Date : 20th May, 2025 | Call 1800 452 567 | info@thewall.in
সিগন্যাল বিভ্রাটের জেরে ট্রেন পরিষেবা অবরুদ্ধ, হাওড়া স্টেশনে আটকে হাজার-হাজার নিত্যযাত্রীপাথরবোঝাই ডাম্পারে ছিন্নভিন্ন বাবা, দেহের টুকরো কুড়োতে হল ছেলেকে, অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেIPL 2025: প্লে অফের আগে বেঙ্গালুরুর বড় চমক, আইপিএলে বিশ্বের উচ্চতম ক্রিকেটারকর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভিভাবকদের হাতাহাতির উপক্রম! কী এমন হল নেতাজি নগরের স্কুলেঝড় তুলতে আসছে ‘ওয়ার-২’! টিজারে প্রথমবার বিকিনিতে কিয়ারা!জিএসটির পরও আলাদা ট্যাক্স কীসের? আর কত চাই? মমতার নিশানায় কেন্দ্রস্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে বিবাহবিচ্ছেদ করলে, খোরপোষ দিতে বাধ্য নন স্বামী: ছত্তীসগড় হাইকোর্টIPL 2025: প্রতিশ্রুতি রাখলেন রোহিত, নিজের ল্যাম্বরগিনি উরুস দিলেন বিজয়ীকে, দেখুন ভিডিওবৈভবকে জড়িয়ে ধরার 'বিকৃত' ভিডিও ছড়াল সমাজমাধ্যমে, রেগে কাঁই প্রীতি জিন্টা, জানালেন অসন্তোষবিচারক হতে হলে আইনজীবী হিসাবে ৩ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকা চাই, পুরনো নিয়ম ফেরাল শীর্ষ কোর্ট
Tarun Kumar

দাদা উত্তমের ছায়ায় নয়, প্রতিভার জোরেই বাংলা সিনেমায় আলো জ্বেলেছিলেন তরুণকুমার

গ্ল্যামারকে সেই অর্থে কোনও দিন আমল দেননি এই অভিনেতা।

দাদা উত্তমের ছায়ায় নয়, প্রতিভার জোরেই বাংলা সিনেমায় আলো জ্বেলেছিলেন তরুণকুমার

তরুণকুমার

শেষ আপডেট: 24 February 2025 13:40

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্ল্যামারকে সেই অর্থে কোনও দিন আমল দেননি এই অভিনেতা। অন্যদিকে তাঁর নিজের দাদা (Uttam Kumar) যেন গ্ল্যামারেরই দেবতা। কিন্তু ভাই একেবারেই সাধারণ সাজেও অসাধারণ। তিনি ইন্ডাস্ট্রির বুড়োদা, সবার প্রিয় তরুণকুমার (Tarun Kumar)। দাদা উত্তমকুমার বলতেন, "শুধু দু'জনের সঙ্গে অভিনয় করতে গেলে আমায় সতর্ক থাকতে হয়। একজন সাবু (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) আরেকজন আমার ভাই বুড়ো (তরুণকুমার)। দুজনেই আমার চেয়েও বড় অভিনেতা। এরা কখন তাক লাগিয়ে দেবে কিচ্ছু বলা যায় না।"

১৯৩১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম তরুণকুমারের (Tarun Kumar)। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় সাহেবি সিনেমা হল 'মেট্রো'র অপারেটর। মা চপলা দেবী গৃহবধূ। অরুণ, বরুণ, তরুণ তিন ছেলেকে নিয়ে সাতকড়ি ও চপলার সংসার কলকাতার ভবানীপুরে গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে। তাঁরা ছিলেন বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের বাসিন্দা।

কোনও রকমে টেনেটুনে সংসার চললেও আদতে শিল্পমনস্ক ছিল এই বনেদি পরিবার। সবার প্রথমে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ির 'নতুন প্রভাত' বলে একটি নাটকে ভিলেনের অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন তরুণ। সেই নাটকে তরুণের অভিনয় দেখে ফিল্ম ডিরেক্টর অর্ধেন্দু সেন তরুণকে পছন্দ করেন তাঁর 'হ্রদ' ছবির একটি চরিত্রে।

উত্তমকুমার অভিনীত সেই 'হ্রদ' ছবিতেই ভাই তরুণকুমারের আত্মপ্রকাশ। এরপর একের পর এক ছবিতে তুখোড় অভিনয়। 'দাদাঠাকুর' ছবিতে অভিনয় করে তরুণ পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। 'দেয়া নেয়া', 'কাল তুমি আলেয়া', 'কমললতা', 'পিতাপুত্র', 'স্ত্রী', 'মিস প্রিয়ংবদা', 'ঝিন্দের বন্দী', 'চৌরঙ্গী', 'চুপি চুপি আসে', 'শেষ অঙ্ক', 'সাতে পাকে বাঁধা', 'সপ্তপদী'-- অজস্র ছবিতে তরুণ কুমার আইকনিক।

প্রথম ছবি উত্তম কুমারের সঙ্গে হলেও, দাদার জনপ্রিয়তার উপর ভর করে যে তরুণকুমার ফিল্মে সুযোগ পেতেন, তা একেবারেই নয়। তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন নিজগুণেই। উত্তমকুমার বলতেন, "বুড়ো হল হাতির মতো। হাতি যেমন নিজের ক্ষমতা পরিমাপ করতে পারে না, বুড়োও হল তাই। হইচই করে, হাসাহাসি করে সারাদিন, কিন্তু ভিতরে প্রচণ্ড সিরিয়াস এক অভিনেতা।"

সুপ্রিয়া দেবী নিজের হাতের রান্না করে পরিবেশন করছেন তরুণ কুমার, কিশোর কুমার, উত্তম কুমারকে (Uttam Kumar)।

বেশিরভাগ ছবিতেই ছোট চরিত্রেও তরুণকুমার বুঝিয়ে দিতেন 'সিরিওকমিক' অভিনয় কাকে বলে।

ষাটের দশকের শুরুতেই মঞ্চ ও চিত্রজগতের সহকর্মী অভিনেত্রী সুব্রতা সেনকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন তরুণ। পরে পারিবারিক মত পেলে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। তরুণের বিয়ের অনুমতি বাড়িতে পাশ হয় দাদা উত্তমের সাহচর্যেই। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের রিল টু রিয়েল লাইফে আদর্শ দম্পতি ছিলেন সুব্রতা-তরুণ। বিয়ের পরও সুব্রতাকে অভিনয় ছাড়তে হয়নি। তা বলে সংসারও অবহেলা করেননি।

রুপোলি পর্দার পাশাপাশি পেশাদারি মঞ্চ নাটকেও তরুণকুমার ছিলেন রাজা। 'ক্ষুধা', 'সেতু', 'চৌরঙ্গী', 'আসামী হাজির', 'নহবত', 'নাগপাশ'-- ইত্যাদি বিখ্যাত নাটকে রমরম করত থিয়েটার পাড়া। দাদার নামে গড়েছিলেন 'উত্তম মঞ্চ'। শেষ জীবনেও উত্তমমঞ্চে তরুণকুমার অভিনয় করতে নামতেন 'মরেও শান্তি নেই' নাটকে। আর বিশ্বরূপায় 'আসামি হাজির' নাটক? বিকাশ রায়ের পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতা হয়েও হুইল চেয়ারে বসে বিকাশ রায়ের বাবা সাজতেন তরুণ।

উত্তমকুমারের প্রয়াণের পরেও দাদার লিগ্যাসি ধরে রেখেছিলেন তরুণকুমার তাঁর কাজে। তবে দীর্ঘ রোগভোগে নিভে এসেছিল সেই প্রাণশক্তি।

একইসঙ্গে সেসময় অসুস্থ ছিলেন অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় ও তরুণকুমার, স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই। সুব্রতা ভুগছিলেন হাই সুগার ও কিডনির অসুখে। মাঝেমধ্যেই তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোমে যমে-মানুষে টানাটানি চলত।

২০০৩ সালের ১৪ অক্টোবর সুব্রতা কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন নার্সিংহোম থেকে। কিন্তু তাঁর তিনদিনের মধ্যেই ১৭ অক্টোবর রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে হয় তরুণকুমারকে। ৭২ বছরের এই অভিনেতা কয়েক মাস ধরেই ভুগছিলেন কিডনি ও লিভারের জটিল অসুখে। তরুণ কুমারের থেকেও বেশি অসুস্থ ছিলেন সুব্রতা। কিন্তু তার মধ্যেই তরুণ কুমারকে নিয়ে এই বিপত্তি। এমনও দিন গেছে, হাসপাতালে ভিজিটিং সময়ে বাড়ির লোক কেউ দেখতেই যেতে পারেননি তরুণকুমারকে। কারণ সেদিনই হয়তো সুব্রতা খুব অসুস্থ। সবাই ভেবেছিল সুব্রতাই আগে মারা যাবেন, কিন্তু ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর হেপাটাইটিক কোমায় প্রয়াত হলেন তরুণ কুমার, উত্তমকুমারের আদরের ছোটভাই বুড়ো।

সেই মর্মান্তিক দিনে ছিল ভাইফোঁটা। উৎসব আমেজের মাঝেই বাঙালি হারাল তার গর্বের নট তরুণ কুমারকে। স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সুব্রতা। ভাঙল পার্থিব জীবনে এতদিনের তরুণ-সুব্রতা জুটি। "আমারই তো স্বর্গে যাওয়ার কথার ছিল। এ বাড়িতে ওর হাত ধরেই এসেছিলাম। যদি একসঙ্গে দুজনে যেতে পারতাম।"-- কান্নাধরা কণ্ঠে সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন।

রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল তরুণকুমারের মরদেহ। সোমবার সকাল ১১:৪০ মিনিট নাগাদ মারা গিয়েছেন তিনি। দোতলার ঘরে কাঁদছেন সুব্রতা। নীচের লাল সিমেন্টের উঠোনে রাখা হল তরুণকুমারের দেহ। সেখান থেকে ঘরেও আনা হল।

উত্তম কুমার মারা যাবার পরেই জৌলুস হারিয়েছিল ৪৬ নম্বর গিরিশ মুখার্জী রোড। শেষ লেজেন্ডও চলে গেল সেই বাড়ি থেকে। আর তাঁর সম্মানেই সেদিন টালিগঞ্জ পাড়ায় প্যাক আপ। গীতা দে, সঙ্ঘমিত্রা ব্যানার্জী, রাজা সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অনেকেই শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।

 উত্তম কুমারের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে মালা দিচ্ছেন ভাই তরুণ কুমার।

স্ত্রী সুব্রতার সাথে একমাত্র মেয়ে মনামী, জামাই পান্না, নাতনি সুরভিতা ও নাতি সৌরভকে রেখে গেলেন তরুণকুমার। শোকস্তব্ধ উত্তম-পুত্র গৌতম বলেন, "আমি দ্বিতীয়বার পিতৃহীন হলাম।" নাতি সৌরভের 'পাতালঘর'-এ প্রথম অভিনয় তরুণকুমার দেখে গিয়েছেন। গৌরবের অভিনয় নিয়েও গর্ব করতেন তাঁর ছোটদাদু।

গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়ি থেকে 'উত্তম মঞ্চ' হয়ে তরুণকুমারের মরদেহ সেদিন গিয়েছিল কেওড়াতলা মহাশশ্মানে। "আমাকে কেন রেখে গেল", বলে তখনও কাঁদছেন সুব্রতা। সাদা-কালো শাড়িতে এক বর্ষীয়সী ঘরের মধ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সুব্রতাকে, "কাঁদিস না, ছোট"। সে সময়ে নিউ আলিপুরের এক বাড়িতে 'কাঁটাতারের বেড়া' সিরিয়ালের শ্যুটিং করছিলেন এই বর্ষীয়সী। ফোনে তরুণকুমারের মৃত্যুর খবর পেয়েই মাথা ঘুরে পড়ে যান। তারপর সোজা উত্তমের বাড়িতে।

সেই বর্ষীয়সীর নাম সুপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়। আশি সালে উত্তমকুমারের প্রয়াণের সময় এই গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়ির সঙ্গে ময়রা স্ট্রিটের সুপ্রিয়া দেবীর বিবাদ তুঙ্গে। সেদিনও শোকমিছিলে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন সুপ্রিয়া। অচৈতন্য বিহ্বল সুপ্রিয়াকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন শমিত ভঞ্জ।

তরুণ কুমারের মৃত্যুর পরে, ইতিহাসের শেষপর্বে দুই বাড়ি আবার একাকার।

কেমন অদ্ভুত টেলিপ্যাথি, পরের বছর তরুণ কুমারের জন্মদিন, ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই চলে গেলেন সুব্রতা। তরুণকে ছাড়া জন্মদিন কাটাতে হল না তাঁকে। ২০০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬৩ বছর বয়সে পাড়ি দেন পরলোকে। তরুণ-সুব্রতার মতোই গৌরী দেবীও এক বছরের মধ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন উত্তমকুমারের কাছে। উত্তম-পুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায় ২০০৫ সালের ৩ জুলাই প্রয়াত হন। ১৫ মে ২০২১ প্রয়াত হন তরুণ কুমারের জামাই পান্নালাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও।


ভিডিও স্টোরি