিখেছি তখন থেকেই ওঁর উপস্থিতি, ওই মোহময় কণ্ঠ এবং তার অসামান্য প্রকাশ– এগুলো ভোলার নয়।পরবর্তীকালে যখন নিজে নাটক করেছি, উনি সেই নাটক দেখে প্রশংসা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন। সেটাও একটা পরম পাওয়া। আবার যেটা অপছন্দ হয়েছে, সেটুকুও জানিয়েছেন। এটা যে খুব নিয়মিত ঘটত, তা নয়। ক্কচিৎ-কদাচিৎ কখনওসখনও ঘটত। কিন্তু এইভাবেই যোগাযোগটা থেকে গিয়েছিল।
অসম্ভব সম্মান ও শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। এবং আমি যে পথের পথিক, সেই পথের অগ্রে যে তিনি ছিলেন, এটা ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়।