শেষ আপডেট: 13th August 2023 12:30
তাঁরা দু'জনেই সুপারস্টার নায়িকা। একজন টলিপাড়ার প্রথমা আর এক জন বলিপাড়ার ডিভা (Sridevi)। যাঁদের নাম ও ছবি পোস্টারে থাকলে সিনেমাহল হাউসফুল হত দিনের পর দিন। দুজনেই ছিলেন বক্সঅফিস হিট নায়িকা। আজ তাঁরা নেই। দু'জনেরই জীবন অকালে ফুরিয়েছে রহস্যে ভরা বিতর্কিত মৃত্যুতে। অথচ আজও তাঁদের দু'জনেরই স্টারডম অটুট।
এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় মিল হল, দু'জনেই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটি পেয়েছেন তাঁদের অকালপ্রয়াণের পরপরই। দুই সময়ের দুই ঘরানার দুই অভিনেত্রীর মধ্যে এত জোরদার কাকতালীয় মিল সাধারণত দেখা যায় না। প্রথমজন টালিগঞ্জ পাড়ার দেবীমুখ নায়িকা, মহুয়া রায়চৌধুরী। আর দ্বিতীয় জনের নামেই দেবী। বলিউডের প্রথম সুপারস্টার নায়িকা, শ্রীদেবী।
বলিউডের ইতিহাসের দিকে তাকালে, শ্রীদেবীর আগে মধুবালা, নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা, হেমা মালিনী, রেখার মতো প্রথম সারির নায়িকারা এসেছেন, দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। কিন্তু বলিপাড়া ও দক্ষিণী ছবি মিলিয়ে শ্রীদেবীর বিশাল স্টারডমকেই প্রথম সুপারস্টার নায়িকার তকমা দেওয়া হয়।
শ্রীদেবী কিন্তু শুরু থেকেই এত সুন্দরী ছিলেন না। নিজেকে ঘষেমেজে অনন্য গ্ল্যামারে নিজেকে ঋদ্ধ করে, 'রূপ কি রানি' হয়ে ওঠেন তিনি। শ্রীদেবীর ছিল অভিনয় ট্যালেন্ট ও নৃত্যে তালিম, যা শিশু বয়স থেকেই তাঁকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসে। শ্রীর জন্মনাম শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গের আয়্যাপান। শ্রীদেবীর জন্ম ১৩ আগস্ট ১৯৬৩ সালে শিবাকাশী, তামিলনাড়ুতে। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র 'কানদান কারুনাই', ১৯৬৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল। ষাটের দশক জুড়ে এবং সত্তরের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শ্রীদেবী অনেক তামিল চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন।
মহুয়ার জন্ম কিছু আগে, ১৯৫৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাড়ির নাম ছিল শিপ্রা। কিশোরী শিপ্রা তখনকার কলকাতায় সোনালি রায় নামে খ্যাত হয় নাচের জলসাগুলোতো। কিছুটা ছোট থেকেই সংসারের চালিকাশক্তি ছিল সে। এর পরে তরুণ মজুমদারের হাত ধরে মহুয়া হয়ে একের পর এক ছবিতে সুপারহিট নায়িকা। টলিউডের জন্য মহুয়াকে গড়ে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায় আর মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো দুই নায়িকা। 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' জায়া রূপে মহুয়ার প্রথম আত্মপ্রকাশ। কিন্তু 'দাদার কীর্তি'র সরস্বতী যে কোন অভিমানে ত্রিশ না পেরোতেই বিদায় নিলেন, তা আজও রহস্য। সোনার প্রতিমা মহুয়া অগ্নিদ্গ্ধা হন এক বর্ষার রাতে। ক্যালকাটা হসপিটালে চিকিৎসা করেও শেষরক্ষা হয় না। ২২ জুলাই ১৯৮৫। অঝোর শ্রাবণে প্রতিমার বিসর্জন মানতে পারেনি সারা বাংলা।
১৯৭৬ সালের তামিল চলচ্চিত্র 'মুনড্রু মুদিচ্চু' শ্রীদেবী অভিনীত তামিল চলচ্চিত্র, যে ছবি দিয়ে তাঁর নায়িকারূপে অভিষেক হয় দক্ষিণে। তামিল চলচ্চিত্র শিল্পের খ্যাতিমান পরিচালক কৈলাস বলচন্দ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটিতে তখনকার তরুণ অভিনেতা কমল হাসন এবং রজনীকান্ত অভিনয় করেছিলেন। এর পরে ১৯৭৫ সালের 'জুলি' ছবি ছিল শ্রীর অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি, যাতে শ্রীদেবী একজন কিশোরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। শ্রীদেবী অভিনীত তামিল ছবির হিন্দি নির্মাণ 'সোলভা সাওয়ান' ছবি দিয়েই শ্রীর বলিউড অভিষেক হয়। কিন্তু ছবিটি ফ্লপ করে।
শ্রীদেবীর বলিউড অভিষেকে রেখার অবদান অপরিসীম। 'হিম্মতওয়ালা' ছিল শ্রীদেবীর প্রথম বক্সঅফিস হিট ছবি, জিতেন্দ্রর বিপরীতে। তামিলভাষী শ্রীদেবীর কণ্ঠ 'হিম্মতওয়ালা' ছবিতে ডাবিং করে দিয়েছিলেন রেখা। বলিউডের সুপারস্টার গোল্ডেন নায়িকা 'নয়নো মে সপনা' শ্রীদেবীকে ভালবেসে ফেলল দর্শক। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হিন্দি শিখলেন শ্রীদেবী। চাঁদনির রোলে রেখাকে প্রথম অফার দেন যশ চোপড়া। রেখা করবেন না বলে ফিরিয়ে দেন। তিনিই যশ চোপড়াকে বলে দেন, চাঁদনির রোলে শ্রীকেই নেওয়া হোক, সাদা পোশাকে অপূর্ব লাগবে তাঁকে। তাই হয় শেষমেশ।
বাকিটা ইতিহাস। হাওয়া-হাওয়াই গানের সোনালি মুকুটটাই শ্রীদেবীর নামের সঙ্গে আইকনিক হয়ে গেল। 'সদমা'র নিষ্পাপ মেয়েটি একদিন হয়ে উঠল 'ইংলিশ ভিংলিশ' জয় করা শ্রেষ্ঠ 'মম'। তাঁর এই সমস্ত কামব্যাক ছবিতেও সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। হেমা, রেখা বা মাধুরীও এতটা জনপ্রিয়তা পাননি জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসে।
দুবাইতে আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে মজা-হাসি করেই তো সময় কাটছি শ্রীদেবী ও বনি কাপুরের। সব মজা শেষ হয়ে গেল বাথটবের জলে। সেখানেই চিরঘুমে চলে গেলেন শ্রীদেবী। তিনি নাকি দেওর অনিল কাপুরের কন্যা সোনম কাপুরের বার্থডে গিফট আঁকছিলেন, সোনমেরই ছবি। কিন্তু সে ছবি শেষ হল না। ৫৪ বছরে ফুরিয়ে গেল জীবন। বিস্তর জলঘোলা হয় এর পরে।
বাথটাবে আর কত জল থাকে যে শ্রী উঠতেই পারলেন না! অবশ্য ময়নাতদন্তে জানা গেল, শ্রী নেশাগ্রস্ত ছিলেন। মদে চুর হয়েই নাকি জলে ডুবে, দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু। বনি কাপুরই প্রথম উদ্ধার করেন স্ত্রীর দেহ। তার পরে বিতর্কের পাহাড়। রূপ ধরে রাখতে হরমোন ট্রিটমেন্ট, কসমেটিক সার্জারি, মানসিক অবসাদ, নাকি পারিবারিক অশান্তি-- সন্দেহের তির সবদিকেই ছড়িয়ে যায়।
সে যাই হোক, বলিউডের ইতিহাসে কিন্তু 'রূপ কি রানি' একজনই থাকবেন। স্বপ্নের দেশের স্বপ্নের নায়িকা আজও তিনিই। শ্রীদেবী তাঁর মৃত্যুর পরে পান সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার, 'মম' ছবির জন্য। যা ছিল শ্রীদেবীর কেরিয়ারে প্রথম জাতীয় পুরস্কার। কিন্তু পুরস্কারের পাশে মরণোত্তর শব্দটুকু রয়ে গেল কেবল। শ্রীদেবী চলে গেছেন।
এই পুরস্কার প্রাপ্তি দেখে যেতে পারেননি তিনি। অজস্রবার ফিল্মফেয়ার বা অন্য পুরস্কার পেলেও জাতীয় পুরস্কার এই প্রথম। শ্রীদেবীর হয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে এই পুরস্কার নিয়েছিলেন স্বামী বনি কাপুর ও দুই কন্যা। 'মম' ছবিতে শ্রীদেবীর পারফরম্যান্স বুঝিয়ে দেয়, তিনি কতটা ভাল অভিনয় জানা দক্ষ অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু সেই সাফল্য উপভোগ করতে পারলেন না শ্রী।
মহুয়া রায়চৌধুরীর শেষের দিকে ভাল ছবির প্রস্তাব এসেছিল। অপর্ণা সেন তাঁর ছবি 'পরমা'তে কাজও করান মহুয়াকে। কিন্তু এডিটিংয়ে বাদ যায় মহুয়ার অংশ। টাইটেল কার্ডে মহুয়ার নাম থেকে যায়। এর পরে তপন সিনহা মহুয়াকে ডেকে পাঠান তাঁর ছবি 'আদমি অউর অউরত'-এর জন্য। কিন্তু তখনকার পৃথুলা মহুয়াকে দেখে তপন সিনহা রিজেক্ট করেন। মহুয়ার কাছে এমন একটা আর্ট ফিল্মে নায়িকা হওয়া ছিল স্বপ্ন। তাই তিনি তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন তপন সিনহার কাছে, রোগা হবেন বলে।
শোনা যায়, তিন সপ্তাহ পরে তপন সিনহা তাজ্জব বনে যান মহুয়ার ডেডিকেশন দেখে। নিজেকে আমূল বদলে ফেলেন মহুয়া। সে ছবিতে অমল পালেকরের বিপরীতে প্রায় নির্বাক অভিনয়ে তাক লাগিয়ে দেন মহুয়া। ১৯৮৪-তে মুক্তি পায় 'অদমি অউর অউরত'। মহুয়ার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকমহলে দাগ কাটে।
কিন্তু এর ঠিক পরের বছরেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এর দু'বছর পরে, ১৯৮৭ সালে পঞ্চম আন্তর্জাতিক দামাস্কাস ফিল্ম উৎসবে 'অদমি অউর অউরত' ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান মহুয়া। মহুয়ার সঙ্গে নমিনেশনে নাম ছিল শাবানা আজমির। তবু মহুয়াই পান পুরস্কার। তপন সিনহা বলেছিলেন, "কে বলবে শাবানা বা স্মিতার চেয়ে মহুয়ার অভিনয় ক্ষমতা বা পারফরম্যান্স কোনও অংশে কম!"
শ্রীদেবীর মতোই মহুয়ার এই পুরস্কারের পাশেও থেকে যায় মরণোত্তর শব্দটি। মহুয়ার কেরিয়ারে সবচেয়ে খ্যাতির পুরস্কার ছিল এটি, যা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয় সংবাদপত্র, ফিল্ম ম্যাগাজিনে। তাঁর সেই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পরিচালক তপন সিনহার কাছেই রয়ে গেল। মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী বা মহুয়ার স্বামী তিলক চক্রবর্তী-- কেউই মহুয়ার হয়ে নিতে আসেননি এই পুরস্কার। অভিমান, অবহেলা নাকি আশঙ্কা! উত্তর আজও অজানা রহস্যে আবৃত।
মহুয়া ও শ্রীদেবী দু'জনেই বাণিজ্যিক ছবির সুপারস্টার নায়িকা। কিন্তু প্রতিযোগিতার আবহে পুরস্কার অবশ্যই একটা মাপকাঠি। সেটি না পেলে নায়িকাদের অনেক গুণই ফিকে হয়ে যায়। শ্রীদেবী আর মহুয়া দুজনেই স্বল্প জীবনে বারবার প্রমাণ করেছেন নিজেদের। দর্শকদের মনের মণিকোঠায় তাঁরা চির উজ্জ্বল। জনপ্রিয়তা হোক বা প্রশংসা-- তাঁদের কম পড়েনি কিছুই। এমনকি জীবনের সেরা পুরস্কারও এল, তবে ততদিনে কম পড়ে গেল জীবন।
এই প্রাপ্তি এবং কমতিটুকুর কান্নাই বোধহয় চিরকাল জুড়ে রাখবে দেশের দুই প্রান্তের, দুই সময়ের, দুই সেরা অভিনেত্রীকে।
শ্রীদেবী চলে গেছেন, বনির সঙ্গে তাঁর প্রেম আজও চর্চায়! দেখুন তাঁদের অদেখা ছবি