Latest News

‘তোমাদের ঋতুপর্ণ তো আমায় ঠকিয়েছে!’ আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন গীতা দে

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায় থেকে দীনেন গুপ্ত, অঞ্জন চৌধুরী সকলের ছবিতেই তিনি সাবলীল। যেন মনেই হত না তিনি অভিনয় করছেন, এতটাই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। ‘দজ্জাল’, ‘কুচুটে’, ‘ঝগড়ুটে’ নানা বয়স্কা মহিলার চরিত্রে তিনি ছিলেন আইকনিক। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ঠিক ততটাই সাদামাঠা সারল্যেভরা মাটির মানুষ তিনি। তাই তো তিনি টালিগঞ্জ পাড়ার সব কলাকুশলীর গীতা-মা। সুচিত্রা সেনের অন্দরমহলে পর্যন্ত একবাক্যে অবারিত দ্বার ছিল তাঁর। তিনি গীতা দে। আজ তাঁর জন্মদিন।

শেষ জীবন কেটেছে চরম অভাব আর একাকীত্বে। যখন গ্যাসের যুগ শুরু হয়েছে, তখনও তিনি উনুনে বা স্টোভে রান্না করতেন। কিন্তু শেষজীবন অবধি কাজ করে গেছেন। কোথাও প্রাপ্তি হয়েছে কোথাও বা অপ্রাপ্তি। যে বাড়ির তিনতলায় থাকতেন, সেখানে ওঁর অংশের দেওয়ালে ঠিকমতো রং বা প্লাস্টার করাও ছিল না। তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির কোনও রেলিং নেই। অসতর্কতায় পড়ে গেলে, মৃত্যুর ঝুঁকি। বর্ষীয়ান, অশীতিপর অভিনেত্রী কীভাবে ঐ রেলিংবিহীন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেন, তা কে জানে! হয়তো অদম্য সাহস, যে সাহসে ভর করে একাই লড়াই করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন।

গীতা দে-র অবস্থা কিন্তু প্রথম জীবনে মোটেই এমন ছিলনা। ঝাঁ-চকচকে ধনাঢ্য পরিবারের বউ হয়েছিলেন গীতা দে। তাঁর বাড়ি দেখলে তাক লেগে যেত। তাহলে কেন এই বিপরীত জীবন হয়ে গেল গীতা তাঁর? সে জন্য শুরুর গল্প জানতে হবে।

১৯৩১ সালের ৫ অগস্ট জন্ম গীতা মিত্রর। বাপের বাড়ি কলকাতার দর্জিপাড়ায়। বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক দেখে তাঁকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানি দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা। ১৯৩৭ সালে মাত্র ছ’বছর বয়সে তিনি ‘আহুতি’ নামে একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি ‘ডিজি’ নামে বিখ্যাত। এর পরে গীতাকে দেখা যায় নীরেন লাহিড়ি পরিচালিত ‘দম্পতি’ এবং সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘নন্দিতা’তে।

আরও পড়ুন: ‘কাবুলিওয়ালা’র ছোট্ট মিনি বড় হয়ে বিশ্বজয় করেন ব্রিজ খেলায়! তবে জীবন ফুরোয় অকালেই

ছোটবেলার এরকমই বেশ কিছু ছবি এবং মঞ্চে অনেক অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর বয়স যখন ১৫, সে সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী ব্যবসায়ী অসীমকুমার দে-র সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ধনী  ব্যবসায়ী স্বামী, ধনী শ্বশুরবাড়ি, বিশাল বাড়ি, সুন্দর করে সাজানো দামী আসবাবপত্র। সেই বাড়ির বউ হলেন গীতা দে। সে বাড়ি দেখে অনেকেরই তাক লেগে যেত।


কিন্তু জনমদুখিণী গীতার সুখ সইল না স্বামীর ঘরে। না, কোনও দাম্পত্য বিবাদ নয়। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরভরন্ত সংসার। দুই ছেলে অসিত, অমিত এবং মেয়ে রূপা শেঠ। এর পরেও গীতার ঘর ভাঙার কারণ ছিল সকলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার প্রবণতা। যতটা মহত্বের কথা আমরা বইয়ে পড়ি বা পর্দায় দেখি, গীতা দে বাস্তব জীবনে তেমনটাই ছিলেন। কিন্তু কে না জানে, বাস্তবে যে পরোপকারী হয় তার দুঃখের শেষ থাকে না। তাকেই সবাই ঠকায়।

গীতা দের মা মারা গেলেন একসময়ে। তিনি মারা যাওয়ার সময়ে নাবালক ভাই-বোনদের দায়িত্ব গীতার উপরে দিয়ে গেলেন মা। গীতাও ভাইবোন অন্ত প্রাণ। বুকে টেনে নিলেন তাদের। কিন্তু গীতার স্বামী মেনে নিলেন না গীতার এই কাজ। নিত্য অশান্তি শুরু হল। তখন কিন্তু গীতা একেবারেই ঘরের বউ। সিনেমায় অভিনয় করেন না। তবু গীতা দে ভাইবোনদের ছাড়েননি। স্বামীই গীতাকে ছেড়ে গেলেন। শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হল গীতাকে। ভাইবোন, সন্তানসন্ততি-সহ রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন তিনি।

শুরু হল এক কঠিন লড়াই। নিজের বাঁচার লড়াই শুধু নয়, অতগুলো বাচ্চাকে দু’বেলা মুখে অন্ন তুলে দেওয়া থেকে, তাঁদের সাবালক করার লড়াই। এই সময়েই রোজগারের পথ হিসেবে গীতা বেছে নিলেন অভিনয়কে। এই শিল্পে গীতার  শিক্ষাগুরু আর কেউ নন, স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী। মঞ্চ থেকে অভিনয়ে ফিরলেন আবার। শ্রীরঙ্গমে ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘তখত-এ-তউস’ একের পর এক নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে মুগ্ধ করলেন গীতা দে।

গীতা দে নাচও করেছেন ব্যালে ট্রুপে। এর পরে চলে আসা চলচ্চিত্রে। ১৯৫১ সালে নতুন করে বাংলা ছবিতে অভিনয়ের ডাক পান তিনি। প্রথমে উত্তম-সুচিত্রা খ্যাত ‘শিল্পী’, তার পরে অগ্রদূত পরিচালিত ‘লালু ভুলু’, নির্মল দে পরিচালিত ‘বিয়ের খাতা’, ‘সাথীহারা’, অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ — একের পর এক জনপ্রিয় ছবিতে শক্তিশালী চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে শুরু করেন গীতা দে।

নায়িকা হিসেবেও একটি অসামান্য চলচ্চিত্র গীতা দের কেরিয়ারে উল্লেখযোগ্য। ডাইনি। এককালে একা দুর্বল মেয়েদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশে ডাইনি অপবাদ দেওয়া হত প্রত্যন্ত নানা গ্রামে। সেইরকম একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন গীতা, ‘ডাইনি’ ছবিতে। বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করতে করতেই ১৯৫৬ সালে তাঁর আলাপ হয় ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত কালজয়ী ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) এবং ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫)-তে তাঁর উপস্থিতি সময়ের নিরিখে অমলিন হয়ে থেকে গেছে আজও।

আরও পড়ুন: উত্তমকুমারের শেষযাত্রার ধারাভাষ্যকার ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়ে’র ‘তিনকন্যা’, ‘সমাপ্তি’-তে। তপন সিনহা’র ‘হাটেবাজারে’, ‘জতুগৃহ’, ‘এখনই’। দীনেন গুপ্তর ‘মর্জিনা আবদুল্লা’, ‘নতুন পাতা’ কিংবা বিজয় বসুর ‘সুবর্ণলতা’তেও। গীতা দে মানেই যুগের পর যুগ ‘দজ্জাল’ নারীচরিত্র আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবা তারকনাথ’ ছবিতে সুধা অর্থাৎ সন্ধ্যা রায়ের সেই দজ্জাল মামিমাকে মনে পড়ে? যে সংসারের সব কাজ ভাগ্নিকে দিয়ে করাত, স্বামী খেদানো বলে চুলির মুঠি ধরত, এমনকি ভাগ্নির মাছের পিসটাও নিজে খেয়ে নিত! পরে সেই মামিমার সম্বিত ফেরে যখন তাঁর বোবা মেয়ে সেই সুধারই ভক্তিতে তারকনাথের কৃপায় কথা কইতে পারে।

এমন হাজারো ছবিতে গীতা দে দজ্জাল। অঞ্জন চৌধুরীর ‘বড় বৌ’ ছবিতে গীতা দে শাশুড়ির রোলে। বড় বউকে ধমকানো ডায়লগ “রান্নাঘরের রান্না ফেলে ঐ বেজন্মা কার না কার পাপ ছেলেটাকে খাওয়াতে বসেছো?” আবার এই গীতা দে মৌচাক ছবিতে সুলতা চৌধুরীর মা, শেখর চ্যাটার্জীর স্ত্রীর চরিত্রে সুযোগসন্ধানী অথচ অভিজাত মহিলা। আবার বলতে হয় ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিতে অপূর্ব অভিনয়ের কথা।

গীতা দে কোনও দিনই টাকাপয়সা জমাতে পারেননি। অথচ সকলের দায়িত্ব নিতেন সাধ্যমতো। কেউ বিপদে পড়ে গীতা-মাকে দুঃখের কথা বললেই তিনি বলতেন একটাই কথা, ‘চলে আয় আমার কাছে।’ নিজের যেটুকু ছিল তাই দিয়েই পরকে আপন করতেন। মায়ের মতো আগলে রাখতেন বিপদে পড়া মানুষদের। সবসময় মনে রাখতেন, তিনি নিজেও একদিন স্বামী-পরিত্যক্তা হয়ে লড়াই করেছিলেন একা। একটা সময়ে রত্না ঘোষাল, ইরা ঘোষাল– দুই বোনকে গীতা দে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এগুলো শুনলে যেন চেনা সিনেমায় দেখা দজ্জাল গীতা দের সঙ্গে বাস্তবের গীতা দেকে মেলানোই যায় না।

অথচ দুঃখের বিষয় হল, গীতা দের যখন প্রয়োজন হল, তখন তাঁর ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, বন্ধুস্বজন– কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ালেন না শেষ জীবনে। সকলেই নিজের জীবনে, নিজের স্বার্থে ব্যস্ত থাকলেন।


এত পরোপকারী মানুষ, এত প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী– অথচ কোনও দিন বাছবিচার করেননি চরিত্র নিয়ে। যে চরিত্র পেয়েছেন সেটাকেই নিখুঁত রূপ দিয়েছেন। কিন্তু বহু পরিচালক, প্রযোজক গোষ্ঠীর থেকে প্রাপ্য টাকা পাননি তিনি। তাঁর শেষ জীবনে এই লিস্টে ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকের নামও।

গীতা একবার এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন “তোমাদের ঋতুপর্ণ ঘোষ তো আমায় ঠকিয়েছে। ওঁর ছবিতে আমায় দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে আজও টাকা দেয়নি।” ঋতুপর্ণ তখন একটা টেলিছবি বানিয়েছিলেন, ‘১ নম্বর মালতীবালা লেন’। সোমা চক্রবর্তী, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় অভিনীত সেই টেলিছবিতে বয়স্ক ঠাকুমার রোল করেছিলেন গীতা দে। ছবিটি ১০-১৫ বছর আগে একবারই সম্প্রচারিত হয়েছিল। চিত্রা সেন, পুষ্পিতা মুখার্জ্জী, শঙ্কর চক্রবর্তী এঁরাও ছিলেন।

গীতা দে যদি বাংলা ছবিতে না আসতেন তাহলে কতটা শূন্যস্থান যে বাংলা চলচ্চিত্রে হত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুচিত্রা, সন্ধ্যা, অপর্ণারা যতই থাকুন, গীতা দের দাপট অন্য উচ্চতায়। শেষ জীবনে শাড়ির ব্যবসা করতে হয়েছে তাঁকে। বহু যন্ত্রণা পেয়ে চলে গেলেন ১৭ জানুয়ারি, ২০১১ সালে। তাঁর শেষ ছবি ‘আজও দু চোখে তুমি’।

আরও পড়ুন: নাসার মঙ্গল-অভিযানে বাঙালি বিজ্ঞানী, পারসিভিয়ারেন্স রোভারের রূপরেখায় ড. অমিতাভ ঘোষ

You might also like