সাগর সেন খ্যাতি যত তাড়াতাড়ি পেয়েছিলেন, তাঁর প্রস্থানও ঘটেছিল বড্ড তাড়াতাড়ি।
রবীন্দ্র সাধক সাগর সেন
শেষ আপডেট: 16 May 2025 20:08
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের জমানায় রবীন্দ্রনাথের গানে খোলা হাওয়া এনেছিলেন সাগর সেন। চিরাচরিত কণ্ঠের মাঝে এক মুক্ত কণ্ঠ। যাঁর ভীষণ রোম্যান্টিক গলায় মজে থাকত তখন বাঙালি। সাগর সেন খ্যাতি যত তাড়াতাড়ি পেয়েছিলেন, তাঁর প্রস্থানও ঘটেছিল বড্ড তাড়াতাড়ি। যদিও যে কটি গানের রেকর্ড তিনি করে গেছেন সবই কালজয়ী। তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রায় ১০০। এখানেই তাঁর কন্ঠের জাদু।
সাগর সেনের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৫ ই মে ফরিদপুরে। দেশভাগের সময় সেন পরিবার চলে আসেন বরানগরে। সেখানেই জীবনের শুরুর সময়গুলো কেটেছিল তাঁর। বরানগরেই গানের তালিম নিয়েছিলেন তিনি। যদিও পূর্ববঙ্গে দেশের বাড়িতে যাতায়াত ছিল তাঁর।
কেরিয়ারের শুরুর দিকে কিন্তু হেমন্ত, কণিকা, সুচিত্রা, দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনেই রবীন্দ্রনাথের গানে ভালবাসা তৈরি হয় তাঁর।
১৯৫৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ভেসে এল এক নতুন কন্ঠ। যা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন শ্রোতারা। রবীন্দ্রনাথের গানেও যাঁর গলায় রয়েছে ক্লাসিকালের ছোঁওয়া। ছয়ের দশক থেকে সন্তোষ সেনগুপ্তর পরিচালনায় বিভিন্ন নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি। 'শাপমোচন' ও 'বাল্মীকি প্রতিভা' নৃত্যনাট্যে বেশ জনপ্রিয় হয় তাঁর কণ্ঠ।
সাগর সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র ‘রবিরশ্মি’। অচিরেই ‘রবিরশ্মি’র ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করে। ঐ একই বছর ১৯৬১ সালে তিনি বিবাহ করেন সুমিতা দেবীকে। তাঁদের তিন পুত্র সন্তান জন্মায় প্রীতম, প্রিয়ম ও প্রমিত।
১৯৬৮ সালে তিনি সবথেকে জনপ্রিয়তা পান 'আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান' রবীন্দ্রসঙ্গীতে। যে গান দিয়েই তিনি হেমন্ত, দেবব্রতদের স্তরে উঠে আসেন। এই গানই ছিল সাগর সেনের সিগনেচার মার্ক। কে জানত এই গানের কথা তাঁর শেষ জীবনের সঙ্গে মিলে যাবে।
১৯৭৪ সালে বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে তাঁর। ছবির নাম 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে'। ১৯৭৯ সালে 'পরিচয়' ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে' গানটির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্যকণ্ঠশিল্পীর 'বিএফজেএ' পুরস্কার পান। বাংলা ছবির জগতে তিনিই প্রথম পুরুষ শিল্পী, যিনি ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই ধারার পথিকৃৎ তিনিই।
১৯৭৫ সালের ৯ই অগস্ট দূরদর্শনের সূচনাপর্বে সাগর সেনের একক কণ্ঠে পাঠ ও দ্বৈত-কণ্ঠে সুমিত্রা সেনের সঙ্গে 'আজি এ আনন্দসন্ধ্যা' গানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা দূরদর্শনের পর্দায়। যা ছিল ঐতিহাসিক।
সাগর সেন কিন্তু সলিল চৌধুরীর কথায় সুরে 'দেবিকা' ছবিতে মৌলিক রোম্যান্টিক গান গেয়েছিলেন। 'তৃষিত নয়নে এসো, তাপিত হৃদয়ে এসো, বরষণ ধারা হয়ে মনের মরুতে এসো', সবিতা চৌধুরীর সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন তিনি। অপর্ণা সেন আর রঞ্জিত মল্লিকের প্রেমের দৃশ্যে এই অসাধারণ গান ব্যবহৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে প্রথম ও শেষবারের মতো মৌলিক গান প্লে ব্যাক করেন সাগর সেন।
১৯৮০ সালে 'আবির্ভাব' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি।
এত খ্যাতি, এত জনপ্রিয়তা সব ডুবে গিয়েছিল মারণ রোগ ক্যান্সারের অতলে। ১৯৮১ সালে ক্যান্সারের চিকিৎসা বলতে কিছুই ছিল না। চিকিৎসা শুরু করলেও কোন উপশম হল না। ১৯৮৩ সালে ৪ঠা জানুয়ারি মাত্র ৫০ বছরে প্রয়াত হন তিনি।
সাগর সেনের ছোট ছেলে প্রমিত সেনের সঙ্গেই বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায়ের কন্যা স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। সাগর আর সন্তু ভাল বন্ধু ছিলেন। যদিও সাগর সেন এই বিয়ের অনেক আগেই প্রয়াত। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই প্রমিত আর স্বস্তিকার সংসার ভেঙে যায়। তাঁদের বিয়ের আইনি জটিলতা বারবার উঠে এসেছিল শিরোনামে।