
সুমন গুপ্ত
(বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ফিল্ম সমালোচক)
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের স্বর্ণযুগ শেষ হল সোমবার সকাল এগারোটা সাতাশ মিনিটে। চলে গেলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার (Tarun majumdar)। দীর্ঘ বছর সাংবাদিকতা করার সুবাদে আমার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল তাঁর। আমি ওঁকে তনুদা বলতাম। তনুদা আমাকে নাম ধরেই ডাকতেন। তবে আপনি বলতেন। নানান ব্যাপারে আলোচনা হত আমাদের। মাস দেড়েক আগে আমি তখন একটা লেখার কাজে নবদ্বীপে, তনুদা ফোন করেছিলেন। বলছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করছেন শতরূপ ঘোষ। ইন্দুর (মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে একটু কথা হলে ভাল হত। আমি ওর ফোন নম্বরটা পাচ্ছি না। আপনি যদি একটু বলে দেন ইন্দুকে।’
আমি বলে দিয়েছিলাম মৌসুমীকে। ওঁদের কথাও হয়েছিল। খুব নির্ভর করতেন। কোনও অসুবিধেয় পড়লে খুব কুণ্ঠা নিয়ে বলতেন আমাকে। এত বড়মাপের একজন মানুষ, অথচ একেবারে মাটির কাছাকাছি। একটুও দম্ভ নেই, আড়ম্বর নেই, দেখানেপনা নেই, ছিল শুধু কর্মোদ্যম আর মেধা। অসম্ভব পড়াশোনা করতেন। শুধু সাহিত্য নয়, সব বিষয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল। আর ছিলেন অত্যন্ত পারফেকশনিস্ট। সেই কোন যুগ থেকে যে ওঁর সিনেমার শ্যুটিং কভারেজে যেতে শুরু করেছি, এখন আর সময়টা মনে নেই। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো কাজ। প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিজে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন তিনি ঠিক কী চাইছেন। পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত টেক চলতে থাকত। ডাবিং ও এডিটিংয়ের ক্ষেত্রেও তনুদা খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। যতক্ষণ না নিজে স্যাটিসফায়েড হতেন ততক্ষণ বদল চলতে থাকত। এই বয়সেও কাজে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না।
‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’র সঙ্গে জুড়েছিলেন তরুণ মজুমদার! ডিরেক্টরকে বলতেন ‘স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘুমাও’
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনেমা করলেও মূলত বাংলার গ্রামজীবন ও বাঙালি পরিবারের ছবি যত্ন করে এঁকেছেন পরিচালক। আবার প্রবাসী বাঙালির দিনযাপনের মায়াময় ছবিও তার রঙ রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে তনুদার সিনেমায়। বড় সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাস নিয়ে যেমন ছবি করেছেন, তেমনই নিজের লেখা গল্প ও স্ক্রিপ্টেও অসাধারণ সব সিনেমা তৈরি করেছেন।
এবার আসি গানে। প্রথম থেকেই আমরা দেখেছি তাঁর সিনেমায় গান একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গানের অসাধারণ প্রয়োগের পাশাপাশি পল্লীগীতি ও বাংলা আধুনিক গানের ব্যবহার দর্শককে মুগ্ধ করেছে চিরকাল। হেমন্তদার (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে তনুদার যুগলবন্দি তো ইতিহাস। তাঁর পঁচিশটা ছবিতে সুর করেছিলেন হেমন্তদা। এতটাই শ্রদ্ধা ভালবাসার সম্পর্ক ছিল দুজনের। মুম্বইতে গেলে হেমন্তদার বাড়ি গীতাঞ্জলিতেই থাকতেন তনুদা। অবারিত দ্বার ছিল। আর একটা কথা, তনুদা নিজেও গান জানতেন। অনেক গানের নোটেশন করতে দেখেছি তাঁকে, এতটাই সুরবোধ ছিল তাঁর।
সাংবাদিকদের সঙ্গে তনুদার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। সবাইকে যোগ্য মর্যাদা দিতেন। তাঁর ফিল্মের প্রিমিয়ারে গিয়ে দেখেছি তনুদার মধ্যে কোনও উত্তেজনা নেই। ইন্টারভ্যালে হল থেকে বেরিয়ে দেখেছি বাইরে সোফায় একা বসে আছেন। তখন একটাও কথা বলতেন না। সিনেমা শেষ হওয়ার পর দেখতাম হলের বাইরে পোর্টকোতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে জিজ্ঞাসা, মুখে কথা নেই। ভাল লেগেছে বললে মৃদু হাসতেন। আর কোনও প্রশ্ন করলে বুঝিয়ে বলতেন। এমন স্থিতধী মানুষ খুব কম দেখেছি। সাংবাদিকরা কেউ সমালোচনা করলেও সেভাবে রিঅ্যাক্ট করতে দেখিনি। আপাদমস্তক ভদ্র মানুষ ছিলেন।
আর একবারের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। বামফ্রন্ট আমল, তনুদা নন্দনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের তোড়জোড় চলছে। আমি তনুদার সঙ্গে দেখা করতে মিটিং হলে ঢুকে পড়েছিলাম। তখন সেখানে সিএমের সঙ্গে মিটিং চলছিল। আমি ইতস্তত করছি দেখে তনুদা নিজে চেয়ার টেনে আমাকে বসতে বললেন। বললেন, ‘এটা সিক্রেট মিটিং নয়। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। আপনি শুনলে লিখতে সুবিধেই হবে।’
আউটডোর শ্যুটে গেলে প্রত্যেকের খোঁজ নিতেন। হিরো, হিরোইন থেকে স্পটবয় সবার সুবিধে অসুবিধে দেখতেন। সাংবাদিকদেরও যত্ন করতেন। এমনকি গ্রামে শ্যুটিং দেখতে আসত যে বাচ্চারা তাদের টফি দিতেন। খুব বড় মনের মানুষ ছিলেন।
আরও অনেক ভাল কাজ তনুদা করতে পারতেন। কিন্তু হয়ে ওঠেনি নানা কারণে। হিন্দি ও ইংরেজিতে নেতাজীকে নিয়ে একটা ছবি হওয়ার কথা ছিল মুম্বইয়ে। স্ক্রিপ্ট লেখার কাজও শুরু করেছিলেন তনুদা। কিন্তু প্রজেক্টটা হয়নি। হিন্দিতে ‘বালিকা বধূ’ হয়েছিল। সেটা কিন্তু হিট ছবি।
আমার সঙ্গে তনুদার শেষ কথা হয়েছিল দিন পনেরো আগে। তারপরই উনি হসপিটালাইজড হলেন। আসলে হেমন্তদাকে নিয়ে লেখা আমার বইটা উনি পড়তে চেয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম পড়েছেন কিনা। বললেন, ‘পড়ছি। অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে সুমন’।
সেদিন তনুদার গলাটা খুব ক্লান্ত, স্বরটা ভাঙা ভাঙা লাগছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার শরীরটা কি খারাপ?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, শুয়ে শুয়ে কথা বলছি।’ বললাম, ‘তাহলে রাখি। আপনি রেস্ট নিন।’ শুনলেন না। অনেক গল্প করলেন। কিন্তু সেটাই যে আমার তনুদার সঙ্গে শেষ গল্প করা তা ভাবতেও পারিনি। মাঝে ভাল আছেন শুনেছিলাম। কিন্তু চলে গেলেন। খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে এমন একজন মানুষের সান্নিধ্য যে আমি পেয়েছি সেটা আমার সৌভাগ্য। আজীবন তনুদা থাকবেন আমার মনের গভীরে।