শেষ আপডেট: 13th December 2024 12:05
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কষ্টিপাথরের একটি মূর্তি। ডাগর ডাগর চোখে পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা যেন কবিতায় রূপ পায়। এমনই মাদকতা মাখানো শরীরী বিভঙ্গ ও আবেদন ছিল তাঁর রূপে। মাখন মাখন রূপের ফিল্মি দুনিয়ায় তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য প্রদীপ। তাঁর নাম স্মিতা পাটিল। মাত্র ১০ বছর ছিলেন সিনেমা জগতে। কিন্তু, তার মধ্যেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন আরব সাগরের জল। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে মাত্র ৩১ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ হয়েছিল স্মিতা পাটিলের। কিন্তু, সামান্য ১০ বছরের অভিনয়েই হিন্দি ফিল্মের ইতিহাসে একটা পুরো অধ্যায় একাই লিখে রেখে গিয়েছেন স্মিতা পাটিল।
সমান্তরাল ছবি থেকে বাণিজ্যিক ছবি সবেতেই স্বচ্ছন্দ যাতায়াত ছিল স্মিতার। অনেকেই তাঁকে এবং শাবানা আজমির সঙ্গে অভিনয় প্রতিভা নিয়ে তুলনা করেন। কিন্তু এটাও সত্যি যে, শাবানা আজমি নিজে যখন কেতন মেহতা কিংবা গোবিন্দ নিহালনির সঙ্গে কাজ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতেন তখন এই পরিচালকরা স্মিতাকে দিয়ে অভিনয় করাতে পছন্দ করতেন। মুম্বইয়ে একসময় চর্চা চলত, লতা বড়, না আশা বড়। ঠিক তেমনই শাবানা-স্মিতার মধ্যে ছিল এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। দর্শকরাই ভাগ করে নিয়েছিলেন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জার্সি।
কিন্তু, স্মিতা পাটিলের মতো নাচতে জানতেন না শাবানা আজমি। বাস্তবিক নাচতে ভালোবাসতেন স্মিতা। প্রকাশ মেহরার 'ঘুঙ্গরু' সিনেমায় মুজরেওয়ালি এবং রাজেশ শেঠির 'অঙ্গারে' সিনেমায় তিনি বেশ ভালো নেচেছিলেন। অমিতাভ বচ্চন যখন জনপ্রিয়তার শিখরে সে সময় তাঁর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। 'নমক হালাল' সিনেমার 'আজ রপট জায়ে তো হামে না উঠাইয়ো' গানটির নাচ তো বৃষ্টিভেজা গানের একটি আইকন হিসেবে থেকে গিয়েছে। স্মিতা সেখানে জলে কিলবিল করা মৎস্যকন্যার মতো সাবলীল নেচেছিলেন অমিতাভের সঙ্গে। মিথ্যা নয়, ওই নাচে স্মিতার শরীরী সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন ম্লান করে দিয়েছিল খোদ অমিতাভ বচ্চনকেও।
অনেকে বলে থাকেন, এই দৃশ্যে অভিনয়ের পর স্মিতা বাড়ি গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন। কারণ বাণিজ্যিক ছবিতে ব্যবহৃত যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া অভিনয়ে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। এবং এ ধরনের অংশে তিনি অভিনয় করতেও চাইতেন না। তা সত্ত্বেও নিজেকে বাণিজ্যিক ছবির কক্ষপথ থেকে বের করে আনতে পারেননি। অভিনয় এবং ব্যক্তিগত জীবনেও একই ধরনের ইমোশনাল ছিলেন স্মিতা। তাই রাজ বব্বর বিবাহিত জেনেও তাঁর জন্য প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এবং জেনেবুঝে রাজ বব্বরকে জনপ্রিয় করে তুলতে বেশ কয়েকটি ছবিতে তাঁর সঙ্গে অগুরুত্বপূর্ণ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
অমোল পালেকর একবার একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন, অভিনয়ের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন স্মিতা। ভূমিকা সিনেমায় অভিনয়ের সময় স্মিতাকে না জানিয়েই তাঁকে চড় মেরেছিলেন অমোল। পরিচালক শ্যাম বেনেগালের নির্দেশে এই কাজ করতে হয়েছিল। যাতে ছবির মধ্যে স্বাভাবিকত্ব বজায় থাকে। অমোল বলেছিলেন, দৃশ্যে আমি একটা সময় স্মিতার হাত ধরে তাঁর গালে চড় মেরেছিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে স্মিতার রিঅ্যাকশন ছিল দেখার মতো। রাগে-ক্ষোভে-উত্তেজনায়-অপমানে সে ফুলছিল। ক্যামেরা কিন্তু থামেনি। কারণ শ্যাম বেনেগাল চেয়েছিলেন অজান্তে চড় খেলে কেমন অনুভূতি উঠতে পারে সেটাই তুলে ধরতে। শ্যাম 'কাট' বলার পর আমি স্মিতাকে জড়িয়ে ধরে সরি বলি। ওকে বলি পরিচালকের নির্দেশেই আমি ওর অজান্তে চড় মেরেছিলাম। আমরা তখন দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি।
স্মিতার মধ্যে আবেগ ছিল বলেই ভিতরে ভিতরে এক নিঃসঙ্গ-প্রেম ছিল। যা তিনি বুকের ভিতর সারা জীবন পুষে রেখেছিলেন। মুম্বই দুনিয়ায় ১০ বছরের অভিনয় জীবনে সেভাবে মূল্য না পেলেও কোনও ফিল্মি চেনাজানা পরিবার থেকে ক্যামেরার সামনে আসেননি তিনি। পেশাগত জীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে। মারাঠি দূরদর্শনে সংবাদ পাঠিকার কাজ দিয়ে শুরু কর্মজীবন।
রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ফটো তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ফটোটি দেখে দূরদর্শনের ডিরেক্টরের খুব পছন্দ হয়। তারপরেই তিনি টিভিতে সুযোগ পান। আর একদিন রাতে দূরদর্শনে তাঁকে খবর পড়তে দেখে নজরে পড়ে যান শ্যাম বেনেগালের। তার আগে মারাঠি মঞ্চে নাটকে অভিনয় করে নাম করে ফেলেছিলেন। ১৯৭৫ সালে শ্যাম বিখ্যাত নাটক চরণদাস চোর করার সময় স্মিতাকে ছবিতে সই করান। ১৯৮৫ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
স্মিতার ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে নববধূর বেশে সাজে সাজানো হয়। রাজ বব্বর ও স্মিতার পুত্র প্রতীকের জন্মের পরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। প্রচণ্ড জ্বরে কাবু হয়ে সংক্রমিত হয়ে যান স্মিতা। তখন সবে জন্ম হয়েছে প্রতীকের। অমিতাভ বচ্চনের মেকআপ ম্যান দীপক সাওয়ান্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, স্মিতা তাঁকে বলেছিলেন, দীপক আমি যখন মরে যাব তখন আমাকে সধবা স্ত্রীর মতো সাজিয়ে দিও। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ম্যাডাম তা পারব না। কিন্তু ভবিতব্য এমনই যে একদিন আমিই তাঁকে শেষ সাজে সাজিয়েছিলাম। জানি না, পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনও মেকআপ আর্টিস্ট আছেন কিনা যিনি একজন অভিনেত্রীকে মৃত্যুশয্যায় নববধূর বেশে মেকআপ করে দিয়েছিলেন। স্মিতার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহকে বধূবেশেই সাজানো হয়েছিল।