
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়![]()
উত্তমকুমারকে নিয়ে তাঁর দুই নায়িকা সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen) আর সুপ্রিয়া দেবীর (Supriya Devi) মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল? এই নিয়ে বাঙালির জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই আজও। তিন লেজেন্ডই পরলোকে, তবু পর্দায় আজও তাঁদের ম্যাজিক অটুট।সুপ্রিয়া চৌধুরী আর সুচিত্রা সেন (Suchitra Sen), দুজনের সম্পর্কের মাঝের সেতুটি ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে বাঙালি-মন যতটা পবিত্রতার সাথে গ্রহণ করে এসেছে, ততটাই রসালো আলোচনা চলেছে উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিকে নিয়ে। রসিকা সুপ্রিয়া দেবী আমৃত্যু এই হট্ গসিপে আরও ঘি ঢেলেছেন, উত্তমকে নিয়ে তাঁর নানা কথায়। অন্যদিকে ‘ভেরি প্রাইভেট পার্সন’ সুচিত্রা সেন চিরকাল মুখে কুলুপ এঁটে রহস্য আরও ঘনীভূত করেছেন। তাই দর্শক-মনে সুচিত্রা সেন কিছুটা দেবীর আসনে বসে আছেন। কিন্তু রক্তমাংসের বাস্তব সুচিত্রা সেন কি এতটাই গম্ভীর ছিলেন?
যারা সুচিত্রা সেনকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা একদম উল্টো। বিশেষত উত্তমকুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেন অফস্ক্রিনেও একটা প্রেমের বাতাবরণ তৈরি করে রাখতেন। শ্রদ্ধেয় অভিনেতা অনুপ কুমার এককালে উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবিতে সুচিত্রা সেনের ভাইয়ের চরিত্রে বহুবার অভিনয় করেছেন। অনুপ কুমার বলতেন “রমাদি (Suchitra Sen) উত্তমদার সঙ্গে মাঝেমধ্যে এমন আদি রসাত্মক কথাবার্তা বলতেন, যে আমাদের কানটান লাল হয়ে যেত। ওঁরা দুজন দুজনের এতটাই বন্ধু ছিলেন সেখানে দুজনের ইগো বাইরে প্রকাশ পেতনা। ব্যক্তিগতভাবে দুজনের মনান্তর কখনও হলেও সেটা ওঁরা বাহিরমহলে কখনও প্রকাশ করেননি। ওঁরা দুজনে ঝগড়া করছেন এমন কখনও দেখিনি।”
উত্তম-সুচিত্রা জুটি, উত্তম সুপ্রিয়া জুটি বাঁধার অনেক আগে থেকেই সুপারহিট। সমান্তরালভাবে চলত উত্তম-সাবিত্রী জুটির জনপ্রিয়তা। সুপ্রিয়া তখন সাধারণ মেয়ে ‘বেণু’। উত্তম-সুচিত্রাকে সুপ্রিয়া প্রথম দেখেছিলেন যখন সুপ্রিয়ার বয়স আঠেরো। শেওড়াফুলির একটা সিনেমাহলে, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি দেখতে গিয়েই এই জুটিকে প্রথম দেখা সুপ্রিয়ার।
যদিও অনেক ছোটবেলায় উত্তমকুমারকে বাড়ির পাশে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখেছিলেন সুপ্রিয়া। ‘বসু পরিবার’ ছবিতে উত্তমের সাথে অভিনয়ও করেছেন সুপ্রিয়া। কিন্তু ‘বসু পরিবার’ এ অভিনয় করার পরই সুপ্রিয়ার বাড়ি থেকে বলা হল “অনেক হয়েছে আর এক্টিং-ফ্যাক্টিং এর দরকার নেই।” প্রথম দিকে সুপ্রিয়া ফিল্মে অভিনয় করেও বাড়ির লোকদের থেকে কোন উৎসাহ পাননি। যেন ফিল্মে অভিনয় করার ইচ্ছেটাই শেষ হয়ে যেতে বসেছিল।
ভগ্নহৃদয় সুপ্রিয়া তবু ফিল্মে অ্যাক্টিং করার আশায় হাজির হলেন স্টুডিও পাড়ায় আবার। দেখা হল ‘বসু পরিবার’-এর পরিচালক নির্মল দে-র সঙ্গে। খানিকক্ষণ কথোপকথনের পর নির্মল দে সুপ্রিয়াকে বললেন “উত্তম-সুচিত্রার তো একটা নতুন বইয়ের শ্যুটিং চলছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। আমিই ডিরেকশন দিচ্ছি। চল আলাপ করিয়ে দিই রমার সঙ্গে।”
সুপ্রিয়াকে নির্মল দে নিয়ে গেলেন সুচিত্রার ঘরে। মেকআপ টেবিলের সামনে বসে আছেন মিসেস সেন। তখন তিনিও নতুন। তবু বেশ নাম করেছেন। আয়নার আলো আর সুচিত্রা সেনের (Suchitra Sen) ব্যক্তিত্বের বিচ্ছুরণে উদ্ভাসিত গোটা ঘর। সে কিরণ আছড়ে পড়ল সুপ্রিয়ার হৃদয়ে। সুচিত্রা মৃদু হাসলেন সুপ্রিয়াকে দেখে। সেই প্রথম দুজনের আলাপ। কে জানত সুচিত্রার পরবর্তী স্থানটি সুপ্রিয়াই দখল করবেন। হয়ে উঠবেন উত্তম প্রেয়সী।
কিন্তু সুপ্রিয়ার উত্তম-সুচিত্রাকে একসঙ্গে দেখা শেওড়াফুলির সিনেমাহলেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে। সেদিন সিনেমাহলে বসে অনুচ্চারে সুপ্রিয়া চিৎকার করে বলেছিলেন “ওঁদের আমি চিনি, জানি!”
সময় এগিয়েছে। এক ভগ্নহৃদয় অনামী মেয়ে বেণু হয়ে উঠেছে সুচিত্রা সেনের মতোই প্রথম সারির নায়িকা। পরে সেই সুপ্রিয়ার তৈরি হয়েছে অন্য পরিচয় ‘উত্তমের বেণু’। সুচিত্রা সেন হয়েছেন সুপ্রিয়ার ‘রমাদি’। আপনি থেকে তুমি। সুপ্রিয়াই বলেছেন সুচিত্রা নাকি একবার উত্তমকে বলেছিলেন “উতু, বেণু মেয়েটা খুব ভাল রে, খুব ভাল।”
উত্তম-সুচিত্রা (Suchitra Sen) জুটির জনপ্রিয়তাকে কি ঈর্ষা করতেন সুপ্রিয়া?
সুপ্রিয়া চেয়েছিলেন ঐ জুটির ভিতর ঢুকতে। নিজের স্টারডম বানাতে। উত্তম-সুপ্রিয়া জুটি পরবর্তীকালে অনেক রকমের অনেক শেডের ছবি করেছে। সুচিত্রা সেনকে হিংসে খুব একটা করতেন না সুপ্রিয়া দেবী। সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিত্বকে বরং ঈর্ষা করতেন, শ্রদ্ধাও করতেন সুপ্রিয়া।
একবার এক বৃষ্টিস্নাত দিনে সুচিত্রা সেন ঘটালেন এক মজার কাণ্ড। অঝোর বৃষ্টিতে সেদিন সুপ্রিয়া বাড়িতে বসে আছেন। হঠাৎ উত্তম-সুপ্রিয়ার ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে সুচিত্রা সেনের ফোন।
সুপ্রিয়া ফোন ধরলেন। সুচিত্রা বললেন “কে সুপ্রিয়া?”
সুপ্রিয়া বললেন “হ্যাঁ বলছি।”
“উতু বাড়িতে আছে?” (উত্তমকে ‘উতু’ বলেই ডাকতেন সুচিত্রা সেন)
“না তো” বললেন সুপ্রিয়া…
“সে কী, এই বৃষ্টিতে উতু বাড়ি নেই?”
সুপ্রিয়া বললেন “শ্যুটিংয়ে গেছে। কী করবে বল!”
“ইস, শ্যুটিংয়ে গেছে? উতুকে এখন ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল”- বললেন সুচিত্রা সেন।
সুপ্রিয়া এতটুকু অপ্রস্তুত না হয়ে বললেন “ভালই তো! তুমি বাড়িতে আছো তো! ও যেখানে শ্যুটিং করতে গেছে সেখানে ফোন করে বলে দিচ্ছি, প্যাকআপ হলে তোমার বাড়ি চলে যায় যেন।”
গভীর বিস্ময়ে সুচিত্রা বললেন, “তুমি এত নির্বিকারে বললে কী করে সুপ্রিয়া? হিংসে হচ্ছে না তোমার?”
সুপ্রিয়া বললেন “রমাদি তোমাকে আমি চিনি।”এখানেই সেদিনকার ফোনে ইতি হয়। সত্যিই তাঁর রমাদিকে চিনতেন সুপ্রিয়া দেবী। সুপ্রিয়া জানতেন সুচিত্রা সেন এগুলো রসিকতা করেন। আর সুচিত্রাও জানতেন সুপ্রিয়া এগুলো সিরিয়াসলি নেন না। মজা হিসেবেই নেন। পর্দার বাইরে উত্তমের সঙ্গে সুচিত্রা সেন কখনও ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্ক রাখেননি।
সুপ্রিয়া দেবী একবার এক চমকপ্রদ তথ্য বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। বলেছিলেন,
“রমাদি কেন, উত্তমের সঙ্গে অন্য কারও সম্পর্ক হলেও আমি জেলাস হতাম না। মাঝখানে একজনের সঙ্গে উত্তমের সম্পর্ক বেশ দানা পাকিয়েছিল। কে সে, তা নিয়ে আমি বেশি কিছু বলব না। শুধু একদিন রমাদি উত্তমকে ডেকে বলেছিলেন “উতু এই সম্পর্কটা কোরো না। তোমার পক্ষে ভাল হবে না।”
রমাদির কথা শুনেই কিনা জানিনা, উত্তমের সেই সম্পর্কটার সমাধি হয়েছিল কিছুকালের মধ্যেই। আসলে রমাদি আর উত্তমের মধ্যে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্কটা অন্তত আমার ব্যাখার অতীত।”
সুচিত্রা সেনের অন্তর্বাসও স্মারক হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন ভক্তরা