শেষ আপডেট: 26th August 2022 07:53
বাংলায় হাস্যরসের প্রাণপুরুষ, মালপো ও মৎস্যবিলাসী সাম্যময় কিন্তু বেশ রক্ষণশীল ছিলেন বাড়িতে
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে হাস্যরসের দেবতা যেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (Bhanu Bandyopadhyay)। সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় আসল নাম হলেও, চলচ্চিত্রে এসে তিনি ভানু ডাকনামেই নামেই খ্যাত হন। বঙ্গীয় কমেডি (comedian) ঐতিহ্যর প্রথম প্রাণপুরুষ ভানু, যাঁর লাবণ্যময় অভিনয় ছিল শরীর, মন ও আত্মা জুড়ে। কিংবদন্তী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ শতবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবথেকে কাছের তিন জন ভাগ করে নিলেন অভিনেতা, কমেডিয়ান ছাড়াও ব্যক্তিজীবনের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে নানা গল্প।
শতবর্ষী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতর্পণে তাঁর বড় ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় (Goutam Bandyopadhyay), মেয়ে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটক (Basabi Bandyopadhyay Ghatak) এবং লিভিং লেজেন্ড নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (Sabitri Chattopadhyay)। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ফিল্ম জগতে আসা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরই হাত ধরে।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ২৬ অগস্ট, ১৯২০। বাবার নাম জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মায়ের নাম সুনীতি দেবী। ১৯৪১ সালে তাঁরা ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসেন সপরিবারে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে থেকে গেছিল ঢাকাইয়া বাংলা ভাষার মিষ্টত্ব। তাতেই সংলাপ বলে বাংলা ছবিতে কমেডিকে নতুন মাত্রা দেন এবং দর্শকের চিত্তবিনোদনে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন ভানু।
জীবন ও জীবিকার সঙ্গে নিজের ভাল লাগার প্যাশন যেমন অভিনয়, নাটক করা, চিত্রনাট্য লেখাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ তরুণবেলা থেকেই ছিল ভানুর মধ্যে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানিতে চাকরি করার পাশাপাশি নাটক, সিনেমা, কমেডি শো চালিয়ে গেছেন তিনি। এর পরে তিনি বাংলা ছবিতে স্টার কমেডিয়ান হয়ে উঠলে, চাকরি ছেড়ে শুধু অভিনয়কেই পেশা করে ফেলেন। 'সাড়ে চুয়াত্তর' রিলিজের পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অজস্র বাংলা ছবি, নাটক, রেডিও নাটক, যাত্রার পাশাপাশি বলিউডেও দুটো ছবি করেছিলেন ভানু, 'বন্দিশ' এবং 'এক গাঁও কি কাহানি'।
আমরা স্টারকিড ছিলাম না
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন ছেলে মেয়ে। গৌতম, পিনাকী ও বাসবী। গৌতম এবং বাসবী কলকাতা নিবাসী। পিনাকী পেশায় বৈজ্ঞানিক, দীর্ঘদিন ধরে থাকেন আমেরিকায়।
[caption id="attachment_253591" align="aligncenter" width="1152"]
বড় ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, "ঢাকা শহরে বাবারা থাকতেন। ১৯৪১ সালে কলকাতায় এসে প্রথমে দিদির বাড়িতে ওঠেন। তারপর চারু অ্যাভিনিউতে এখন আমরা যেখানে থাকি তার পাশের গলির একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলেন। মাত্র দেড়খানা ঘর ছিল। উদ্বাস্তু হয়ে আসা পরিবার তখন। তার মধ্যেই প্রথমে ঠার্কুদা, ঠাকুমা, আমার ছোট পিসিমা, বাবার এক মামা, সবাই থাকতেন। মা নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাবা বিয়ে করেন তার পর। সংসার বাড়ল, আমরা ভাই বোনরা হলাম। আমার জন্ম দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরে, ১৯৪৭ সালে। অত লোক ধরছিল না ওই দেড় খানা ঘরে। এর মধ্যে বাবার মামা মারা গেলেন, ঠার্কুদা মারা গেলেন আর ছোটবোনের বিয়ে হয়ে গেল।
ওই সময় বাবা খুবই ব্যস্ত ছিলেন। সকালে বেরিয়ে যেতেন রাত্রে ফিরতেন। বাবাকে দেখতেই পেতাম না বাড়িতে। আস্তে আস্তে নামও হচ্ছিল বাবার। 'পাশের বাড়ি', 'বসু পরিবার' রিলিজ করল। তার পরে 'সাড়ে চুয়াত্তর'-এর পর তো বাবা শিখরে চলে গেলেন। বছরে ১৭-১৮টা করে ছবি করছিলেন। আমার জন্মের পর প্রথম দশ বছর আমরা ওই বাড়িতে কাটানোর পরে ১৯৫৭ সালে জুবিলি পার্কের বাড়ি চলে এলাম। কিন্তু ওখানে বাবার মন টিকলনা। তখন ১৯৬০ সালে আবার এই এখনকার চারু অ্যাভিনিউয়ের দোতলা বাড়িতে এলাম। অন্য একটা বাড়ি। এই বাড়িটা ছিল দেববালা দেবী নামে এক পুরনো আর্টিস্টের বাড়ি। লিজে ভাড়া বাড়ি, কিন্তু পুরোটাই আমাদের। পরে বাড়িটার লিজ শেষ হলে মায়ের তাগাদায় এই বাড়িটাই বাবা কিনে নেন।"
ভানুর মেয়ে বাসবী ঘটক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন "আমরা ছোটবেলায় কোনও দিনই স্টারকিড ছিলাম না। কারন এসবে বাবার তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু লোকে তো জানত আমি ভানু ব্যানার্জীর মেয়ে। তখন স্কুলে আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত, তোর বাবা বাড়িতে হাসায় কিনা! আমার বাবা তার উত্তরে আমায় বলতেন, 'তুমি গিয়ে বলবে যে ওর বাবা কী করেন?' তা ওর বাবা ডাক্তার বলেছিলাম। তখন বাবা বললেন 'ওকে জিজ্ঞেস করবে ওর বাবা কি বাড়িতে অস্ত্রোপচার করেন! কারও বাবা উকিল, কারও বাবা ডাক্তার, তোমার বাবার পেশা হল অভিনয়।' ফলে আমরা কোনও মোহময় জগতে গড়ে উঠিনি। একদম আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আমরা মানুষ হয়েছি।"
বাবার আগে মা নাম করেন
ভানুর স্ত্রী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন নামী গায়িকা ছিলেন। রেকর্ড যুগ পেরিয়ে এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায় নীলিমা দেবীর গান। গৌতম বাবু বললেন "মা তো বাবার আগেই বেশ নাম করেছিলেন গানের জগতে। মা ১৯৪৫ সালে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। ফিল্মেও প্লে ব্যাক করেন, 'কবি চন্দ্রাবতী', 'বনের ময়ূর', 'সর্বহারা', 'কাঞ্চন মূল্য', 'বৌ ঠাকুরানির হাট' প্রভৃতি ছবিতে।
বাসবী বললেন, "মায়ের গানের স্কুল ছিল আমাদের বাড়িতেই। সঙ্গীতশ্রী নাম। আমাদের বাড়িতেই খুব ঘটা করে সরস্বতী পুজোর আয়োজন হত। পুজোতে বসন্ত কাকু (চৌধুরী) খুব আসতেন।"
অভিনয় জগতেও আসেন বাসবী ও গৌতম
গৌতম বললেন, "আমরা প্রথম অভিনয় করেছিলাম 'অর্ধাঙ্গিনী' ছবিতে। এই ছবি দিয়েই বিকাশ রায়ের পরিচালক রূপে আত্মপ্রকাশ। তাতে আমরা তিন ভাই বোনই ছিলাম আর বাবাও ছিলেন। এর পরে আর একটু বড়বেলায় 'কাঞ্চনমূল্য' ছবিতে অভিনয় করি। বাবা ছিল ঐ ছবির প্রযোজক। তখন মূল চরিত্রে একটা ছেলে খোঁজা হচ্ছিল। তো পরিচালক নির্মল মিত্র বললেন, গৌতম তো ভালই কথাবার্তা বলে ওকেই নেওয়া হোক। চরিত্রটা গ্রামের ছেলের ছিল। একদিন আমাদের জুবিলি পার্কের বাড়িতে লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচালক এলেন। আমায় দেখে চুলটা এলোমেলো করে দিয়ে বললেন এই তো গ্রামের ছেলে, তবে ভীষণ ফর্সা। একটু কালো করতে হবে। তার পরে 'কাঞ্চনমূল্য'তে অভিনয় করলাম।
[caption id="attachment_253597" align="aligncenter" width="720"]
বাসবী নিজের ফিল্মে অভিনয়ে আসা নিয়ে বললেন "তখন আমার মাত্র আড়াই বছর বয়স। 'শুভরাত্রি' ছবিতে সুচিত্রা সেনের কোলে চড়ে সুচিত্রা সেনের ছোট ভাইয়ের রোল করেছিলাম। এটাই মনে আছে, সুচিত্রা সেন অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমি বাবার খুব আহ্লাদী ছিলাম। তো সিনেমায় আমায় কাঁদতে হবে, কিন্তু আমি কাঁদছি না। তখন পরিচালক আমায় একটা চড় মারেন আর আমি কাঁদতে শুরু করি। এর পরে একটু বড় হয়ে বাবার সঙ্গেই বাবার মেয়ের রোলেই ছবি করলাম, 'নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে'। এই ছবিতে বাবা নায়ক। ছবিটা বাবার প্রাণের ছবি, আমাদেরও খুব ভাল লাগে। বাবা কমেডিয়ান ছিলেন না ওই ছবিতে।
এর পরে যে উল্লেখযোগ্য ছবিটার অফার তপন সিনহা দিলেন, তা হল 'অতিথি'। চারুর রোলটা করলাম আমি। ছবিটা তো সবার দেখা, চারুকেও সবার দেখা। সেটা আমিই। আর ছবিটা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল। তপন সিনহার টিমের সঙ্গেই দিল্লি যেতে বাবা সেবার ছেড়েছিলেন আমাকে।"
লিপস্টিক নট অ্যালাউড
সুপারহিট ছবি করেও আর ছবিতে এলেন না কেন বাসবী? গৌতম বললেন, "বোনকে তার পরে 'ছুটি' ছবিতে নায়িকা করবার জন্য আমাদের বাড়িতে আসেন অরুন্ধতী দেবী। কিন্তু বাবা না করে দেন। মাও চাননি মেয়ে ফিল্মে সেভাবে নামুক। আমাকেও কাঞ্চনমূল্যর পর পড়াশোনার জন্য ফিল্ম করতে দেননি বাবা। ভাই তো সিনেমার দিকে যায়ইনি কখনও।" বাসবীর মনে এ নিয়ে বাবার প্রতি অভিযোগ নেই। তিনি বললেন, "আমরা তখনকার দিনে অত প্রতিবাদ করতাম না, বাবা-মায়ের কথাই শিরোধার্য ছিল। আমাদের মনেও কোনও প্রশ্ন জাগেনি কেন ফিল্ম করব না। তখন ওঁরা যা বলেছেন, সেটাই ঠিক।
বাবা বাড়িতে ছিলেন একজন মধ্যবিত্ত, ভীষণভাবে রক্ষণশীল বাবার মতোই। মেয়ের লিপস্টিক পরা, মেক আপ করা, স্লিভলেস ব্লাউজ পরা, দূরে ঘুরতে যাওয়া-- এসব একদম পছন্দ করতেন না বাবা। মা আমায় চুড়িদার কিনে দিয়েছিলেন, কিন্তু বাবা চাইতেন মেয়ে শাড়ি পড়ুক। ফিল্ম জগত খুব কাছ থেকে দেখেছি আমরা, কিন্তু বাবা ছিলেন রক্ষণশীল। শান্তিনিকেতনে পড়তে চেয়েছিলাম, বাবা যেতে দেননি মেয়ে একা দূরে থাকবে বলে। কিন্তু সেটা নিয়ে ক্ষোভ নেই। তাতেই আমরা খুশি ছিলাম।"
বড়বেলায় ভানুর পুত্র-কন্যারা
বাসবী দেবী বললেন "কলেজ পাশ করার পরে আমি যখন এমএ-তে ভর্তি হই তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার আগেই আমার বিয়ে দেন বাবা। আমার স্বামীর নাম উৎপল ঘটক। উনি ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সুইৎজারল্যান্ডে ব্যবসা করেছেন দীর্ঘদিন। তারপর কলকাতা এসে ব্যবসা করেন। বিয়ের পর এমএ কমপ্লিট করি। তার পরে তো দীর্ঘ তেইশ বছর বিদ্যাভারতী স্কুলে পড়িয়েছি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বলে স্কুলে কোনও দিনই আমায় এসে সিনেমার প্রশ্ন করা বা সেরকম কোনও লঘু রসিকতার সাহস কেউ পেত না। সে সব ফেস করিনি কখনও। তার পরে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পালসি' এনজিও-তে কাজ করছি সক্রিয় ভাবে।"
গৌতম বাবু বললেন তাঁর প্রথম যৌবনের গল্প। "যারা চলচ্চিত্র জগত সামনে থেকে বেশি দেখে তাঁদের অত খিদে থাকে না ওই জগতে যাওয়ার। যেমন দেখেছি মুনমুন (সেন) কিন্তু ছোটবেলায় সিনেমার কারও সঙ্গেই মিশত না। ছায়া দেবী বসে আছেন সুচিত্রা সেনের তৎকালীন টালিগঞ্জের বাড়িতে। মুনমুন পাশের গলি দিয়ে চলে গেল। মুনমুন ফিল্ম লাইনে এল বিয়ের পরে। উত্তম কাকার (উত্তমকুমার) ছেলে গৌতম স্টুডিওয় এসেছে খুব কম। জহর কাকার ছেলেমেয়েও আসত না। জহর কাকার ছেলেমেয়েকে আমি দিন দুয়েক দেখেছি। বড় হওয়ার পরে বাবা বলেছিল, সিনেমা করলে থিয়েটার শিখতে হবে নয়তো ফিল্ম এডিটিং পরিচালনা। আমি আগেই কাঞ্চনমূল্য করেছিলাম, অভিনয় পারি, তবু। ছবি পরিচালনা করার শখ ছিল আমার। সৌমিত্র কাকা (চট্টোপাধ্যায়) ছিলেন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের এখানকার সিলেক্টর। তো উনি আমায় পাঠালেন পুনে। গিয়ে দেখলাম ওখানকার ঘর ভাড়া মাসে সাড়ে সাতশো টাকা। সেই ৭১ সালের কথা বলছি।
আরও পড়ুন: হাসির রাজা জহর রায়, পান্তুয়া দিয়ে মদ খেতেন শোক ভুলতে! এত অনিয়ম সয়নি শরীরে
অত টাকা ভাড়া দেওয়া সম্ভব না। ছ'মাস তখন বম্বেতে ছিলাম, কাজের খোঁজে। বাবা বলেছিলেন হৃষিকেশ মুখার্জী বা দুলাল দত্তর কাছে ফোর্থ অ্যাসিসট্যান্ট হয়ে ঢুকতে। সেখানেও দেখলাম চিত্রনাট্য লেখা হা চিত্রনাট্য পড়ানোর কাজ। আর আমি হিন্দিতে অত দড় ছিলাম না। তাই বম্বে থেকে চলে এলাম। কলকাতা দূরদর্শনে অনেক ধারাবাহিক প্রযোজনা করেছি আমি আর আমার এক বন্ধু। যেমন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় অভিনীত 'অন্দরমহল', বাসু চ্যাটার্জীকে দিয়ে প্রথম বাংলা ধারাবাহিক করালাম 'যদি এমন হত'। তাতে উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ ছিলেন। তখন নতুন রূপা, পাপিয়া, ইন্দ্রাণী সবাই ছিলেন।
আর আমার ভাই পিনাকী তো বৈজ্ঞানিক। বহুদিন আমেরিকা নিবাসী। তবে যোগাযোগ সবসময় আছে।"
ছেলেমেয়ের তারকাখচিত বিয়ে-পৈতে
গৌতমবাবু বললেন, "আমার আর ভাইয়ের পৈতে একসঙ্গে হয়েছিল। সারা টালিগঞ্জ পাড়া সেদিন হাজির ছিল। উত্তম কাকা সকাল বেলা এসে আমাদের দুই ভাইকে নীচে ডেকে দুটো দামী ঘড়ি দিলেন। ওঁর সঙ্গে ছিলেন অসিত চৌধুরী। উনি মুক্তোর কিছু একটা দিলেন। আর বুড়ো কাকাও (তরুণ কুমার) ছিলেন, উনি দিলেন পিকনিক সেট। আর বাকি সব অভিনেতারা তো পরিবেশনও করেছিলেন আমাদের পৈতেতে। বোনের বিয়েতেও তখনকার আমলের ফিল্মস্টারের ঢল নামে।"
বাসবী দেবী যোগ দিয়ে বললেন, "ওঁদের তো আমরা ফিল্মস্টার ভাবতাম না। বাবার বন্ধু, সহকর্মী ওঁরা তো আসবেনই। কেউ কাকা, কেউ পিসি, মাসি, দিদি এরকম। তাঁরা আমাদের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন ছিলেন না। আমার বিয়েতে অরুন্ধতী দেবী, তপন সিনহা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুরো পরিবার, সন্ধ্যা রায়, উত্তম কুমার, গৌরীদেবী, সুপ্রিয়া দেবী এমনকি কানন দেবীও আসেন।"
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে লুচি মাংস খাওয়া
গৌতম ও বাসবীর এক দিদি থাকতেন ঐ চারু অ্যাভিনিউতেই, তিনি ভানু ব্যানার্জীর ভাগ্নি। সুচিত্রা সেনের অন্তরঙ্গ বান্ধবী ছিলেন তিনি, মিসেস সেন অন্তরালে যাওয়ার পরেও। দুই বান্ধবী বা দুই সই বলা চলে। ইন্দ্রপুরী থেকে শ্যুটিং সেরে সুচিত্রা চলে আসতেন এই দিদির বাড়ি। সেখানে স্নান সেরে, চা জলখাবার খেতেন।
সুচিত্রা সেনের পছন্দের পদ ছিল লুচি মাংস। আর সে বাড়িতে লুচি-মাংস হলেই গৌতমেরও ডাক পড়ত। দিদির বাড়ি গিয়ে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে লুচি খাওয়া চলত। ভাবা যায়, কী দুর্দান্ত হিরে-মানিক সব অভিজ্ঞতা। খেয়েদেয়ে সুচিত্রা ফিরে যেতেন বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ি।
ভানুর ফেভারিট মালপোয়া থেকে কৈ-ইলিশ
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপ 'মাসিমা মালপোয়া খামু' এক আইকনিক ডায়লগ। কিন্তু ভানুর বাড়িতে কী রান্না হত? ভানুদের রান্না থেকে বাজার-দোকান-- সবই করতেন যোগেশ্বর ঠাকুর। ভৃত্য নন, চিরকাল পরিবারের সদস্যর মতো ছিলেন।
ভানুর বাড়িতে কোনও দিনও সবজি তরকারি বেশি ঢোকেনি, বরং তিন রকম মাছের পদ বাঁধা ছিল রোজ। বাঙাল মানুষ এমনিতেই মাছ ভক্ত। তবে ইলিশ আর চিংড়ি দুইই আসত। নোনা ইলিশ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান তর্ক হত উত্তম কুমারের সাথে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থাকতেন তাঁর ভানুদার দলে। কিন্তু ভানুর বাড়িতে সব মাছের পোকা, চলত শুঁটকি মাছও। চিরকাল মাছের পিস বড় করে কাটা হত।
তবে ভানুর সবচেয়ে প্রিয় পদ ছিল সরষে দিয়ে তেল কৈ। আর 'মালপো' হত একটা বিশেষ ধরনের শুকনো মালপোয়া, সেটা ভানু ব্যানার্জীর মায়ের হাতের স্পেশ্যাল।
অজাতশত্রু ভানুর শেষযাত্রায় ভেঙে পড়ে টলিউড
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হার্টের অসুখ ছিল। এছাড়াও শিল্পীদের যা হয়, রাত জাগা, অনিয়ম, খাটুনি। সব মিলে শরীর বেশ ভেঙে যায়। উনি যাত্রাতেও আসেন। তাতে আরও অনিয়ম হয়। ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ রাত বারোটায় মাত্র ৬২ বছর বয়সে মারা যান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমিত্র, সাবিত্রী, অনিল, অপর্ণা, মাধবী, অনুপ, সন্ধ্যা, চুণী গোস্বামী থেকে বড় বড় পরিচালকরা শেষ দেখায় ছুটে আসেন। ভানুদার দেহ সৎকারে চলে গেলে নীলিমা দেবীর কাছে এসে হাত ধরে বসেন সুচিত্রা সেন।
তার আগে ৮০ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে কলকাতার পথে মহানায়কের শেষযাত্রায় এত ভিড় হয় যে পুলিশ ভিড় কন্ট্রোল করতে পারে না। তাই শিল্পীরা বিশৃঙ্খলা এড়াতে ঠিক করেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষযাত্রা ওই ভাবে শহরের পথে পথে ঘুরে হবে না।
শতবর্ষ পেরিয়েও ভানু তুলনাহীন
দুই বাংলায় ভালোবাসায় পূজিত উদয় ভানু তিনি। টলিউডের এখনকার কমেডিয়ানদের স্বীকৃতিস্বরূপ 'টেলি সিনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কার' চালু হয়েছে। যদিও তাঁর কোনও স্ট্যাচু নেই শহরে। পুত্র গৌতম জানালেন, "নয়ের দশকে কংগ্রেসের পঙ্কজ ব্যানার্জী বলেছিলেন টালিগঞ্জ সার্কুলার রাস্তা বাবার নামে হবে। সৌমিত্র কাকা থেকে সুব্রত ভট্টাচার্য সবাই সই দেন। কিন্তু পার্টিগত কারণে আর হয়নি সেটা। ২০০৩ সালে সুভাষ চক্রবর্তী আমায় ডেকে কদিন বলেছিলেন, সুরেন্দ্রনাথ কার্জন পার্কে স্ট্যাচু বানানো হবে, এক দিকে থাকবেন তুলসী চক্রবর্তী আর এক দিকে থাকবেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর তো উনি মারা গেলেন, সে চেষ্টাতেও ইতি পড়ল।"
বাসবী যোগ করলেন "দর্শকরা যে বাবাকে মনে রেখেছে এটাই শতবর্ষে প্রাপ্তি। সেদিনও রিনাদি (অপর্ণা সেন) বলছিলেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমেডি এত ভাল কারণ ওঁর অসাধারণ টাইমিং-জ্ঞান। আমরা ভেবেছিলাম কোন মঞ্চে বড় করে বাবার শতবর্ষ অনুষ্ঠান করব। সে তো করোনা আবহে সম্ভব হল না। পরে করার ইচ্ছে আছে। আর অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলছি, এখানে যে যেটা করে তাকে সেটাই আবহমান কাল ধরে দেওয়া হয়। তবে আমার মনে হয় কৌতুকাভিনেতা কিন্তু সবাই হতে পারে না। নায়ক অনেকে হয় কিন্তু কৌতুক করা দর্শককে হাসানো খুব কঠিন কাজ। সেটা বাবা করে দেখিয়েছিলেন।"
গৌতম আরও বলছিলেন, "এখন যা কমেডি দেখি, প্রায় সবই কোনও না কোনও জোকস থেকে টোকা। চল্লিশ বছর আগে বাবা এসব করেননি। বাবা একদম অকৃত্রিম বাঙালি কমেডি করেছেন, সেই নিখাদ হাস্যরস মানুষ মনে রেখেছে।" বাসবীর মতে, "এখন যে সকলে সব লঘু মানের কমেডি করছেন তা নয়। কিন্তু বাবা, জহর কাকা, অজিত কাকা, তুলসী চক্রবর্তী-- এঁরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই এমন কমেডি করতেন, যা আজও ভোলা যায় না। হাসির উদ্রেক করতে উদ্ভট সাজতে হত না কাউকে।
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বললেন "ভানু মানেই বাঙালদের আইকন অনেকেই বলেন। কিন্তু ঘটিরা ভানুর মুখে বাঙাল কথা না শুনতে গেলে সাড়ে চুয়াত্তর হিট হত কি? আমাদের ছোটবেলায় বাঙালরা হিন্দি ছবি দেখত বেশি। টালিগঞ্জের বাঙাল অঞ্চলে সব ছিল হিন্দির ছবির হল। আবার ভবানীপুরে সব বাঙলা ছবির সিনেমা হল। আমাদের বাড়িতে এদেশি-ওদেশি ভাগ ছিলনা অত। বাবা সবাইকে ভালোবাসতেন বলেই বাবাকেও আজও দুই বাংলার মানুষ মনে রেখেছে।"
এখন ভানুশ্রী
একটা কথা বলে সাক্ষাৎকার শেষ করলেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, "আমার মা থাকাকালীন আমরা ভাই-বোনরা মিলে ঠিক করি বাবার বাড়িটা ভগ্নপ্রায় হয়ে যাচ্ছে, তাই অ্যাপার্টমেন্ট বানানো হোক। কারণ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন, ভাই আমেরিকায়, মায়ের পরে আমি ব্যাচেলর মানুষ। একটা বিশাল পুরনো বাড়ি নিয়ে কী করব।
তাই হল। আমরা ফ্ল্যাট পেলাম। আর যেহেতু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমির উপর বাড়ি, তাই আবাসনের নাম দেওয়া হল 'ভানুশ্রী'। এখানে আমরা বাবার সব ব্যবহার্য জিনিস রেখে, ফিল্মের জিনিস রেখে একটা সংগ্রহশালা করেছি। ২০১৮ সালে সাবুপিসি (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) এসে উদ্বোধন করেছেন। এই বাবার নামে সংগ্রহশালা সবাই এসে দেখতে পারেন 'ভানুশ্রী'তে।"
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে ভানু
একজন ভদ্রলোক বললেন আমায়, "আপনার লগে কথা কইতে চাই। আপনে নাটক করবেন?" আমি আকাশ থেকে পড়লাম। প্রথমে না বললাম। তার পরেও তিনি শুনলেন না। গম্ভীর ভাবে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললাম, "আমার বাবার লগে কথা কইতে হইব।"
ঘটির দেশে খাস বাঙাল ভাষায় কথা শুনে মন ভাল হয়ে গেছিল। পরের দিনই ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবাকে তাঁর নাম বললেন, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ডাক নামে বেশি লোকে চেনে। ডাকনাম ভানু।
ভানুদার আবিষ্কার আমি। ভানুদার হাত ধরেই ফিল্ম জগতে আসা আমার। ভানুদা একটা জুতো কিনে দিয়ে আমায় বলেছিলেন, "কলকাতা শহরে পথে কাঁকর-পাথর বিছোনো পথে খালি পায়ে হাঁটা যায় না।" কথাটা মর্মে মর্মে সত্যি। সে জুতো বহুদিন আমি রেখে দিই। আর একটা কথাই বলব ভানুদার শতবর্ষে, ওঁর মতো এমন বহুমুখী প্রতিভাবান অভিনেতা হয় না। ভানুদা শুধু কমেডিয়ান ছিলেন না। 'নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে' ছবিতে সবাইকে কাঁদিয়েও দিয়েছিলেন ভানুদা।"
স্যার সত্যেন বোসের ছাত্র ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনিই প্রথম পালন করেন মাস্টারমশাইয়ের জন্মদিন