শেষ আপডেট: 17th January 2024 16:20
বাংলা সিনেমা তাঁকে যোগ্য সম্মান হয়তো দিতে পারেনি, তবে তাঁকে ভুলতেও পারেনি। তাই সুখেন দাসের (Sukhen Das) সিনেমা মানেই আজও বাঙালি দর্শকদের একাংশের আবেগমোচন। সুখেন ছিলেন ট্র্যাজিক অভিনেতা। আবার সুখেন পরিচালিত ছবিগুলোও ভীষণই আবেগপ্রবণ। শোনা যায়, দর্শক চোখের জল মুছতে মুছতে হল থেকে বেরোতেন।
এই সুখেন দাসকেই নাকি স্বয়ং সুচিত্রা সেন একবার তাঁর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের প্রাসাদোপম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন! কারণ কী?
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অবশ্য বাংলা ছবির ফরম্যাট আমূল বদলে গেছে। সিঙ্গল স্ক্রিন উঠে গেছে প্রায়। সবটাই এখন মাল্টিপ্লেক্স বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ হচ্ছে। আজকাল অনেকের কাছেই সুখেন দাস মানে ট্রোল করার একটা বিষয়। কিন্তু এই মানুষটার জীবনটা কিন্তু গল্পের মতো। স্পটবয় থেকে পরিচালক হওয়ার আখ্যান অনেকেই জানেন না। একসময়ে তাঁর ছবি হিটের পর হিট দিত। আজকাল একান্নবর্তী পরিবারের সবাই মিলে সিনেমাহলে যাওয়াই যেন ইতিহাস। কিন্তু সেইসময়কার সমাজ ব্যবস্থা, একান্নবর্তী পরিবার, ভাইয়ে ভাইয়ে মিল, জায়ে জায়ে ঝগড়া, বাড়ির বড়দা অথবা দাদামণির সব দায়িত্ব-- এগুলোই সেগুলোই উঠে আসত বাংলা ছবিতে। চিত্রনাট্য আর গল্প বলার জোরে ছবি সুপারহিট হতো।
সুখেন দাসের ছবি হিট হওয়ার আর একটা বড় প্লাস পয়েন্ট ছিল ওঁর দাদা অজয় দাসের সুরারোপিত গান। কী দারুণ দারুণ সব গান বানিয়েছেন অজয় দাস। অনুরাগের ছোঁয়া, প্রতিশোধ, জীবন-মরণ, অমরকন্টক কত কত- যা আজও হিট। উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও কাজ করেছেন সুখেন দাসের ছবিতে। এমনকি সুজিত গুহর 'অভিমান' ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরীর বড়দার রোলে সুখেন দাসের রোলও ভুলতে পারেননি অনেকে।
সুখেন দাসের পরিচালনায় সুনয়নী, সিংহদুয়ার, মান অভিমান, সংকল্প, প্রতিশোধ, জীবন-মরণ, দাদামণি, দান-প্রতিদান সবই এক একটা সুপারহিট ছবি। শোনা যায়, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও সুখেনের ছবি হিট করানোর ক্ষমতাকে তারিফ করতেন। সুখেন খুব লেখাপড়ার তো সুযোগ পাননি কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে শিখরে ওঠেন।
অজয় দাসের কথাও অনস্বীকার্য। যখন স্বয়ং কিশোরকুমার টাকাপয়সার পেমেন্ট ব্যতীত কোনও গান রের্কড করতেন না, তিনিও 'অমরকন্টক' ছবির 'এই তো জীবন ... চিতাতেই সব শেষ' গানটি গেয়ে এত আবেগতাড়িত হয়েছিলেন যে অজয় দাস এবং সুখেন দাসের কাছ থেকে কোনও পারিশ্রমিক নেননি।
টালিগঞ্জ পাড়ার স্পটবয় হিসেবেও কাজ করেছেন সুখেন দাস। আর সেখান থেকেই তাঁর আলাপ সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। যদিও এর আগে শিশুশিল্পী হিসেবে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন মাস্টার সুখেন। তখন ছবিতে টাইটেল কার্ডে ওঁর নাম মাস্টার সুখেন বলেই থাকত। এর পরে ১০-১১ বছর বয়সের কথা। যখন সুখেন না ছোটদের রোলে মানানসই, না বড়দের রোলে।
১৯৫৪-৫৫ সালের কথা। শ্যুটিং চলছে দেবকী কুমার বসুর ‘ভালোবাসা' ছবির। সুচিত্রা সেন, বিকাশ রায় অভিনীত ছবি। তার আগে উত্তম-সুচিত্রার 'অগ্নিপরীক্ষা' মুক্তি পেয়ে গেছে। অগ্নিপরীক্ষার পরে অনেকগুলো ছবিতে সুচিত্রার বিপরীতে অন্য নায়ক থাকলে সেগুলোয় সুচিত্রা সেনের নাম বড় করে থাকত। কিন্তু সুচিত্রা ও উত্তম থাকলে তাঁদের নাম এক হরফে থাকত। আসলে অগ্নিপরীক্ষা সিনেমাটি উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে অন্য উচ্চতায় তুলে দেয়। তাই বিকাশ রায়ের মতো বড় নামও সুচিত্রার চেয়ে ছোট হরফে থাকত।
সে যাই হোক, সে সময় মাস্টার সুখেন ছিল ‘ভালোবাসা’ ছবির স্পটবয়। সেখান থেকেই সুচিত্রা সেনকে দিদিভাই বলার অধিকার পায় সুখেন দাস। যেখানে তিনি সবার মিসেস সেন। সুখেনকে ভাই করে ডাকতেন সুচিত্রা। সুখেনের মুখে একটা নিষ্পাপ সারল্য আর মায়া ছিল। চরম দারিদ্র্য থেকে সুখেন স্পটবয়ের কাজে আসে। কিন্তু কাজে নিষ্ঠা ছিল চোখে ছিল স্বপ্ন। মিসেস সেনকে তাই চিরকালই সুখেন দিদিভাই বলে ডেকেছেন। সেই সম্পর্কই বজায় ছিল সুখেন অভিনেতা থেকে পরিচালক হয়ে যাওয়ার পরেও।
সেই দিদিভাইয়ের স্নেহের অধিকার থেকেই সুখেন একটা আবদার নিয়ে সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আবদারটা ছিল, সুখেন দাস পরিচালিত ‘মান অভিমান’ ছবিতে সুচিত্রা সেনকে অভিনয় করার অনুরোধ করেন সুখেন। সেটা ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা। সুচিত্রা সে সময় প্রায় অভিনয় ছেড়ে দিতে চাইছেন। নিজের পারিশ্রমিক দ্বিগুণেরও বেশি করে দিয়েছেন। একের পর এক পরিচালক প্রযোজকদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এমন সময়েই তাঁর বাড়িতে উপস্থিত সুখেন। তাঁরই ছবিতে অভিনয়ের আবদার নিয়ে। মিসেস সেনকে ভেবেই সুখেন স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সুচিত্রা দেখা করলেন।
কিন্তু প্রস্তাব শুনেই তীব্র রাগে বোমার মতো ফেটে পড়লেন সুচিত্রা সেন, যা ভাবতেও পারেননি সুখেন। সুখেনের ছবিতে অভিনয়ের কথা শুনেই এমন রাগ। সুচিত্রা চিৎকার করে বললেন সুখেনকে “এক্ষুনি তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।” একথা বলেই গটগট করে সুচিত্রা ভেতরের ঘরে চলে যান। সেদিন থমকে গেছিলেন সুখেন দাস। তাঁর দিদিভাই এভাবে বলতে পারল! বেরিয়ে এলেন সুখেন চোখ মুছতে মুছতে।
এত দিনের সম্পর্কে ছেদ পড়ল। পরে সুখেন ভাবলেন, এটা তাঁরই অন্যায়। যখন ম্যাডাম অভিনয় করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তখন তাঁকে অভিনয় করার অনুরোধ না করলেই হত। সম্পর্কটা থাকত।
এর পরেই শুরু হল 'মান অভিমান' ছবির শ্যুটিং। সুচিত্রা সেনের রোলটা করলেন সুমিত্রা মুখার্জী। সঙ্গে অনিল চ্যাটার্জী। ছোটোদের গল্প নিয়ে ছবি। মা ও সন্তানের গল্প। নিউ থিয়েটার্সের এক নম্বর স্টুডিওতে চলছে শ্যুটিং। হঠাৎ মিসেস সেনকে ফ্লোরে দেখে চমকে উঠলেন সুখেন দাস ও বাকিরা। এ স্বপ্ন না সত্যি! শ্যুটিং বন্ধ করে দৌড়ে এলেন সুখেন দাস। চোখের গগলসটা খুলে দিদিভাই সুখেনকে বললেন "তোমার ছবির শ্যুটিং দেখতে এলাম।” শ্যুটিং তো মাথায় উঠল সবার, সুচিত্রা সেনের মেজাজের সামনে কোন সাহসে শ্যুটিং করবে!
তবু শুরু হল ‘মান অভিমান’ শ্যুটিং। সুচিত্রা সেন বেশ কিছুক্ষণ বসে দেখলেন। সুখেন দাসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার পরে চলে গেলেন সুচিত্রা। বললেন, আরও সফল হোক সুখেন। সেদিন অভিভূত হয়ে গেছিলেন সুখেন দাস। একদিন তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন যে মানুষটি, তিনি আজ সশরীরে কোনও খবর না দিয়েই তাঁর ছবির শ্যুটিং দেখতে হাজির!
এ ম্যাডামের পক্ষেই সম্ভব। দিদিভাই তাঁর ভাইকে যেমন বকেছিলেন, আবার স্নেহ দিয়ে ভরিয়েও দিলেন! একেই বোধহয় বলে সুচিত্রা সেনের মুড, যার তল পাওয়া যায় না।