
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তরুণ মজুমদারকে (Tarun Majumdar) পরিচালক রূপে ছবি করার সাহস প্রথম জুগিয়েছিলেন উত্তম কুমার (Uttam Kumar)। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবির আউটডোরে উত্তমকুমার তরুণ বাবুকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজে ছবি পরিচালনা করছেন না কেন? ছবি করুন, আমি আর রমা (সুচিত্রা সেন) নায়ক-নায়িকা হবো।’
কানন দেবীর ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এ সহকারী রূপে কাজ করতেন তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায় ও শচীন মুখোপাধ্যায়। তরুণ,দিলীপ ও শচীন, তিন বন্ধু মিলে তৈরি করলেন ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠী। রাজি হলেন সুচিত্রা সেনও। দরকারে টাকা দেবেন বলেও আশ্বাস দিলেন। তৈরি হল যাত্রিকের প্রথম ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’। ছবি সুপারডুপার হিট। উত্তম-সুচিত্রা জুটির শেষ পরিপূর্ণ রোম্যান্টিক ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’।

কিন্তু যখন একক ভাবে তরুণ মজুমদার ছবি পরিচালনা শুরু করলেন, তখন তাঁর একটি ছবিতেও নায়ক রূপে উত্তম কুমারকে পাওয়া গেল না। প্রথমত, চরিত্রে যাঁকে মানাবে তাঁকেই নিয়েছেন তরুণ মজুমদার। স্টারডম বা প্রযোজকের কাছে কখনও তিনি আপস করেননি। তাই ‘পলাতক’ বা ‘নিমন্ত্রণ’-এর মতো ছবি বানিয়েছেন অনুপ কুমারকে নায়ক করে।
উত্তম কুমারকে নায়ক না করার পিছনে তরুণ বাবুর আরও বড় কারণ ছিল, উত্তম কুমারের ডেট সমস্যা। ডেট পেলেও বড় স্টার নিয়ে কাজ করার ঝক্কি অনেক। তাই তনু বাবুর ছবিতে উত্তম কুমারকে আমাদের দেখা হয়নি।

শোনা যায়, একবার তরুণ মজুমদার স্টুডিওতে বসে কাজ করছেন, এমন সময় উত্তমকুমার ঝড়ের মতো তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। তরুণ মজুমদার তাঁকে বসতে বলে চায়ের অর্ডার দিলেন। এবার উত্তমকুমার বললেন, ‘নায়ক-টায়ক অনেক করলাম জীবনে। এবার টোটালি অন্যরকম। যতরকম উল্টোপাল্টা ক্যারেকটার আছে, সব করব। প্রুভ করব, আমি পারি আমি পারি। ইয়েস আমি পারি।’

উৎপল দত্তর জনপ্রিয় নাটক ‘টিনের তলোয়ার’ নিয়ে ছবি করার কথা ভাবেন তরুণ মজুমদার। প্রধান চরিত্রে উত্তমকুমারকেই ভেবেছিলেন তনু বাবু। উত্তমকুমার এমন এক ছবিতে কাজ করার কথা ভেবেই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। উত্তমকুমারের সঙ্গে তরুণ মজুমদারের ‘টিনের তলোয়ার’ নিয়ে প্রাথমিক কথাও এগিয়েছিল। তনুবাবু উত্তমকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই ছবিতে অভিনয় করতে তিনি ইচ্ছুক কিনা! উত্তমবাবু মৌখিক সম্মতিও জানিয়েছিলেন। উৎপল দত্ত সবরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তরুণ মজুমদারকে।

সেই মতো ‘টিনের তলোয়ার’ ছবি প্রযোজনা করা নিয়ে প্রযোজক রাম গুপ্তের সঙ্গে কথাও এগোন তরুণ মজুমদার। ‘রাম সিনে আর্টস’ রাজিও হয়েছিল ‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনা করতে। সেটা ১৯৮০ সালের কথা। যখন এসব কথা চলছে, তখন তরুণ মজুমদার তাঁর ‘দাদার কীর্তি’ ছবি নিয়ে ব্যস্ত। ‘টিনের তলোয়ার’ নিয়ে বসার সময় তিনি পাননি। ছবির বাকি কাস্টিংও ভাবা হয়নি তখনও। তবে কিছু মাসের মধ্যেই ‘টিনের তলোয়ার’ ছবি শুরু করতেন তরুণ মজুমদার।

কিন্তু সেই বছরেই ২৪ জুলাই মহানায়কের মহাপ্রয়াণ ঘটল। উত্তমকুমারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভেঙে পড়লেন তনু বাবু। তরুণ মজুমদার ঠিক করলেন, উত্তমকুমারকে ছাড়া তিনি আর ‘টিনের তলোয়ার’ করবেন না। বন্ধ হয়ে গেল ছবির কাজ ও ভাবনা। আমরা হারালাম এক অনন্য সৃষ্টি, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকত।

তরুণ মজুমদার যে অভিনেতাকে ভেবে ছবির চিত্রনাট্য লিখছেন, তাঁকেই ছবিতে নিতেন। যখন তিনি শেষ অবধি উত্তমকুমারকে ভাবলেন আর উত্তমকুমার সে ছবি করতে পারলেন না , তখন তরুণ মজুমদার সেই ছবি করার আশাই ছেড়ে দিলেন। উত্তমকুমারের যে বিকল্প হয় না!
উত্তমকুমারের চলে যাওয়ার ৪২ বছর পরে, আবারও এক জুলাই মাসেই আজ প্রয়াত হলেন তরুণ মজুমদার নিজে। রয়ে গেল তাঁর অমর সৃষ্টিরা।