Latest News

বাংলা ছবির দোলের দলিল, ফাগুনে-আবিরে-প্রণয়ে-বিরহে রুপোলি পর্দায় রঙের বাহার

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৩৭ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ ছবি। অভিনেত্রী কানন দেবী নিজের কণ্ঠে গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’। বাংলা ছবির ইতিহাসে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই প্রথম জনপ্রিয় দোলের গান বলে মনে করা হয়। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ‘মুক্তি’র নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার মুখে প্রচুর পাউডার মাখিয়ে, গায়ে রঙিন উত্তরীয় দিয়ে সুর আর গ্ল্যামারের জাদুতে সাদা-কালো ছবিতে যেন সেদিন ফাগের রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কাননবালা।

এরপর ১৯৫৬ সালের ছবি দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘নবজন্ম’। উত্তম-অরুন্ধতী-সাবিত্রী। ছবিতে ঘরজামাই উত্তমকুমার গানপাগল যাত্রাশিল্পী আর অরুন্ধতী দেবী তাঁর শালার স্ত্রী। অরুন্ধতীকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধিকার রূপ বর্ণনার গান শুনিয়েছেন উত্তমকুমার এবং গানটি উত্তম কুমারের নিজকণ্ঠে। এ গানকে দোলের অনুষঙ্গ গান বলাই চলে। গান শেষে অরুন্ধতী বলেন, ‘উঠি ঠাকুরপো, সামনে দোল আসছে, ওই দিন সকালে তোমার দোলের গান শুনব’। যদিও সেই দোলের গান ছবিতে দেখানো হয়নি।

১৯৬৩ সালে অসিত সেনের ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠে বাঈজি পান্নাবাঈ সুচিত্রা সেন গাইলেন ছবির শুরুতেই একখানি ঠুমরি, ‘কৌন তারাহ সে তুম খেলাত হরি’। গানের কথায় উঠে এল হোলি খেলার কথা।

১৯৬৫ সালের ছবি ‘মুখুজ্জ্যে পরিবার’। দুই বোন সুলতা চৌধুরী আর লিলি চক্রবর্তী গেয়ে উঠলেন দোলের গান, ‘আবিরে রাঙালো কে আমায়।’ কণ্ঠে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মলা মিশ্র।

বাংলা ছবিতে পুরোপুরি দোলের গান নিয়ে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তরুণ মজুমদার। ১৯৬৭-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’।  ‘লাগ লাগ লাগ লাগ রঙের ভেল্কি লাগ, পরানে লেগেছে ফাগুয়া’। কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গাইলেন হেমন্ত ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। ‘বালিকা বধু’ সুপার ডুপার হিট এবং এই গান বঙ্গজীবনের অন্যতম দোলের গান হয়ে রইল। যদিও বর্তমানে এই ছবির প্রিন্ট পাওয়া যায় না। ‘বালিকা বধূ’ হিন্দিও বানিয়েছিলেন তনু বাবু, সেটা অবশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা ছবিটার নস্ট্যালজিয়া আলাদা।

এর পরে ১৯৬৮ সালে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ছবি ‘হংস মিথুন’-এ নবীন প্রজন্মের জুটি শুভেন্দু-অপর্ণা হাত ধরে গাইলেন হেমন্ত-সন্ধ্যা কন্ঠে ‘আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি, কেউ জানে না সে কোন কথা মন কে আমি বলি।’ কী অপূর্ব গানের কথা লিখলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুর বাঁধলেন অদ্বিতীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

১৯৬৯ সালে বিকাশ রায় পরিচালিত ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ‘বাঁধো ঝুলনা’। মাথায় ঘোমটা দিয়ে শাল গায়ে তানপুরা হাতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের লিপে এই গান। সঙ্গে স্ক্রিনে সারেঙ্গীতে পাহাড়ি সান্যাল। সাবিত্রীর বিপরীতে নায়ক বসন্ত চৌধুরী।

এর পর আবার সাবিত্রী-সন্ধ্যা জুটি দোলের গান, ১৯৭০-এ অগ্রদূতের পরিচালনায় ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছবিতে। নটী সাবিত্রী জমিদার বাড়ি গান গাইতে এসছেন নটী মায়ের সঙ্গে। ঘটনাচক্রে সেই জমিদারবাড়ি সাবিত্রীর বাবার বাড়ি। অথচ সেই মেয়ের পিতৃত্ব স্বীকার করেননি আসল বাবা। স্ত্রীকে স্ত্রীর সম্মান না দিয়ে বাঁধা মেয়েমানুষ করতে চেয়েছিলেন। তাই কীর্তন গান গেয়ে স্বামী সংসার ত্যাগ করে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন স্ত্রী। আজ সেই স্বামীর বাড়িতেই গান গাইতে বায়না পেয়েছেন এত যুগ পর। সেখানে ঠাকুরদালানে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে বসে  মাকে সঙ্গে নিয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হোলির গান গাইছেন- ‘আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে’। সামনে বসে ও বাড়ির জামাই উত্তম কুমার। গানটি লিখেছিলেন এ ছবির কাহিনীকার ও সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। সুর দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত।

এবার আবার দোলের আইকনিক গান এল বাংলা ছবির বাজারে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পেল পরিচালক দীনেন গুপ্তর রোম্যান্টিক-কমেডি, ‘বসন্ত বিলাপ’। ‘বসন্ত বিলাপ’ মহিলা মেসের মেয়েরা দোলের দিন রঙ খেলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে উঠল ‘ও শ্যাম যখন তখন, খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না’। সুধীন দাশগুপ্তর সুরে গাইলেন আরতি মুখার্জী ও সুজাতা মুখার্জী। লিপ দিলেন অপর্ণা সেন, কাজল গুপ্ত, সুমিত্রা মুখার্জী, শিবানী বসুরা। নিখাদ পাড়া কালচার উঠে আসে ছবিতে। মেয়েদের মেসের জানলায় রবি ঘোষের উঁকি মারা, , মেয়েদের হস্টেলে ঢোকা চিন্ময় রায়কে রঙচান থেকে মেসের বারান্দার উপর থেকে অনুপ কুমারের  মাথায় রঙের বালতি ঢেলে দেওয়া অপর্ণা সেনের। আর সৌমিত্র চ্যাটার্জীর রঙের বাজারে বীরপুরুষ হিরো সেজে ঘুরে বেড়ানো। মনের রঙ বিনিময় হয়ে যায় দোলের রঙে।

১৯৭৮ সালে দীনেন গুপ্তর ছবি ‘তিলোত্তমা’তে ‘রঙ শুধু দিয়েই গেলে আড়াল থেকে অগোচরে’ গানে মান্না দে ও অরুন্ধতী হোম চৌধুরী। লিপ দিয়েছিলেন রঞ্জিত মল্লিক ও কল্যাণী মণ্ডল। আর আড়ালে ছিলেন রঞ্জিতের অবহেলিতা কালো বউ সুমিত্রা মুখার্জী। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৭৮ সালে আসে আর এক ছবি ‘জব চার্নকের বিবি’। দোলের গান ব্যবহার হল প্রথম রঙিন বাংলা ছবিতে। জব চার্নকের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। জব চার্নক যেদিন সুতানুটি গ্রামে এসে পা রাখলেন সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। নর্তকী আরতি ভট্টাচার্য এসে সাহেবের গাল দুটি রাঙিয়ে দিলেন আবিরে। আরতি ঘাঘরা পরে রং খেলতে খেলতে গৌরী শ্রীমাণির কণ্ঠে নেচে ওঠেন, ‘সাহাব যদি হত শ্যাম এমনি করেই রঙ মাখাতাম …হোলি এলো রে হোলি এলো রে’।

জব চার্নকের বায়োপিক ছবি বলাই যায় এটিকে। যদিও ছবিটার প্রিন্ট মেলে না আজ। ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে জয়ন্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত ছবি ‘জব চার্নকের বিবি’।

১৯৭৫ থেকেই হোলির গানে পরিবর্তন এল, যখন বলিউডে ‘শোলে’ ছবি রিলিজ করল। মিউজিকে একটা দুরন্ত চেঞ্জ এল। রাহুল দেব বর্মণের আইকনিক হিট গান ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়’ দিয়েই ঘরে বসে হোলির গান নেমে এল পাড়ার রাস্তায়। শুধু হিরোরাই নয়, হিরোইনরাও রাস্তায় নাচতে থাকলেন। এভারগ্রিন গানকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু সেই প্রভাব পড়ল বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনেও। ওই ঘরানা নকল করে ছবি হিট ফর্মুলা শুরু হল। সেগুলো তুমুল হিট।

১৯৭৮-এ এল উত্তম কুমারের লিপে রঙিন ছবিতে হোলির গান, আলো সরকার পরিচালিত ‘বন্দী’ ছবিতে। বাংলা ও হিন্দি ডবল ভার্সান এই ছবিতে  সুর দিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, গান লিখেছিলেন-ইন্দিবর। আশা ভোঁসলে ও কিশোর কুমারের গাওয়া- ‘মনে রঙ না লাগলে তবে, এ হোলি কেমন হোলি’ গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন সুলক্ষনা পণ্ডিত ও উত্তম কুমার। ছবি ফ্লপ করলেও গানগুলো সুপারহিট শ্যামল মিত্রর সুরের গুণে। উত্তমকে অত রঙচঙে পোশাকে আর মেকআপে বাঙালি নেয়নি।

১৯৭৯ সালে সুশীল মুখার্জীর ছবি ‘বনবাসর’-এ এল হোলির গান, অধীর বাগচীর কণ্ঠে সমিত ভঞ্জর লিপে ‘রাঙা আবিরে রাগে প্রিয়’ বেশ শ্রুতিমধুর।

১৯৮০-তে মুক্তি পেল তরুণ মজুমদারের মাইলস্টোন রঙিন ছবি ‘দাদার কীর্তি’। যা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল ওই বছর ঘটে যাওয়া মহানায়কের মহাপ্রয়াণের শোক। শিমুলতলার পথে নব্য তরুণরা প্রভাতফেরি করে আবির ছুড়তে ছুড়তে গেয়ে উঠল দোলপূর্ণিমার সকালে ‘”ললিত-রঙ্গে রস-তরঙ্গে প্রাণের সঙ্গে হোলি খেলো, কুমকুম ফাগে রাঙা অনুরাগে অন্তর মন ভরে তোলো”…হেমন্ত সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখার্জী নিজে, শক্তি ঠাকুর ও অন্যান্যরা।

দৃশ্যায়নে ছিল সন্ধ্যা রায়ের সলাজ মুখ, বহুদিন পর দোলে গ্রামের বাড়িতে আসা স্বামী শমিত ভঞ্জর জন্য। বিহারি আর বাঙালি ঘরানাকে এক করে কী অদ্ভুত সুর বেঁধেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তেমনই দৃশ্যায়ন তরুণ মজুমদারের হাতে। এক ঝাঁক নবীন নায়ক নায়িকা তাপস, দেবশ্রী, কৌশিক উঠে এলেন এ ছবি দিয়ে। সঙ্গে মহুয়া রায়চৌধুরী ও অয়ন ব্যানার্জী। আর অতি অবশ্যই দোলের গানের রংমশাল ভোম্বলদা অনুপ কুমার।

১৯৮০-তে অজয় বিশ্বাসের ‘ভাগ্যচক্র’ সাদাকালো ছবিতেও ছিল দোলের মন ছোঁওয়া গান, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে, হেমন্ত-আরতি কণ্ঠে ‘আবিরে আবিরে এসো আজ খেলি হোলি, না বলা যত কথা রঙে রঙে বলি’।

১৯৮২-তে মুক্তি পাওয়া পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘রাজবধূ’ ছবিতে হেমন্ত সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয় ‘আজো রঙ্গ খেলত মেরে রঙ্গলাল’। মুনমুন সেনকে যেন শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমতীই লেগেছিল এই গানে আবির মেখে।

যখন বাংলা ছবি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যুগ পার করল তখন থেকেই বাঙালি সংস্কৃতি অনেকটাই বদলে গেল রুপোলি পর্দায়। দোলের গানের কোমলতা, সরলতা যেন কমে গেল। আর ডি বর্মনের হাত ধরে বলিউড প্রভাব এসে গেল বাংলা ছবিতে। অনেক বিগ বাজেট, হিন্দি ঢংয়ে আরও ঝলমলে হয়ে উঠল বাংলা ছবির দোলের গান।

যদিও ১৯৮৪-তে স্বপন চক্রবর্তীর কথায় সুরে ‘মোহনার দিকে’ ছবিতে সুমিত্রা মুখার্জীর লিপে আশা ভোঁসলে গাইলেন অপূর্ব একখানি ভোরাই গান, ‘কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল ভোরেরও আকাশে’। যে গান দিয়েই ছেলে দীপঙ্কর দের জন্য পুত্রবধূ পছন্দ করে ফেললেন অনিল চ্যাটার্জী। প্রকৃতি যেন আবিরে সেজে ওঠে এই গানে।

ঠিক এমন সময়েই ১৯৮৭ সালে এল বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘একান্ত আপন’। ধনাঢ্য শিল্পপতির একমাত্র কন্যা সুদীপা, শিক্ষিতা, চিত্রশিল্পী, সুগায়িকা আবার ডাকসাইটে সুন্দরী। সুদীপার বাবার বন্ধু চার্চের ফাদার কাকু হাজির হয়েছেন সুদীপাদের বাড়ি। সেই ফাদার কাকুর শ্বেতশুভ্র পোশাকে রঙ লাগিয়ে সুদীপা ওরফে অপর্ণা সেন গেয়ে ওঠেন হোলির একমোদ্বিতীয়ম গান ‘খেলব হোলি রং দেব না।’ সেই রঙ নিয়ে সুদীপা হাজির হয় সখী কেয়ার বস্তির ঘরে। দুজনে রঙ খেলতে খেলতে গেয়ে ওঠে এই ডুয়েট গান আশা ভোঁসলে আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কণ্ঠে। তার পরই বন্ধ ঘরের মধ্যে আচমকা দেখা কেয়ার গুন্ডা দাদা রণবীরের সঙ্গে সুদীপার। দোলের ফাগে মন বিনিময় দুজনের।

উঠোনে ভিজে কাপড়ে নেচেগেয়ে গান করার জন্য অপর্ণা সেনকে তুমুল কুমন্তব্যে জর্জরিত করা হয়। ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গি লেন’-এর পরিচালিকা জাত খোয়ালেন রঙ খেলে। কিন্তু ‘খেলবো হোলি’ মানেই দোলের এক নম্বর গান আজও।

১৯৮৭ সালেই প্রভাত রায়ের সুপারহিট ছবি ‘প্রতিকার’। এসময় শোলের ঢংয়েই মাঠ জুড়ে দোল খেলার প্রভাব কালার বাংলা ছবিতে আশির দশক জুড়ে চলেছে। বাপ্পি লাহিড়ির সুরে ‘দোল দোল দোল’ গানে মহম্মদ আজিজ, চন্দ্রাণী মুখার্জী, অভিজিৎ। অভিনয়ে দেবশ্রী, ভিক্টর, চিরঞ্জিৎ। দেবশ্রীই সব নাচের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৮৯ সালে প্রভাত রায়ের ‘প্রণমি তোমায়’ ছবিতে বাপ্পি লাহিড়ির সুরে কবিতা ও মহম্মদ আজিজের হিট ডুয়েট গান ‘সকাল হতে না হতে কেন এলে রং দিতে’।

১৯৯০-তে অভিজিৎ সেনের ‘দেবতা’ ছবিতে আবার আরডি-স্বপন চক্রবর্তী ম্যাজিক দোলের গানে ‘বছর ঘুরে এল রে ফাগুন’। দুই জোড়া জুটি গান দিয়েই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছয়। ভিক্টর-দেবশ্রী-অর্জুন-ইন্দ্রাণীর লিপে অমিত কুমার-আশা ভোঁসলে-কবিতা কৃষ্ণমূর্তি-শৈলেন্দ্র সিং এর কণ্ঠে জমজমাট হোলির গান। কুয়োর ধারে পিচকিরির রঙের স্রোতে দেবশ্রী রায় আর ইন্দ্রাণী হালদারের কোমর নাচানো ঠুমকা আরও জমজমাট করে তোলে।

এরপর বাংলা ছবিতে এল দোলের গানের আকাল। কারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরডি বর্মন প্রয়াত, বাপ্পি লাহিড়িও সুর বাঁধছেন না বাংলা ছবিতে। ছবিগুলোর ধারা বদলে গেল। তামিল, বাংলাদেশি ছবির নকল বাংলা ছবি হতে লাগল। দোলের গান হয়নি তা নয়, ‘অনন্যা’, ‘বাঙালিবাবু’, ‘লক্ষ্যভেদ’, ‘বদলা’, ‘রাজদণ্ড’, ‘জনতার আদালত’ ছবিতে দোলের গান এলেও সেসব গান আর জনপ্রিয় হল না। সেই ‘খেলব হোলি’র উপরে আর কোনও গানই উঠতে পারল না।

সুরকার, গীতিকারদের অভাবই দোলের গানের আকালের কারণ হয়ে দাঁড়াল বাংলা ছবিতে, যে অভাব আজও মেটেনি।

এরই মধ্যে অন্য ধারার ছবিতে এল দোলের গানের নতুন ধরনের দৃশ্যায়ন। ২০০১ সালে অপর্ণার কন্যা কঙ্কনা সেনশর্মার ডেবিউ ছবি সুব্রত সেনের হাত ধরে, ‘এক যে আছে কন্যা’। তাতে দোলের দিনের গান, আবির মেখে সব্যসাচী চক্রবর্তীর লিপে প্রতীক চৌধুরীর কণ্ঠে ‘হুঁকো মুখো হ্যাংলা’, সুকুমার রায়ের ছড়া ‘মনে পড়ে রুবি রায়’-এর সুরে। দোলের উপাদান নেই গানে, কিন্তু দোলের দৃশ্যে গানটি ব্যবহার হয়। রঙমাখা মুখে কঙ্কনা। যার ক্রাশ বয়সে বড় সব্যসাচী। গানের দৃশ্যটা খুব রঙিন ও শৈল্পিক ছিল।

https://www.youtube.com/watch?v=eNkhCgKLY-Y

এরপর সেভাবে আর দোলের গান এল না বাংলা ছবিতে, যা মনে রয়ে গেছে মানুষের।

২০১৪-তে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’ ছবিতে নবাগতা গায়িকা লগ্নজিতা চক্রবর্তী গাইলেন অনুপম রায়ের কথায় ও সুরে ‘বসন্ত এসে গেছে’। দোলের আবহে গান নয়, একটা রেট্রো সিনেমার দৃশ্যের গান বলা চলে, কিন্তু গানের কথায় বসন্তের ছোঁওয়া। এমন ভাবে বসন্তর কথা আগে শোনেনি বাঙালি। তাই এ যুগের দোলের গান হয়ে উঠল ‘বসন্ত এসে গেছে’।

২০১৯-এর অগস্টে জন্মাষ্টমীর ভরা বর্ষায় বসন্তের ফাগ ছড়িয়ে দিল ‘গোত্র’ ছবির ‘নীল দিগন্তে’ গান। শিবপ্রসাদ মুখার্জী-নন্দিতা রায়, ডুয়ো পরিচালকের এ ছবিতে বসন্তের গান গাইলেন শ্রেয়া ঘোষাল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে আধুনিক লিরিক্স মিশ্রণ করে এক কোমল প্রেমের দোলের গানের জন্ম হল অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর কম্পোজিশনে। প্রজাপতির মতো ঝুমা মানালি রঙ ছুড়ে দিল গম্ভীর ও কঠিন তারেক আলি নাইজেলের মুখে। কঠিন পৌরুষ স্নাত হল বসন্ত বাহারে, দোলের রঙে মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেল তারেক-ঝুমার। গোত্র ছবির ‘নীল দিগন্তে’ গানটা শুনলেই মনে আলাদা একটা অনুভূতি হয়। যাঁরা অবাঙালি, বাংলা ভাষা বোঝেন না, তাঁদেরও গানের সুরটা মন ভরিয়ে দেয়। দোলের এ গান হৃদমাঝারে থাক।

আজকাল প্রচুর গানের রিয়্যালিটি শো, অনেক নতুন স্টার জন্মাচ্ছে বছর-বছর। অথচ দোলের গান সেই অর্থে নেই। সেই পুরনো গুলোই বারবার বাজছে, গাইছেন সকলে। আদর্শ গীতিকার ও সুরকারদের অভাবে জনপ্রিয় দোলের গান বাংলায় কি তবে হারিয়েই গেল!

হোলিকা দহন থেকে দিল্লির মীনা-বাজার, কত যে রং মিশে আছে হোলির ইতিহাসে

You might also like