
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সুখী গৃহকোণ থেকে ‘বাংলার মুখ’ কর্পোরেট অফিস, ডিঙ্কার চিকিৎসা থেকে দিঠিকে উদ্ধার সব সামলে শ্রীময়ী আজও অনন্যা, ‘শ্রীময়ী’ সিরিয়াল পার করল ৬০০ পর্ব। যখন ‘শ্রীময়ী’ লঞ্চ করা হয় তখন এক বছরের স্লটে সিরিয়ালটি শেষ করার কথা ভাবা ছিল কিন্তু দর্শকধন্য এই সিরিয়াল এক বছর পেরিয়ে দু বছরের পথে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। ‘শ্রীময়ী’ র মতো একটা রিয়্যালিস্টিক গল্প প্রাইম টাইমে টেলিভিশনের দর্শকরা বিশেষ করে সববয়সের সবশ্রেণীর মহিলারা যেভাবে দেখে আপ্লুত তা নজিরবিহীন। মহিলারা নিজেদের সঙ্গে সিরিয়ালটা রিলেট করতে পারেন।
সব থেকে বড় বিষয়, এক বাঙালি লেখিকার গল্প নিয়ে ছটি সর্বভারতীয় ভাষায় শ্রীময়ীর রিমেক হচ্ছে বিভিন্ন সর্বভারতীয় চ্যানেলে। হিন্দিতে শ্রীময়ীর রিমেক অনুপমা তো বিশাল জনপ্রিয়। এছাড়াও শ্রীময়ী রিমেক হচ্ছে মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালাম ভাষায়। আসল ভাবনাটি কিন্তু ছিল এক বাঙালি নারীর তিনি টেলিভিশনের সরস্বতী শ্রীমতী লীনা গঙ্গোপাধ্যায়।
মাঝে একটা রটনা রটেছিল ‘শ্রীময়ী’ শেষ হয়ে যাবে গত এপ্রিল মাসে। গল্পের গতি দেখে তাই ভেবেছিল দর্শকরা। কিন্তু সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ শ্রীময়ীর ৬০০ পর্বের সাংবাদিক সম্মেলনে লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় দুই পরিচালক স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শ্রীময়ী এখন শেষ হচ্ছে না। বরং আরও অনেকদিন চলবে শ্রীময়ী।
আসুন জেনে নিই, আজ সাংবাদিক সম্মেলনে শ্রীময়ী ইউনিটের সবাই কী কী বললেন।
অভিজাত স্কুলের টির্চাস রুম থেকে কাজের মাসিদের ঘর, সব শ্রেণির মহিলাদের প্রাণের আরাম: ইন্দ্রাণী হালদার (শ্রীময়ী)
আমি আগে একটি সিরিয়ালে লিড ক্যারেক্টার করতাম। সেই সিরিয়াল করতে করতে হঠাৎ দেখলাম আমার প্রধান চরিত্র থেকে স্টোরিলাইন সরে গেল। আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হই চ্যানেলের উপর। তাই যখন ‘শ্রীময়ী’ শুরু হয় লীনাদিকে বলেছিলাম সিরিয়াল করে এই অভব্যতার ভুক্তভোগী আমি। তখন লীনাদি আমায় আশ্বাস দিয়েছিলেন ‘আমি কথা দিচ্ছি আমার উপর ভরসা রাখো, শ্রীময়ী তোমায় নতুন ডায়মেনশান দেবে।’
সত্যি তাই আজ ছশো এপিসোড পার করে শ্রীময়ী যে রেকর্ড তৈরী করেছে তা আমার, লীনাদির এবং সবার কেরিয়ারে মাইলফলক। সব শ্রেণির দর্শকরা শ্রীময়ী ভক্ত। কিন্তু আমার আবার দিঠির গল্পের নতুন মোড়টাও ভাল লাগছে, যেখানে নবীন প্রজন্মের গল্পও বলছেন লীনাদি এবং শৈবালদা।
অনেকেই বলেন শ্রীময়ী যেন একটু বেশি ভাল। আচ্ছা শ্রীময়ী যদি খুব প্রতিবাদী মূর্তি ধারণ করে তখন আপনাদের কি ভাল লাগবে? তখন আপনারাই বলবেন আগের শ্রীময়ী ভাল ছিল। ভাল গুণ, মহত্ব এগুলো দেখানো হলে খুব কি খারাপ!
জুনকে খুব মিস করছি। জুন আবার ফিরুক। আমাদের সেই হাড্ডাহাড্ডি ডায়লগগুলো আবার বলতে চাই। আর একটা কথা বলি লীনাদিকে, ‘লীনাদি, আমার নিজের জীবনেও একটা রোহিত সেন চাই। যে বন্ধু যে অভিভাবক যে ভরসার আরেক নাম।’
সোশ্যাল মিডিয়ার দর্শকরা আমার লেখা শ্রীময়ী নিয়ে কটুক্তি করলে আমার কিছু এসে যায় না। আমি ফেসবুকের লোকেদের নেগেটিভ কমেন্ট ধর্তব্যের মধ্যেই ধরি না: লীনা গঙ্গোপাধ্যায় (চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক)
শ্রীময়ী এই করোনা আবহের মধ্যেও যে আমরা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছি সেটা আমাদের সবার কৃতিত্ব। অনেক সিনিয়র শিল্পীদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের প্রোটেকশান দিয়ে কাজ করাতে হয়। যেমন অশোকদা, চিত্রাদি ভীষণ ভাবে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এতকিছু প্রোটোকল মেনে আমরা ছশো পর্ব পার করলাম। শ্রীময়ী এখন বন্ধ হচ্ছে না। প্রযোজক, চ্যানেলের টিআরপি চাইছে আরও এগোক শ্রীময়ী। আমরা টিআরপি ২ থেকে ১২, ১৪-তে পৌঁছেছি।
অনেকেই বলেন দেখি, শ্রীময়ীর কি বিয়ে হবে রোহিত সেনের সঙ্গে? আমার দেখা ডির্ভোসী মধ্যবয়সী মহিলাদের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে গল্পই শ্রীময়ী। তাঁর বিয়ে দেওয়ার কি খুব দরকার? পাশে থাকা, ভরসা, নির্ভরতা কি বন্ধুত্বে গড়ে ওঠে না? সব নারী পুরুষের সম্পর্কর পরিণতি কি বিয়েতেই?
সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব ট্রোল চলছে সেগুলো তো বলব শ্রীময়ীর জনপ্রিয়তার ফসল। লোকে না দেখলে ট্রোল বানাচ্ছে কী করে? আর সোশ্যাল মিডিয়ার দর্শকরা আমার লেখা শ্রীময়ী নিয়ে কটূক্তি করলে আমার কিছু এসে যায়না। আমি ফেসবুকের লোকেদের নেগেটিভ কমেন্ট ধর্তব্যের মধ্যেই ধরি না। এরা শুধু সমালোচনাই করতে পারে। শ্রীময়ীর দর্শক শুধু এরা নন। অনেকেই আছেন যারা ফেসবুক করেন না। আবার যারা সমালোচনা করছেন তাঁরা দেখছেন বলেই তো করতে পারছেন। শ্রীময়ী চলছে চলবে।
শ্রীময়ী র মতো রিয়্যালস্টিক গল্প টেলিভিশনের দর্শক নেবে ভাবিনি: শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় (পরিচালক)
লীনাদি আমায় যখন শ্রীময়ীর ভাবনাটা বলেন, আমি ভেবেছিলাম এরকম বাস্তব ঘটনা ফিল্ম করলে ভাল। ডেলিসোপ করলে চলবে না হয়তো। কারণ অবাস্তব ঘটনাই বেশf চলে টিভিতে। যে কারণে ‘গানের ওপারে’র মতো অন্যধারার সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার ভাবনা নস্যাৎ করে শ্রীময়ীর মতো বাস্তববাদী গল্প রমরমিয়ে চলছে। তার মানে বাস্তব গল্প ঠিক ভাবে দেখালে সেটাও টেলিভিশনে জনপ্রিয়তা পায়, ‘শ্রীময়ী’ প্রমাণ করল।
‘শ্রীময়ী’র মধ্যে আমার মাকে দেখতে পাই: সুদীপ মুখোপাধ্যায় (অনিন্দ্য সেনগুপ্ত)
“আজ থেকে পাঁচ-ছ বছর আগে স্টার জলসার একটি অনুষ্ঠানে আমি সঞ্চালক ছিলাম আর মঞ্চে উপবিষ্টা ছিলেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। মঞ্চ থেকে আমি লীনাদিকে বলেছিলাম ‘লীনাদি আমি কখনও আপনার সিরিয়ালে কাজ করতে পারলে ধন্য হব।’ এতদিনে আমার স্বপ্ন সত্যি হল।
শ্রীময়ীতে যত অভিনয় করছি শ্রীময়ীর মধ্যে আমার নিজের মাকে দেখতে পাচ্ছি। আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন সংসারের জন্য। শ্রীময়ী তো এই মায়েদের গল্প। লীনাদি আমার নিজের স্ত্রীকে অনেকবার বলেছেন, ‘পৃথা বাড়িতে বসে আছো কেন, অভিনয় কর।’ আমি লীনাদিকে বলেছি, ‘লীনাদি, পৃথা বাড়িটা সামলায় বলেই আমি কাজে বেরোতে পারি। সংসারের কাজটা কাজ নয় বলে আমি ভাবি না। যদিও অনিন্দ্য উল্টোটাই ভাবে। কিন্তু অনিন্দ্য ভীষণ বাস্তব চরিত্র।’
রোহিত সেনের চরিত্র করে দু-দুটো বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি: টোটা রায়চৌধুরী (রোহিত সেন)
শ্রীময়ী আমার কেরিয়ারের বাঁকবদল। একটা সিরিয়ালের চরিত্র করে ঘরেঘরে রাতারাতি হিরো বনে যাব, তাও এই বয়সে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ করে আমায় নিয়ে সবাই আলোচনা করত। তারপর দীর্ঘ সময় সব মাধ্যমে আমি কাজ করলেও রোহিত সেনের মতো দর্শক ফিডব্যাক পাইনি। তাঁর জন্য আমি লীনাদি-শৈবালদার কাছে কৃতজ্ঞ। একজন বাঙালি মহিলার লেখা সিরিয়াল ছ’টা সর্বভারতীয় ভাষায় রিমেক হচ্ছে সেটা কম গর্বের কথা নয়।
আরেকটা মজার কথা বলি, আমি আমার প্রথম যৌবনে এত রমণী হৃদয়ের হার্টথ্রব হয়ে উঠিনি, যা রোহিত সেন করে হলাম। সবচেয়ে আশ্চর্য, দুজন মহিলা তো আমার মতো বিবাহিত এক পুরুষকেও বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।
লীনা গঙ্গোপাধ্যায় যোগ করলেন “আসলে টোটা এখন দর্শকের চোখে এলিজেবল ব্যাচেলার রোহিত সেন। একটা সত্যি ঘটনা বলি, আমার কাছে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী এবং একজন নামী সাংবাদিক এসে বলেছেন, আমরা রোহিত সেনের সঙ্গে দেখা করতে চাই রোহিতদা আমাদের স্বপ্নপুরুষ।”
সিরিয়াল লিখলেও নাটককে সম্মান করেন লীনাদি: সপ্তর্ষি মৌলিক (ডিঙ্কা)
আমি ‘নান্দীকার’ নাট্যগোষ্ঠী থেকে অভিনয় জীবন শুরু করি। তাই মঞ্চ আমার মা। কিন্তু সিরিয়াল করতে গেলে নাটক করার সময় পান না অনেকেই। সেটার ভুক্তভোগী আমিও হই শুরুতে। অনেক পরিচালক আমায় ছাড়েননি আমার নাটকের শো থাকলেও। কিন্তু লীনাদির সঙ্গে প্রথম দেখায় আমি বলেছিলাম যে আমায় বিকেলের পর ছাড়তে হবে নাটকের শো থাকে। লীনাদি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই নাটক থাকলে তোমায় ছেড়ে দেব।’
অচেনা একটি নিউকামার ছেলের চোখে সেদিন লীনাদি শ্রদ্ধার স্থানে চলে যান। ইন্দ্রাণীদিও মাছ রান্না করে আনেন আমার জন্য। আবার চিত্রাদির সঙ্গে নাটকের গল্প করি। নাটকের মতো সিরিয়ালেও একটা পরিবার গড়ে ওঠে।
জুন সিরিয়ালে ভ্যাম্প নয়, পরিস্থিতির শিকার: উষসী চক্রবর্তী
জুন অনিন্দ্যর জীবনে দুসরি অউরত, সিরিয়ালের নেগেটিভ চরিত্র, কিন্তু জুন আসলে পরিস্থিতির শিকার। জুনের মতো মেয়েরাও সমাজে আছে। যারা বিবাহিত পুরুষদের ভালবাসার সাহস দেখায়, কষ্টও পায়। জুনের চরিত্রে অনেক শেডস আছে। তাই জুন আমার জীবনে একটি প্রিয় চরিত্র। জুন অনেকদিন নেই সিরিয়ালে। কিন্তু লীনাদি কথা দিয়েছেন, জুন আবার ফিরবে সিরিয়ালে। আবার হবে জোর টক্কর শ্রীময়ী-জুনের।
জুন গুহ বক্তব্য তাড়াতাড়ি শেষ করলেন, কারণ তিনি এই করোনা আবহে অক্সিজেন সরবরাহ করছেন অসুস্থ রোগীর পরিবারদের। টেলিভিশনের পর্দায় জুন ভ্যাম্প হলেও বাস্তব জীবনে জুন জীবনদায়িনী। উষসীর আর এক অর্থ যে ভোর। কোভিডের অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন জুন গুহ।