
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দিনের শেষে ঘুমের দেশে পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ভাবছেন তো বর্তমানে তা কী করে সম্ভব?
আসলে, ‘মহালয়া’ ছবিতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের ভূমিকায় শুভময় চট্টোপাধ্যায়ের (Subhomoy Chatterjee) গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিনয় আজও ভোলেনি দর্শক। সুঅভিনেতা ও গায়ক শুভময় চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে সেই পঙ্কজ মল্লিকের চরিত্রের কথাই। শোকস্তব্ধ টলিপাড়া। অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘসময় দূরদর্শনে চাকরি করেছেন শুভময়। খাদ্যনালীতে ক্যানসারে ধরা পড়ে অভিনেতার। আজ, ১৪ জুন ২০২২ সকালে বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

চরিত্রাভিনেতার ছোট চরিত্রেই দেখা মিলত তাঁর। অনেক অকিঞ্চিৎকর চরিত্রেও কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু যে চরিত্র তাঁকে অমর করে রাখবে, তা ‘মহালয়া’র পঙ্কজ মল্লিক। সেই ‘মহালয়া’ ছবির পরিচালক সৌমিক সেন মুম্বাই থেকে করলেন শুভময় চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতর্পণ। শুনলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুম্বই নিবাসী পরিচালক হয়েও ‘মহালয়া’ ছবিতে শুভময় চট্টোপাধ্যায়-কে পঙ্কজ মল্লিকের রোলে নিলেন। বাংলার পরিচালকরা যে ঝুঁকি নেননি আপনি তা নিয়েছিলেন, কী করে?
খুব সত্যি! এ ব্যাপারটা আমাকেও ফেস করতে হয়েছিল। ‘মহালয়া’ ছবি প্রথমে যে সংস্থা প্রযোজনা করছিলেন, তাঁরা পঙ্কজ মল্লিকের ভূমিকায় শুভময় চট্টোপাধ্যায়কে একেবারেই চাননি। কারণ বেশিরভাগই দেখেন অভিনেতারা আগে কী বড় কাজ করেছেন। শুভময় বাবু সেই মাপের কাজ করার সুযোগ যেহেতু কখনওই পাননি, তাই তিনি প্রযোজকের পছন্দ ছিলেন না।

এমনকী সেই প্রযোজক বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর রোলে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কেও চাননি। কারণ লিড রোলে এঁদের নিয়েও যে ছবি হিট করানো যায়, তা তাঁদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। পঙ্কজ মল্লিক আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর রোলে তাঁরা আরও নামী মুখ চাইছিলেন। কিন্তু আমার প্রথম থেকেই পছন্দ ছিলেন শুভাশিসদা ও শুভময়দা। আমি আপস করিনি সেই প্রযোজনা সংস্থার কাছে। তাই সেই প্রযোজকের সঙ্গে এই ছবি করা হল না। তারপর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ‘মহালয়া’ ছবিটি প্রযোজনা করতে এলেন এবং উনি প্রথম থেকেই আমার পছন্দের কাস্টিংকে সমর্থন করেছিলেন। তাই ‘মহালয়া’ সম্ভব হল।
আপনার সঙ্গে শুভময় বাবুর প্রথম আলাপ কি ‘মহালয়া’ করতে গিয়ে?
না, তার অনেক আগেই। আমি ওঁর অভিনয় অনেক আগেই দেখেছিলাম। আমি যখন কলকাতায় এসেছিলাম, আগে জানতাম উনি দূরদর্শনে আছেন, ভাল অভিনয় করেন ইত্যাদি। বিভিন্ন সূত্রে আলাপ হয়েছিল ওঁর সঙ্গে।

কী দেখে মনে হয়েছিল এঁকে বাঙালির লেজেন্ড পঙ্কজ মল্লিকের রোলে মানাবে?
পঙ্কজ মল্লিকের রোলে শুভময়দাকে ভেবেছিলাম কারণ উনি নিজে ভীষণ ভাল গান করতেন। আজ করতেন বলতে হচ্ছে, খারাপ লাগছে। অসাধারণ গানের গলা। শুভময়দার ব্যক্তিত্বটা এই চরিত্রের সঙ্গে ভীষণ যায়। একসময় ইটিভি বাংলায় কোনও এক সরকারি চাকরি কেন্দ্রিক গল্পের টেলিছবিতে শুভময়দাকে দেখেছিলাম, অভিনয়ের মাঝে নিজেই নিজের গলায় ভাটিয়ালি গান গাইছেন। কী অপূর্ব! এমনকী আমাদের ‘মহালয়া’র শ্যুটিংয়ের ফাঁকেও উনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘তব অচিন্ত্য রূপ-চরিত-মহিমা’ একদম ক্লাসিকাল ঘরানার সুর ধরে গাইতেন। অসাধারণ! এসবের জন্য খুব মজা হতো, সমৃদ্ধ হতাম ওঁর সঙ্গে কাজ করে।

আমি মুম্বইয়ের লোক। তাই টলিপাড়ার অলিগলি সম্পর্কে খুব একটা অবগত নই। ‘মহালয়া’তে পঙ্কজ মল্লিকের রোলে যখন শুভময়দাকে কাস্ট করলাম তখন টালিগঞ্জ পাড়ার অনেকেই শুভময়দা সম্পর্কে আমাকে অনেক কথা বলেছিল। উনি খুব বেহিসাবি, অনিয়ন্ত্রিত, ফোন হারিয়ে ফেলেন– ইত্যাদি। ওঁকে দিয়ে কাজ করানো নাকি অসম্ভব। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি সেটা কখনও ফেস করিনি। কোনও দিন কলটাইমের দেরিতে আসেনি। প্রফেশনাল জীবনে উনি ভীষণ পারফেক্ট।
পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র– এই চরিত্রগুলোর লাইভ ডকুমেন্টেশন খুব একটা পাওয়া যায় না। পঙ্কজ মল্লিকের নাতি রাজীব গুপ্ত আমাদের খুব সাহায্য করেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিকের বাড়ি গিয়ে আমি আর শুভময়দা ওয়ার্কশপ করি।

আপনি ছাড়া শুভময় বাবুকে যোগ্য রোল আর কেউ দেয়নি?
আমার মনে হয়েছিল, এই রোলে উনিই যোগ্য। খুব গুণী মানুষ ছিলেন, কিন্তু ভাল কাজ ভাল সুযোগ খুব কম পেয়েছেন। আমি এটাও দেখি, যাঁরা শুভময় চট্টোপাধ্যায়ের দশ ভাগের এক ভাগও নন, তাঁরা টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি কাজ পান। তবে শুভময়দা যেহেতু দূরদর্শনে চাকরি করতেন, তাই বোধহয় ওঁর অভিনয় করার তাগিদটাও তেমন ছিল না। টুকটাক ভিলেন বা কমেডি রোলই ওঁকে দেওয়া হত। আমার আজ এটাই আফসোস হচ্ছে, শুভময়দার প্রতিভা ঠিকমতো ব্যবহার হল না। ব্যবহার করল না কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি। হয়তো উনি ঠিকমতো কানেকশন করতে পারেননি, তাই কাজ পাননি। প্রতিভার কদর ক’জন বোঝে? যেমন কাঞ্চনকে ‘মহালয়া’ তে নিয়েছিলাম। কারণ আমি বুম্বাদা বা যীশুর থেকেও কাঞ্চন মল্লিকের বেশি ফ্যান।

শুভময় বাবুর কোন দৃশ্য করে সবচেয়ে ভাল লেগেছিল?
যেখানে একজন রাজনৈতিক নেতা এসে বলছেন, ‘শাক্ত বংশের ছেলে আমি, অব্রাহ্মণ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে চণ্ডীপাঠ করা থেকে বাদ দিন।’ তখন পঙ্কজ মল্লিক রূপে শুভময় বাবু বলছেন, ‘শাক্ত ! এই যে কালো মেয়ের পায়ের তোলায় গানটা আপনি গাইছিলেন, গানটা কার জানেন? ব্রাহ্মণের তো নয়, কায়েতেরও নয়। মোল্লার বাচ্চা বাঘের বাচ্চা কাজী নজরুল ইসলামের। ওই মানুষ আর গোটা দশেক জন্মালে দেশের অবস্থাটাই পাল্টে যেত।’

উনি বলেছিলেন, এমন সংলাপ উনি আগে পাননি। আবার যখন নতুন মহালয়া বাজানো হলে রেডিওতে পঙ্কজ বাবুর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, সেই দৃশ্যগুলো শুভময়দা চূড়ান্ত ভাল করেছিলেন। ওঁর সেন্স অফ অবজারভেশান মারাত্মক ছিল। বিভিন্ন ডায়ালেক্ট, মিমিক্রি দুর্দান্ত করতেন।
‘মহালয়া’ রিলিজের পর শুভময় বাবু কতটা আপ্লুত ছিলেন?
নন্দনে যখন তৃতীয় সপ্তাহেও ‘মহালয়া’ হাউসফুল চলছিল, তখন শুভময়দা আর শুভাশিসদা একসঙ্গে এসেছিলেন। দুজনেই বলেছিলেন, ‘কোনও স্টারকে নয়, আমাদের দেখতে লোকে সিনেমাহল হাউসফুল করছে, এটা বিশাল পাওয়া।’

শুভাশিসদা তাও ‘হারবার্ট’ ছবিতে লিড রোল পেয়েছিলেন আগে। কিন্তু পোস্টারে, হোর্ডিংয়ে শুভময়দার ছবি– এমনটা ওঁর কাছে ছিল পরম পাওয়া।
শুভময়দাকে আগামী কোনও প্রজেক্টে নেবার ইচ্ছে ছিল?
হ্যাঁ। আমি ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’ বানানোর চেষ্টা করছি। ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে শুভময়দাকে ভেবেছিলাম। এই ছবিটাতে শুভাশিসদা আর শুভময়দা দু’জনকেই নেওয়ার কথা ছিল। ওঁদের দু’জনের সঙ্গেই কথা এগিয়েছিল। শুভময়দাকে মিস করব। তবে ইচ্ছে আছে ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’ বাংলা ছবি করার।
চুরাশি বছর বয়সে আঁকা শিখছেন ওয়াহিদা! নার্গিসের মেয়ে প্রিয়া দত্ত তাঁর দিদিমণি