শেষ আপডেট: 10th February 2025 23:42
পরিচালকদের একাংশর দাবি, তাঁদের সম্মতি ছিল না এই ‘প্রত্যাহার’ প্রত্যাহার করা হোক। একাংশ চাননি শুধুমাত্র মৌখিক আস্থায় ৬ তারিখ রাতে পরিচালকদের ছয়-ছয়টি শর্ত খানিক ব্যাকফুটেই চলে যাক। ৭ তারিখের সন্ধে ৬টার দুই মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচালক গিল্ডের বৈঠকে ঠিক কী ঘটেছিল? কারা ছিলেন, কারা ছিলেন না? বৈঠকে কী এমন হল, যার জেরে, নরম সুর পরিচালকদের গলায়? গোটা এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা টলিপাড়ায় এই অচলাবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে?
টেকনিশিয়ান স্টুডিওর আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, সুদেষ্ণা রায়, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, শ্রীজিত রায়, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরি, সৌভিক চক্রবর্তী এবং অনিন্দ্য সরকার। ছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের (পশ্চিমবঙ্গ) কয়েকজন সদস্য। স্বরূপ বিশ্বাস (সভাপতি, federation of cine technicians & workers) ছিলেন অনুপস্থিত। তাঁর পরিবর্তে ছিলেন ফেডারেশনের বেশ কিছু কমিটি সদস্য। পরিচালক গিল্ড আলোচনায়, মূলত যে বিষয়টি তুলে ধরে, তা হল বারবার কেন একের পর এক শুটিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে পড়ছে এবং এই আলোচনার মধ্যে তার সুরাহা করা। সূত্রের খবর, ‘প্রথম দু’ঘণ্টা কাদা ছোড়াছুড়ি হতে থাকে। এবং তার বেশিরভাগই করতে থাকেন এক প্রোডাকশন ম্যানেজার।’ পরিচালকদের তরফ থেকে জানানো হয়, শুটিং ফ্লোর ‘প্রত্যাহার’-এর আগে, লিখিতভাবে মেল মারফত অবহিত করা হয়। কিন্তু ফেডারেশন সেই চিঠির কোনও উত্তর দেয়নি। এও খবর, এই কথা শুনে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বকাঝকাও করেন, ফেডারেশনের সদস্যদের।
সূত্রের খবর, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘অচিন্ত্য আইচ সিজন-২’ শুটিং বন্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায়, ‘মিসকমিউনিকেশন’-এর জন্যই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রেও মন্ত্রীবাবু বেশ চটেই যান এবং বকাঝকা করেন ফেডারশেন সদস্যদের। মন্ত্রীবাবু এও বলেন আগামিকাল অর্থাৎ ৮ তারিখ থেকে জয়দীপের শুটিং শুরু করতে পারেন।
দ্বিতীয়জন অর্থাৎ পরিচালক শ্রীজিত রায়ের নতুন মেগা সিরিয়ালের শুটিং সেট তৈরির কাজ চলছিল দাশানি স্টুডিয়োয়, ৪নং ফ্লোরে, কিন্তু সে কাজ অসমাপ্ত রেখেই, টেকনিশিয়ানরা জানায়, তাঁরা কাজটি করবেন না। কারণ পরিচালক শ্রীজিতের বক্তব্যে আঘাত পেয়েছেন তাঁরা, সে কারণেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। বারবার পরিচালক জানতে চায়, তিনি কী বলেছেন, এবং যা বলেছেন, তাঁর প্রমাণস্বরূপ কিছু থাকলে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বসতে, অভিযোগ বিপরীত তরফ থেকে কোনও সদুত্তর পাননি, পরিচালক। তবে ৭ তারিখের আলোচনায়, জানা যায় শ্রীজিতের ‘নাম না করেই’ লেখা এক ফেসবুক পোস্টে আঘাতপ্রাপ্ত কিছু সিনেকর্মী। কোথাও তাঁদের মনে হয়েছে তা ফেডারেশনের দিকে ইঙ্গিত করেই লেখা হয়েছে। আলোচনা চলাকালীন, শ্রীজিতকে বলা হয়, একটি বয়ান ফেসবুকে পোস্ট করতে, (যা তিনি, ফেসবুক ওয়ালে, মধ্যরাতে পোস্ট করেন)। নিচে রইল সেই পোস্ট।
সূত্রের খবর, এরপর আলোচনায় উঠে আসে পরিচালক গিল্ডদের ‘ছয়টি শর্ত’। কাউকে ব্ল্যাকলিস্ট কিংবা কাজ বন্ধ করা যাবে না! কারণ পরিচালকদের একাংশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সূত্রের খবর, অরূপবাবু এ বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা দেননি। ফলত, তিনি এ বিষয়ে কোনও লিখিত তিনি দিতে পারেননি।
ঘটনাচক্রে আরেকটি বিষয় উঠে আসে, এর আগেও টলিউডে অচলাবস্থা তৈরি হয়, তার ইতি টানতে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে গঠন হয় এক কমিটি। ছিলেন প্রসেনজিৎ, দেব, গৌতম ঘোষ ও ২ মন্ত্রী, অর্থাৎ ইন্দ্রনীল সেন এবং অরূপ বিশ্বাস। অভিযোগ, এই কমিটির কাজ ছিল তিন মাসের মধ্যে টলিউডের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মিটিং করে সমস্যা খুঁজে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেওয়া। তিন মাস পেরিয়ে সাড়ে তিন মাস হতে চলল। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। একাধিকবার প্রতিশ্রুতি মিলেছে, সুরাহা মেলেনি।
তারপর গত ডিসেম্বর মাসে CCI (Competition Commission of India)-এ ফেডারেশনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন পরিচালকরা। বর্তমান বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের পরিবেশ দূষণ ও ক্রমবর্ধমান সঙ্কট নিয়ে প্রায় ১৬টি প্রসঙ্গকে ভিত্তি করে এই মামলা। সূত্রের খবর, এই মামলাটি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেডারেশনের গলায়।
৭ তারিখের আলোচনায় উঠে আসে সিসিআই এবং কমিটি গঠনের প্রসঙ্গও। সূত্রের খবর, ‘মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, মুম্বইতে ঠিক কীভাবে কাজ হয়, গৌতমবাবুর (গৌতম ঘোষ) কাছে লিখিতভাবে জানতে চান তিনি, কিন্তু তাঁর দাবি গৌতমবাবু তা লিখিত রূপে দিতে পারেননি।’ কিন্তু তা সত্য নয়, সূত্রের দাবি, ‘ডিরেক্টর্স গিল্ড বারবার যোগাযোগ করেন গৌতম ঘোষের সঙ্গে, কিন্তু তিনি বলেন কোনও নোটিফিকেশন তাঁর কাছে আসেনি, তাহলে তিনি কীভাবে কাজটি করবেন?’ (Competition Commission of India, FCTWEI, DAEI, Directors association of eastern india, federation of cine technicians & workers of eastern)
সূত্রের খবর, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এও বলেন, CCI-এর মামলা এক বছরও চলতে পারে কিংবা দুই। দ্রুত সুরাহা পেতে একটি নতুন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটিতে থাকবে, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, টেলি অ্যাকাডেমি, ফেডারেশন এবং ডিরেক্টর্স গিল্ডের সদস্য এবং ইন্ডাস্ট্রির ‘ওয়েলউইশার্স’। সেই কমিটির কাছে জমা পড়বে ফেডারেশন এবং ডিরেক্টর্স গিল্ডের যাবতীয় লিখিত সমস্যা। যদি এই কমিটি কার্যকরীভাবে কাজ করে, সুরাহা করতে পারে যাবতীয় সমস্যা, সেক্ষেত্রে CCI-এর মামলাটি প্রত্যাহার করতে হবে।
তবে সূত্রের খবর, ‘CCI (Competition Commission of India)-এর মামলাটি পরিচালকরা প্রত্যাহারের পথে নেই। তাঁরা অপেক্ষা করছে ২০ তারিখের আগে কমিটি গঠন এবং তার ফলপ্রসু সমাধানের দিকে, কারণ এই একটিভাবেই ফেডারেশন, চাপে রয়েছে। তাঁরা জানেন, যে এই মামলায় জেতা, প্রায় অসম্ভব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালককে প্রশ্ন করা হয়, নতুন কমিটি যদি কার্যকরী হয়, যদি সমাধান হয় সমস্যার? তাহলে কি CCI-এর মামলা প্রত্যাহার হবে না? পরিচালক বলেন, ‘যদি দেখা হয়, এই কমিটির কাছে, যে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তার সমাধান হয়েছে, সেক্ষেত্রে পরিচালক গিল্ড তা নিয়ে ভাবতে পারে, কিন্তু তার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, কারণ এর আগেও বহু আলোচনা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরও কোনও বদল ঘটেনি। নতুন কমিটি গঠন, কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আমরা।’
মূলত ছোটপর্দার পরিচালকরা শুটিং ফ্লোর ‘প্রত্যাহার’-এর দাবি তুলেছিলেন। দিনের পর দিন সমস্যা বাড়তে থাকায়, এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তাঁরা। সমর্থন মেলে বড় পর্দা এবং ওটিটির পরিচালকদের, সূত্রের খবর, গত এক দিনে সেই ছোট পর্দার পরিচালকদের অবস্থান আমূল বদলে যায়।
আরেক সূত্রের খবর, মন্ত্রীদের মিটিং শেষে এবং তার কিছুক্ষণ পরেই পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার মাঝে বেশ কিছু সমীকরণ বদলে যায়। বেশ কিছু ছোটপর্দার পরিচালক নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই পরিচালক আরও বলেন, ‘আলোচনায় বারবার জানানো হয়, এই লড়াই বেশ কঠিন, দীর্ঘায়িত হতে পারে। মনের জোর রাখতে হবে। তবে, পরিচালকদের একাংশের মনে হয়, সেই সকল পরিচালকদের পরিবার-পরিজন রয়েছে, সংসার রয়েছে। মেগা সিরিয়ালের শুটিং তাঁদের অন্ন সংস্থান। সেই কারণে অনেকে গতকাল (ডিরেক্টর্স গিল্ডের) মিটিংয়ে উপস্থিতও ছিলেন না। তাই সম্মিলিত এক সিদ্ধান্তে ঠিক হল পরিচালকরা ফিরবেন শুটিং ফ্লোরে!’
কিন্তু শুটিং ফ্লোরে ফিরেও কি স্বস্তি মিলবে পরিচালকদের? ফের যদি ফেডারেশনের কোপ পড়ে কাজে? প্রশ্নের উত্তরে সেই আশ্বাসের কথাই বললেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিচালক, ‘সেই আশ্বাস মিলেছে, তার প্রমাণস্বরূপ রাখাও রয়েছে, যে আগামী ২০ তারিখ অবধি অর্থাৎ কমিটি গঠন হওয়া পর্যন্ত, পরিচালকরদের নিশ্চিন্তি মিলবে।’
ঠিক কী আইনি পথ বেছে নিয়েছিলেন ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন?
ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (FCTWEI) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইর্স্টার্ন ইন্ডিয়া (DAEI)। মামলাটি দায়ের করা হয়েছে সিসিআই-এ (Competition Commission of India)।
সিসিআই (Competition Commission of India)
১৪ অক্টোবর ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, এই কমিশন। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সদস্যে গঠিত কমিশন। একজন চেয়ারপার্সন এবং ২-৬ সদস্য রয়েছেন। সিসিআই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশকে উৎসাহিত করে এবং বজায় রাখে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা এবং ভারতীয় বাজারের মধ্যে বাণিজ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, সঙ্গে সমস্ত কিছু নির্মূল করার জন্য দায়ী যা সুস্থ প্রতিযোগিতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। অতিরিক্তভাবে, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে কোনও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের অনুরোধের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা-সম্পর্কিত বিষয়ে মতামত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব নিতে পারে সিসিআই (Competition Commission of India)।