শেষ আপডেট: 15th January 2025 13:07
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সময়টা নয়ের দশকের শেষের দিক। মাথায় ঘোমটা, কপালে লাল টিপ-- সিনেমার 'ভাল বউ', 'ভাল মেয়ে' হওয়ার দৌড়ে একে একে নাম লেখাচ্ছেন বঙ্গনারী। এন্ট্রি নিলেন এক তন্বী। ছিপছিপে গড়ন, শরীরী হিল্লোলে ঝড় তুললেন পর্দায়। কখনও দাদুর বখাটে নাতনি, আবার কখনও বা মধ্যবিত্তের বোকাবাক্সে 'রূপকথা'র নায়িকা হয়ে সাবলক করলেন দর্শককে। তিনি জুন দুবে।
না, পদবীতে ভুল হচ্ছে না কোথাও। বাবার শিকড় এলাহবাদ। মা বাঙালি। জন্মসূত্রে তিনি দুবেই। যদিও বাংলা তাঁকে আজও চেনে জুন মালিয়া হিসেবেই। কলকাতার নামী স্কুলে পড়াশোনা, রক্ষণশীল পরিবার। পিসির বাড়িতে গিয়ে প্রথম প্রেমে পড়া--- জুনের জীবন যেন সাক্ষাৎ সেই রূপকথাই, সে রূপকথা তাঁর একার নয়। সেই কিশোরী বয়সেই তাতে ভাগ বসিয়েছিলেন সঞ্জীব মালিয়া, জুনের প্রথম স্বামী।
পিসি থাকতেন দেহরাদুনে। সেখানকার দুন স্কুলে পড়তেন সেই সঞ্জীব। পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েই জুনের জীবনে আচমকাই উথালপাথাল। সঞ্জীব আসে সেই 'ঠান্ডি হাওয়া কা ঝোকা' হয়ে। স্কুলে পড়া, দুই বিনুনি করা জুনকে প্রথমে পাত্তাই দেননি তিনি। সালটা ওই ৮৬। কাট টু, সাল ১৯৮৮। দুনে পড়া শেষ করে সঞ্জীব ফেরেন কলকাতায়। ওদিকে কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যমে থেকে পাশ করা জুনের মধ্যেও তখন আমূল পরিবর্তন। সো কল্ড 'বেহেনজি' ইমেজ ভেঙে তিনি তখন সদ্যযৌবনা প্রাণোচ্ছল এক অপ্সরা। কলেজে ভর্তি হয়েছেন, জীবনে অন্য পুরুষ।
তাঁদের আবার দেখা হয় কলকাতারই এক পাবে। শিশুসুলভ চেহারা ততদিন উধাও জুনের। সঞ্জীব চোখ ফেরাতে পারেননি। প্রেম ছিলই অন্তরালে, এবার তা আসে প্রকাশ্যে। অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে যায় বিয়ে। আর তারও কিছু দিনের মধ্যেই মা হন জুন। একইসঙ্গে নামের পাশে জুড়ে যায় মালিয়া পদবী। নাচ করতে ভালবাসতেন খুব। ক্লাসিক্যাল শিখতেন মন দিয়ে। তবে সংসারের জাঁতাকলে ধ্বস্ত হওয়া মেয়েটি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে তাঁর নিজের সময় বলে যে আর কিছুই নেই! প্যাশন সুইসাইড করেছে আগেই, নাচ বন্ধ। আটকা পড়ে গিয়েছেন এক অদৃশ্য বন্ধনে।
জুনের কথায়, "হঠাৎ দেখলাম অন্যকে খুশি করতে গিয়েই যেন কীভাবে ছয়টা বছর কেটে গেল। নিজেকে আর খুশি করতে পারলাম কই।" গাড়ি চালানোর শখ, স্বামী হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। নাচ? তাতেও আপত্তি! অভিনয়ে সুযোগ-- বরের টিপ্পনি 'কিছুই করতে পারবে না, ফিরে আসবে'। চ্যালেঞ্জটা যেন সেদিনই নিয়ে ফেলেন জুন। বেরিয়ে আসেন সাধের সংসার ছেড়ে। ৯-এর দশকে শুরু একা একলা মেয়ের বাঁচার লড়াই, উপরি পাওয়া দুই সন্তান।
সোজা ছিল না কিছুই। রক্ষণশীল পরিবার। ডিভোর্সি মেয়ে, সঙ্গে আবার বাচ্চা! আত্মীয়রা জুন-সঙ্গ ছাড়েন এক এক করে। ছেলের স্কুলেও সমস্যা। চারিদিকে একটাই প্রশ্ন, 'বাবা কোথায় গেল?'। অনর্গল কথা বলে চলা, বড় চোখের মেয়েটা হার মানেননি সেদিন। বরং নিজের জন্য বাঁচা শুরু করেন ওই প্রথম। সিরিয়ালে ডেবিউ করেন। নাম 'তৃষ্ণা'। এরই মধ্যে পরিচালক প্রভাত রায় তাঁর নতুন ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। সুদেষ্ণা রায় প্রভাত রায়কে বলেন জুনের কথা। জুন ফাইনালি সুযোগ পান বড় পর্দায়।'লাঠি' সিনেমায় ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবশ্রী রায়ের বড় নাতনির ভূমিকায় জুনকে নিলেন প্রভাত রায়। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুপারহিট সেই ছবিতে বখাটে-ফেলু নাতনি তিনি। পরে যদিও অবশ্য তাঁর 'মতিগতি' ফেরে। ঠিক বাঙালি মুখ নয়, ভীষণ স্মার্ট, সেক্সি...কে এই মেয়ে? মধ্যবিত্ত বাঙালি পারলে সে সময় সব মাসের নাম বদলে জুনই রেখে ফেলেন। 'রূপকথা' সিরিয়ালে এক দুপুরে বাঙালির অন্দরমহলে ঝড় তুলল শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়-জুন মালিয়ার অন্তরঙ্গ শয্যাদৃশ্য। ১৮-তে পা দিল বাঙালির ড্রয়িংরুম।
এরপর একে একে 'নীল নির্জনে', 'তিন ইয়ারি কথা', ''হঠাৎ বৃষ্টি', 'পদক্ষেপ', '২২ শ্রাবণ', 'দ্য বং কানেকশন', 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান'--- তালিকাটা লম্বা, অনেক লম্বা! আর ফিরে তাকাতে হয়নি জুনকে।
সালটা ২০১৯। এক নভেম্বরের সন্ধেতে ছেলে-মেয়েকে সাক্ষী রেখেই ফের নতুন ভাবে জীবন শুরু করেন জুন। স্বামী সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যদিও বিনোদন দুনিয়ার যোগাযোগ ছিল না। তবু চুপিসারে ১৪ বছর সম্পর্কের পর ছিমছাম ভাবেই বিয়ে করেন ওঁরা। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং নেলী সেনগুপ্তের প্রপৌত্র সৌরভ। স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নামে দক্ষিণ কলকাতায় রয়েছে অতি পরিচিত দেশপ্রিয় পার্ক। জুনের বিয়েতে হাজির ছিল টলিউড। দুই ছেলে-মেয়েকে সাক্ষী করেই জুন-যাত্রা শুরু হয় বছর কয়েক আগেই। আজ তিনি সাংসদ, সঙ্গে চলছে অভিনয়। ৫০ অতিক্রান্ত জুন এখন স্থিতধী, শান্ত।
তথ্যঋণ: অঞ্জন দত্তের জুন মালিয়াকে নেওয়া সাক্ষাৎকার