
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বুড়োদা নামেই যিনি ইন্ডাস্ট্রিতে জনপ্রিয়। অথচ তাঁর ভাল নাম তরুণ। শুধু তরুণ নয়, তরুণ কুমার। জন্ম ১৯৩১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। আজ বেঁচে থাকলে তিনি নব্বই বছরের ‘তরুণ’ হতেন।
সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের তিন ছেলে অরুণ, বরুণ, তরুণ। অরুণ কুমার পরে হলেন উত্তম কুমার। তবে মহানায়ক দাদার ছায়ায় ঢাকা পড়েনি তরুণ কুমারের সহজাত অভিনয় প্রতিভা। ১৯৫৪ সালে ‘হ্রদ’ ছবি দিয়ে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। তার পরে অজস্র বাংলা ছবিতে তাঁর সহজাত অভিনয়ের সাক্ষর তিনি রেখেছেন।
যে সব ছবিতে উত্তম-তরুণ একই দৃশ্যে থাকতেন সেইসব দৃশ্য দর্শক এত উপভোগ করে দেখত যা বলার নয়। আজও যখন ‘জীবন মৃত্যু’ ছবিতে তরুণ কুমারের নামাবলির নামে উত্তরাবলির দৃশ্য চলে টিভির পর্দায়, মনটা নিমেষে ভাল হয়ে যায়। ‘পিতাপুত্র’ ছবির বড়দা বা ‘স্ত্রী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’ বা তরুণের জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্র ‘দাদাঠাকুর’ ছবির ক্ষেত্রেও তাই।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চে তরুণ কুমারের অবদান অনস্বীকার্য। এককালের বিখ্যাত ‘নহবত’ নাটকে প্রধান চরিত্রে ছিলেন তরুণ কুমার। টানা সাত বছর ‘নহবত’ রমরম করে চলেছিল মঞ্চে। এছাড়াও অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘কল্পতরু’ নাট্যগোষ্ঠী গড়ে তোলেন তিনি। দাদার নামাঙ্কিত ‘উত্তম মঞ্চ’ গড়ে তোলার স্রষ্টাও ছিলেন এই তরুণ কুমার।
তরুণ কুমারের অভিনয়সত্ত্বার বাইরেও তাঁর যে একটা বড় গুণ ছিল, পরোপকার। সেখানে কোন ভেদজ্ঞান ছিল না তাঁর। তিনি নিজে একজন স্টার, তাঁর দাদা একজন সুপারস্টার, তাঁর স্ত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় একজন স্বনামধন্যা অভিনেত্রী, সেই তরুণ কুমার পরিচিত এক বন্ধুর বাড়ির বর্ষীয়ান কাজের লোক মারা যাওয়ায় তাঁর শেষযাত্রাতেও কাঁধ দিয়েছিলেন। এই যে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ বোধ এটা ওই উচ্চতায় উঠে ক’জনের থাকে!

তরুণ কুমারকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে তিনি হইহই করা, রসিক, আড্ডাবাজ, রঙ্গরসে টগবগ করা মানুষ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একজন ভয়ঙ্কর সিরিয়াস মানুষ ছিলেন তিনি। অত্যন্ত দায়িত্বপরায়ণ, কর্তব্যনিষ্ঠ। যখন উত্তম কুমার নিজের স্টারডম, খ্যাতির বিড়ম্বনা, অসুস্থতা, সাংসারিক টানাপড়েনে বিপর্যস্ত, তখন চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে একা হাতে সামলেছেন তরুণ কুমার। উত্তমকুমারের আকস্মিক প্রয়াণে যে একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি হয় ঘরে-বাইরে, সেই সময়েও সকলকে আগলে রাখেন তরুণ কুমার।
এমনকি সাধারণ মানুষদের সাহায্য করতেও তিনি পিছপা হতেন না। হয়তো শুনলেন কেউ বিপদে পড়েছে, নিজের সব কাজ ফেলে বিন্দুমাত্র স্বার্থ না দেখে অনতিবিলম্বে তরুণ কুমার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জিজ্ঞেস করলেন ‘আমি কি তোমার কোনও কাজে লাগতে পারি?’
যাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি তখন হয়তো বিপদটা সামলে উঠেছেন। তরুণ কুমার তাঁর কোনও কাজেই লাগলেন না। কিন্তু তরুণ কুমারের এই সহমর্মিতায় সেই ব্যক্তি মোহিত হয়ে গেলেন। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন তরুণ কুমারকে।
এই পরোপকার করায় তরুণ কুমারের কোন বাছবিচার ছিলনা। সে বন্ধু হোক বা শত্রু হোক, ধনী হোক বা নির্ধন হোক, পরের বিপদে তিনি ঝাঁপাবেনই। কেউ না ডাকলেও তরুণ কুমার ছুটে যাবেন সেখানে।
এই স্বভাব নিয়ে অনেকেই তরুণ কুমারকে অভিযোগ করেছেন, ‘নিজের দিক না ভেবে এরকম বিপদতারণের ভূমিকা নেবার তোমার কি দরকার? এতে তো পরের সমস্যায় জড়িয়ে যেতেও পারো। তাছাড়া উত্তম কুমারের সম্মান, নিজের স্টারডমও তো জড়িয়ে।’
তরুণ কুমার হেসে বলতেন “এগুলো আমার এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। আমার যদি কখনও বিপদ ঘটে তাহলে যাতে অন্যরা এসে আমার পাশে দাঁড়ান। সেইজন্যই আমার এই ‘লাভ-লেবার’ দাদন দিয়ে রাখলাম আর কি।” বলেই আবার হো হো করতে হাসতে শুরু করতেন বুড়োদা। তারপর গম্ভীর হয়ে বলতেন, “আসল কথাটা হল, কেউ বিপদে পড়লে আমি যেন স্থির থাকতে পারি না। আমার ভেতর থেকে কেউ যেন আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় সেখানে।”
উত্তম কুমার যখন বম্বে গিয়ে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ হিন্দি ছবি করার সময় বিপদে পড়লেন তখনও নিজের সব কাজ ফেলে বম্বে ছুটলেন তরুণ কুমার।
এর আগেও অনেকবার উত্তম কুমারের কাছে হিন্দি ছবি করার অফার এসেছিল। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় থেকে স্বয়ং রাজ কাপুর তাঁর আরকে ফিল্মস ব্যানারে উত্তমকে ডেকেছিলেন। উত্তম তখন করেননি হিন্দি ছবি।
সেইসময় বম্বে মার্কেটে একটা কথা চালু হয়ে গেছিল, ‘উত্তম কুমার পাছে এক্সপোজড হয়ে যান তাই হিন্দি ছবি করতে ভয় পাচ্ছেন। উত্তম যে বলিউডের তাবড় তাবড় নায়ক অভিনেতাদের থেকে লেসার ট্যালেন্টেড সেটা যদি ধরা পড়ে যায় তাই তিনি হিন্দি ছবির কাজ করতে সাহস পাচ্ছেন না।’
এইসব রটনা-জল্পনা উত্তম কুমারের শ্রুতিমধুর লাগার কথা নয়। সেই আগুনে ঘি দিল আরও কিছু শুভানুধ্যায়ীর কথা, ‘গুরু তুমি একটা হিন্দি ছবি করে এদের মুখের উপর জবাব দাও। সত্যিকারের রয়্যাল বেঙ্গলের কী দাপট সেটা বুঝিয়ে দাও বম্বেওয়ালাদের।’ এই শুভানুধ্যায়ীরা উত্তমকে ভালবাসেননি কোনদিন। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে উত্তমকে তাতিয়ে দিলেন। সে সময়ে নিষেধ করেছিলেন ছায়াবাণীর অসিত চৌধুরী, কিন্তু উত্তমকুমার তা শোনেননি। সুপ্রিয়া দেবী, তরুণ কুমাররাও নিমরাজি ছিলেন।

উত্তম কুমার তাঁর হিন্দি ছবির জন্য সেই কাহিনিকেই বেছে নিলেন, যে ছবি তাঁর জীবনে মাইলস্টোন হিট। আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘অগ্নি পরীক্ষা’। হিন্দিতে নামকরণ হল ‘ছোটি সি মুলাকাত’। পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন বন্ধু আলো সরকারকে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির সুপার ডুপার হিট ছবির কাস্টিং বদলে গেল উত্তম-বৈজয়ন্তীমালায়। কলকাতা থেকে মাঝেমাঝে বম্বে গিয়ে উত্তমকুমার শ্যুটিং করে আসতেন। বাদ বাকি কাজ ওই শুভানুধ্যায়ীরা দেখতেন।

গন্ডগোল বাঁধল, যখন ওই শুভানুধ্যায়ীদের নখদন্তসর্বস্ব চরিত্র বেরিয়ে এল। নিজেরাই অর্থ আত্মসাৎ করতে লাগলেন। একটা সময়ে উত্তম কুমার পুরোপুরি নাস্তানাবুদ হয়ে প্রোডাকশন ও ছবি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিশাল আঘাত নেমে এল উত্তমের জীবনে। আর ঠিক তখনই শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষণের মতো প্রোডাকশনের হাল ধরলেন তরুণ কুমার। কলকাতার বাংলা ছবিতে তখন তরুণ কুমারের হাতে প্রচুর কাজ। কিন্তু তিনি সেসব মুলতুবি রেখে বম্বে পাড়ি দিলেন দাদাকে উদ্ধার করতে। এতে কিন্তু তরুণ কুমারের মধ্যগগন কেরিয়ারে বেশ কিছুটা ক্ষতি হয়েছিল। যদিও তাতে তাঁর আফশোস ছিল না। কারণ পরোপকারই তাঁর পরমধর্ম।
এই আত্মত্যাগ কি তরুণ কুমার তাঁর নিজের দাদা বলেই করেছিলেন?
তরুণ কুমার পর সাংবাদিক রবি বসুকে বলেছিলেন, “শুধু নিজের দাদা কেন! যে কেউ ওই অবস্থায় আমার সাহায্য চাইলে আমি দু’হাত বাড়িয়ে দিতাম। একটা বাঙালি ছেলে অহেতুক বম্বাইওয়ালাদের হাতে নাস্তানাবুদ হবে এ কি সহ্য করা যায়?”

এই ছদ্মবেশী শুভানুধ্যায়ীরা কিন্তু আবারও তরুণ কুমারের নামে উত্তম কুমারের কান ভাঙাতে এসেছিলেন। কিন্তু উত্তম কুমার তাঁদের পত্রপাঠ দরজা দেখিয়ে দেন। উত্তমকুমার বলেছিলেন, “বুড়োর যদি কোনও ফল্ট থাকে সেটা ওর অনভিজ্ঞতার কারণে। কিন্তু ওঁর স্পিরিটটাকে আমি সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। নিজের কাজ নষ্ট করে ক’টা মানুষ এভাবে এগিয়ে আসতে পারে! বুড়ো আমার হীরের টুকরো ভাই।”